হুজুরেরা এমন বিচার কি কোনও উদেশ্য নিয়ে করছেন? এ প্রশ্ন তোলাও যাবে না, কারণ ইহা আইনসম্মত নয়, কাজেই আমি সবথেকে প্রথমে ক্যাভিয়েট দিয়েই রাখলাম এখন বা এখন থেকে যা যা বলব তা উদ্দেশ্য নিয়ে নয়, রায় নিয়ে। এই রায় কোন দিক থেকে গ্রহণযোগ্য নয়, কোনদিক থেকে এই রায় মানুষের মধ্যে অন্যরকম এক ধারণা তৈরি করবে, এই আলোচনার মধ্যেই আমি আমার আলোচনাকে সীমাবদ্ধ রাখব। আর সেই অধিকার আমাকে সংবিধান দিয়েছে, আদালতের আয় আলোচনার ঊর্ধ্বে নয়। ইদানিং বহু বিচারের রায় যাঁরাই পড়ছেন দেখছেন শুনছেন, তাঁদের এবং প্রায় সমস্ত রায় রাজ্যের এক বিরাট অংশের মানুষকে কোনও না কোনওভাবে আলোড়িত করছে। সেই রায়ের ফলে আসল সমস্যার কতটা সমাধান হল, মানুষের স্বার্থ কতটা রক্ষিত হচ্ছে, সাধারণ মানুষ কতটা উপকৃত হচ্ছে, যাঁরা সেই মামলাগুলোতে অভিযুক্ত তাঁদের কতটা বিচার হচ্ছে, তাঁরা কতটা শাস্তি পাচ্ছেন এগুলোর থেকে অনেক বেশি যাকে বলে বোমা ফাটানো হচ্ছে। হ্যাঁ, আমাদের রাজ্যের বিরোধী দলের নেতার ভাষাতেই বোমা ফাটানো হচ্ছে। উনি জানালেন বোমা ফাটবে, কী আশ্চর্য সমাপতন, হুজুরেরা জানালেন, ২৬ হাজার মানুষের চাকরি নট হয়ে গেছে, লক্ষ লক্ষ মানুষের ঘুম ছুটে গেল, রাজ্য সরকার অপদার্থ ইত্যাদি হুক্কাহুয়া শোনা গেল, তারপর উচ্চতম আদালতের রায়ে বলা হল এমনটা তো হয় না, অতএব স্থগিত সেই আদেশ। কিন্তু একবার ভাবুন এমন এক রায়ের পরে বিচলিত একজনও যদি আত্মহত্যা করতেন, কে নিত সেই প্রাণের দায়। তো গতকাল এক রায় এসেছে, ১২ বছরের পুরনো মামলা, এবারেও সেই একই রঘু ডাকাত আগেই জানিয়েছিল কেঁপে যাবে সরকার, সরকার কেঁপেছে কি না জানি না তবে বহু মানুষ আবার দিশাহীন হয়ে দিন কাটাবে আর অবশ্যই একটা ধারণা তো তৈরি হবেই যে রাজ্য সরকার অপদার্থ। আবার একই সমাপতন, নির্বাচন চলছে তার ঠিক মধ্যে এল এক রায় যা বহু মানুষের স্বার্থের সঙ্গে জড়িয়ে। তাই সেটাই বিষয় আজকে। এবার ওবিসি নিয়ে নতুন রাজনীতি।
সাচার কমিটির রিপোর্ট আসার পরে সেই বাম জমানাতে হলচল শুরু হয়েছিল, মুসলমান ভোট নিয়ে ভাবনাচিন্তাও শুরু হয়েছিল। সেই সময়ে ২০১০-এর ৮ ফেব্রুয়ারি বামফ্রন্ট সরকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে আর্থ সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া কিছু অংশকে ওবিসির তালিকায় আনার সিদ্ধান্ত নেয় এক কমিশনের সমীক্ষার মতামতের ভিত্তিতে। এরপর তৃণমূল সরকার সেই তালিকাতে আরও ৩৫টি সম্প্রদায়কে যোগ করে, এক এগজিকিউটিভ অর্ডারে সেই সংরক্ষণ চালু হয় ২০১২ সালে।
আরও পড়ুন: Aajke | আহা রে, কাঁথির খোকাবাবুর বড্ড লেগেছে
