এমনিতে পলিটিক্স ইজ দ্য লাস্ট রিসর্ট অফ অ্যা স্কাউন্ড্রেল কথাটা আমাদের সবার শোনা আছে, আর ভারতবর্ষের রাজনীতিতে তেমন স্কাউন্ড্রেলের ছড়াছড়ি আমরা দেখেছি সেই কবে থেকে। ক’দিন আগে মা, মা গো মা বলে ক’দিন পরে ডাইনি বলা স্কাউন্ড্রেল তো আমরা এই বাংলাতেই দেখেছি। আমরা একই দিনে তিনবার দল বদলাতে দেখেছি এই দেশে, আমরা ভোররাতে কাকপক্ষী ওঠার আগেই দলবদলুদের নিয়ে সরকার তৈরি করার অসফল প্রয়াস দেখেছি। আমরা সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভোটাভুটির আগে স্যুটকেস ভর্তি টাকা দেখেছি, কাজেই আমরা অভ্যস্ত, সাধারণ মানুষ জানে রাজনীতি এক পাঁকের মধ্যে পড়ে থাকা বিষয় যা তাদের জীবনচর্যায় বিশেষ কোনও হেরফের আনবে না। তবে হ্যাঁ, নির্বাচনের সময় চারিদিকে যে নৌটঙ্কি চলে তা মানুষের জীবনে খানিক উত্তেজনা আনে, শিবির বিভক্ত মানুষ বোঝার চেষ্টা করেন কে কত আসন পাবেন, কে জিতছে কে হারছে, এই সময়েই পাড়ায় পাড়ায় নির্বাচন পণ্ডিতদের দেখা যায়, জেলা, রাজ্য তো ছেড়েই দিন দেশের আসন ধরে ধরে বলে দেয় কে কোথায় জিতছে। তো সেই একশো মজার মধ্যে, যত্রতত্র ছড়িয়ে থাকা অসভ্যদের মধ্যেই এক নতুন অসভ্যের আমদানি হল, যিনি কিছুকাল আগেই সভ্যতার পাঠ দিতেন, ন্যায়ের কথা বলতেন, তাঁর কাঁধে ছিল ন্যায়বিচারের দায়। সেই অভিজিৎ গাঙ্গুলি ছিলেন রুমাল হলেন বিড়াল। ছিলেন বিচারক, হিসেবমতো এক নিরপেক্ষ মানুষ, এক সপ্তাহের মধ্যে তিনি হলেন বিজেপি। মাথার পিছনে জাতির পিতার ছবির তলায় বসেই যাঁর সময় কেটেছে, সেই জাতির পিতার হত্যাকারী নিয়ে তাঁর নতুন বোধোদয় আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে খুব দ্রুত তিনি হয়ে উঠছেন দেশের সেই অসভ্য অংশের একজন যারা এই দেশের যাবতীয় উদার গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহ্যকে ভেঙে চুরমার করতে চায়। সেই তিনিই যিনি ক’দিন আগে বইমেলায় গিয়ে চে, লেনিনের বই হাতে নিয়ে ফোটোগ্রাফারদের সামনে পোজ দিতেন, তিনিই আজ বিশ্বাসঘাতক সাভারকরের পূজারী। সেই তিনিই গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভের সামনেই অনায়াসে বলতে পারেন, আমি কলকাতা টিভির ক্যামেরার সামনে কথাই বলব না। সেটাই আজ আমাদের বিষয় আজকে। বাংলার রাজনীতিতে এক নতুন অসভ্যের জন্ম।
সবে রাজনীতিতে এসেছেন, এসেই দেশের সর্বোচ্চ আইনসভার নির্বাচনে রাজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আসনে প্রার্থী হয়েছেন। এতদিন এক ধরনের ইমিউনিটিতে অভ্যস্ত ছিলেন, বিচারপতিকে প্রশ্ন করা যাবে না এই সাধারণ ধারণার সুবিধে নিয়েই চলেছে। বিচারপতির আসনে বসে যা যা বলেছেন আজ সেগুলো মনে পড়লেই বোঝা যাবে যে বহু আগে থেকেই তিনি বিচারপতি হিসেবেও নিরপেক্ষতার ধার ধারেননি।
আরও পড়ুন: Aajke | এবার ওবিসি নিয়ে নতুন রাজনীতি