এবার সেইটুকুর সংরক্ষণ বিধি বাতিল করা হয়েছে, রাজ্যের প্রত্যেক তফসিলি, আদিবাসী, আদার ব্যাকওয়ার্ড ক্লাসের সব সার্টিফিকেট বাতিল হয়েছে এমনও নয়। কেবল ওই নির্দেশ অনুযায়ী যে ‘ওবিসি এ’ গোত্রে ৯টা আর ‘ওবিসি বি’ গোত্রে ২৬টা সম্প্রদায়কে এই তালিকার মধ্যে আনা হয়েছিল, তাদের নিয়েই এই রায়। কারণ এই অন্তর্ভুক্তির বিরুদ্ধেই আরএসএস পূর্বাঞ্চলের দুই সদস্য এই মামলা আজ থেকে ১২ বছর আগে দায়ের করেছিলেন। মামলার রায়েও এটা পরিষ্কার যে এটা টেকনিক্যাল ভুল, সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার এই ভুল কিছুদিনের মধ্যেই শুধরে নিতে সক্ষম। যাঁদের নিয়ে সমস্যা সে ক্ষেত্রেও রায়ে সাফ জানানো হয়েছে, ওই শংসাপত্রের ভিত্তিতে কেউ চাকরি পেয়ে থাকলে তা চলে যাবে না। যাঁরা কোনও পরীক্ষাতে পাশ করেছেন তাঁদেরও চাকরি যাবে না, যাঁরা সরকারি সুবিধা পেয়েছেন তাঁদের সুবিধাও কাড়া হবে না। এবার রাজ্য সরকার কী করবে? মানছি না মানব না বলে ওই টেকনিকাল ত্রুটি ঠিক করে নেবেন, তাঁদের সুপারিশ আবার বিধানসভাতে আনা হবে পাশ করানো হবে, এটাই কাম্য। এক নি-জার্ক রিঅ্যাকশন, মানব না, ইত্যাদির বদলে এটাই স্বাভাবিক পদক্ষেপ। আর উল্টোদিকে ‘কেমন হয়েছে’, ‘কেমন দিলাম’ ইত্যাদি না বলে যদি মানুষের স্বার্থে কিছু করার থাকে তাহলে তাঁরা মানুষকে সত্যিটা বলুন। তা না করে বিশুদ্ধ রাজনৈতিক ফায়দা তোলার জন্য ‘দেখ কেমন লাগে’ যে কোনও মুহূর্তে বুমেরাং হতেই পারে। আর তেনাদের পোষ্য কিছু সুযোগসন্ধানী ও মাসমাহিনা পাওয়া কণ্ঠস্বরকে আপাতত ইগনোর করা উচিত। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, তাঁরা কি বুঝেছেন যে এই রায় রাজ্যের সব ওবিসিদের শংসাপত্র নিয়ে নয়? তাঁরা কি এটাও বুঝেছেন যে এই বাতিলের আদেশে একজনেরও চাকরি যাবে না, বা তার সুযোগ সুবিধে থেকে সে বঞ্চিত হবে না? এবং তাঁরা কি এটা মনে করেন যে মধ্য নির্বাচনে এ ধরনের প্রচার, যে রাজ্যে ওবিসিদের পথে বসিয়েছে তৃণমূল সরকার, এটা নিছকই এক রাজনৈতিক নির্বাচনী প্রোপাগান্ডা? শুনুন মানুষজন কী উত্তর দিয়েছেন।
বিচারব্যবস্থা মানুষের জন্য, সমাজ, রাষ্ট্রের জন্য, আইন আদতে মানুষের ভালোর জন্যই তৈরি হয়। কিন্তু সেই বিচারব্যবস্থা যদি কোনও গূঢ় উদ্দেশ্য নিয়েই চলতে থাকে, তা যদি কিছু মানুষের করায়ত্ত হয়, তা যদি কিছু মানুষের হাতের পুতুল হয়ে দাঁড়ায় তাহলে তা সমাজ রাষ্ট্র আর ব্যক্তির জন্য বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। আর আইনের সমাজ, আইনের রাষ্ট্র না হলে, তাকে রক্ষা না করা গেলে এক মাৎসন্যায় দোরগোড়ায় এসে হাজির হয়। বড় মাছ ছোট মাছকে খাবে এমন এক অরাজক রাষ্ট্র মানুষের কল্যাণ করে না।