সেদিন বিচারালয়ে বিচারপতির আসনে বসেই বলেছেন ঢাকি সমেত বিসর্জন দেবো, সব্বাই জানে তিনি কী বলতে চেয়েছেন। আজ রাস্তায় দাঁড়িয়ে বলছেন, এই রাজ্য থেকে উৎখাত করব এই সরকারকে, জেলে পাঠাব মমতা অভিষেককে। তফাত তো নেই ওনার আজকের ভূমিকা আর সেদিনের কথার মধ্যে, অথচ সেদিন তিনি কাগজে কলমে ছিলেন বিচারপতি আজ বিজেপির প্রার্থী। উনি একলা নাকি? নিশ্চয়ই নন, আরও অনেকেই আছেন। তা থাক, সেসবও খোলস ছেড়ে একদিন না একদিন হয় বেরিয়ে আসবে নয় গর্তে ঢুকে যাবে, আমরা তা জানি। আপাতত আলোচনার বিষয় এক নতুন অসভ্যকে নিয়ে যিনি গণতন্ত্রের প্রথম শর্তটুকুও জানেন না, জানেন না গণতন্ত্রের প্রথম শর্ত হল তার চারটে স্তম্ভের স্বাধীনতা। তিনি অনায়াসে ক্যামেরা ঠেলে সাংবাদিককে সরিয়ে দিয়ে বলতে পারেন, আমি কথাই বলব না। কথা তো বলতে হবে স্যর, কথা তো বলতেই হবে। আপনি পাবলিক লাইফে এসেছেন, আপনি এখন আর মাই লর্ড নন, মাই বাপ নন, আপনি একজন ভোটপ্রার্থী, জিতে গেলে একজন সাংসদ যিনি দেশের মানুষের ট্যাক্সের পয়সাতে মাইনে পাবেন, হেরে গেলে পেনশন, সেটাও মানুষের পয়সায়। এত দ্রুত কথা বলব না বলা শুরু করলে ক’দিনের মধ্যে আপনার কথা বলার ক্ষমতাও তো হারিয়ে ফেলবেন। আর কেন কথা বলবেন না? ভোটের দিনে আমাদের প্রতিনিধি রিপোর্টার দেবজ্যোতি আপনাকে আপনার জীবনের কোন গূঢ় রহস্য, জীবনের কোনও গোপন অধ্যায়ের কথা জিজ্ঞেস করেছিল? করেনি তো। জিজ্ঞেস করেছিল, সকাল থেকে ঘুরছেন, কেমন ভোট পড়ছে চারদিকে? প্রশ্নে কোনও টুইস্ট নেই, কোনও অন্য অর্থ নেই। আমরা এক অসভ্যতামি দেখলাম। আসলে উনি এখনও নিজেকে প্রশ্নের উপরেই ভাবছেন, কথা দিচ্ছি মিস্টার এক্স জাস্টিস গাঙ্গুলি, আপনি জিতলে কি হারলে, দুটো ক্ষেত্রেই এই কলকাতা টিভির বুম আপনার পিছনেই থাকবে, প্রশ্ন আমরা করব, সেদিন তো অত্যন্ত সরল প্রশ্ন ছিল, তারচেয়ে ঢের বেশি কঠিন প্রশ্নের জন্য তৈরি থাকুন। আমাদের দর্শকদের কাছে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এই নতুন অসভ্যতামি, সাংবাদিকের সাধারণ প্রশ্নের উত্তর না দিতে চাওয়া, কলকাতা টিভির সঙ্গে কথাই বলব না, একজন নির্বাচন প্রার্থী এই কথা বলছেন, এ নিয়ে আপনাদের বক্তব্য কী? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
এইভাবেই রাজনীতিতে অসভ্যদের এন্ট্রি হয়, তারা ঢোকে মুখোশ পরে, কিছুদিন পরে সেই মুখোশ খুলে যায়। অভিজিৎ গাঙ্গুলির ক্ষেত্রে সেই আবরণও ছিল না, আদতেই এক অভদ্র অসভ্য রাজনীতিবিদ হিসেবেই তিনি খুব দ্রুত তাঁর পরিচয় তৈরি করে নিলেন, যিনি গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণাতে বিশ্বাস করেন না, যিনি সংবিধানে বিশ্বাস করেন না, যিনি সাধারণ সভ্যতা ভদ্রতাতেও বিশ্বাস করেন না। এখন থেকেই বলে রাখলাম পরে মিলিয়ে নেবেন, ইনি ওই বিজেপি দলের কাছেও এক বিরাট বোঝা হয়ে উঠবেন খুব শিগগির।