“THE PROLETARIANS HAVE NOTHING TO LOSE BUT THEIR CHAINS, THEY HAVE A WORLD TO WIN,” কার্ল মার্ক্স বলেছিলেন। সমাজ বিপ্লবে সবথেকে কার্যকরী, সবচেয়ে ভরসা রাখা যায় এমন শ্রেণি হল মজুর, শ্রমিক। কারণ তাদের আঘাত করার ক্ষমতা অপরিসীম। কারণ তাদের হারাবার জন্য এক ছটাক জমিও নেই, তারা শ্রম বেচে খায়। তারপর অনেক জল বয়ে গেছে গঙ্গা, ভোলগা, রাইন দিয়ে। শ্রমিক আর এখন হোমোজেনিয়াস, এক রৈখিক বাস্তবতা নয়, তার নানান গুণগত পরিবর্তন হয়েছে, কায়িক শ্রম ক্রমশ চলে গেছে UNORGANISED SECTOR-এ, organized sector-এ শ্রমিকরা দর কষাকষিতে অনেক সফল, যদিও সেটা ছোট, সংখ্যায় তারা অনেক কম। ধরুন আমাদের দেশে মাত্র ১৩ শতাংশ শ্রমিক অর্গানাইজড সেক্টরে কাজ করে, বাকিরা বিড়ি শিল্প, কন্সট্রাকশন শিল্প, চামড়া শিল্প, জুট মিল এরকম ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শিল্পে কাজ করে। ঐক্যবদ্ধ নয়, চূড়ান্ত শোষণ চলে এদের ওপর, ছাঁটাই, লকআউট তো লেগেই আছে। কিন্তু তাদের সংখ্যা বেশি, তাদের আঘাত করার ক্ষমতাও বেশি, সেই আঘাত থেকে স্ট্রাইক কথাটা এসেছে।
শ্রমিক শ্রেণি ধর্মঘটকে তার দর কষাকষির জন্যই তো ব্যবহার করে থাকে, এটা মানতে হবে, সেটা দিতে হবে, কিছু অর্থনৈতিক দাবি থাকে কিছু রাজনৈতিক। এবং এই স্ট্রাইক তার শেষ অস্ত্র এরকম একটা ভুল ধারণাও কেউ কেউ দেওয়ার চেষ্টা করে। ব্রেটল্ট ব্রেখটের একটা কবিতার ক’টা লাইন:
আমাদের জামা যখন ছিঁড়তে থাকে
ছিঁড়ে যখন ফর্দাফাই
তুমি তখন দৌড়ে এসে হে নটবর
বলো যা হয় কিছু করাই যে চাই
সব রকমের চাই প্রতিকার
খোদ মালিকের গর্তে সেঁধোও মহোৎসাহে আগ বাড়িয়ে
আমরা থাকি বাইরে শীতে হাপিত্যেশে ঠায় দাঁড়িয়ে।
জঙ্গি বীরের ভঙ্গি করে
খানিক বাদে বাইরে এসে
দেখাও তোমার জয়ের ফসল কাষ্ঠ হেসে
এট্টুখানি ছোট্ট তালি,
তালি? কোথায় জামা নিটোল আস্ত?
হ্যাঁ, শ্রমিকরা লড়াই করে আর তাদের নেতারা একটা ছোট্ট টুকরো ফালি কিংবা একটা তাপ্পি মারা জামা দিয়ে তাদের ভোলানোর চেষ্টা করেছে। আমরা তো এ রাজ্যে বাম জমানায় স্ট্রাইক দেখেছি। এই দিন আনা দিন খাওয়া মজুররা দেখেছে। রাস্তায় ক্রিকেট, শুক্রবার করে বনধ, তিনদিনের ছুটি, বেলা বাড়লে বাবুদের ঘর থেকে মাংসের গন্ধ, আড্ডা, বিকেলে বনধ উঠে গেলে সিনেমা বা রেস্তরাঁ। পরের পর বনধ দেখেছে। তাই যখন মমতা বলেছে বনধ হতে দেব না তখন এই দিন আনি দিন খাই মানুষেরা ভেবেছে সেটাই ঠিক। তার একটা হাতিয়ারকে ভোঁতা করে দেওয়া হয়েছে, বণিক সভার মিটিংয়ে গিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির শুভ্রকেশ পলিটব্যুরো নেতা বলেছে “আমি লজ্জিত যে আমার দল ধর্মঘটের ডাক দেয়।” অথচ শ্রমিক শ্রেণি ধর্মঘট করেই তো পেয়েছে মে দিবস, ন্যূনতম রোজগার, সোশ্যাল সিকিউরিটি।
আসলে সবটাই যদি হয়ে দাঁড়ায় গদিতে বসার, মসনদে বসার লড়াই তাহলে এরকমই হবে। সবাই হিসেব কষছে কে কীভাবে গদিতে বসতে পারে। সিপিএম-সিপিআই মাঝেমধ্যে একটা বনধ ডাকে এখনও, খানিক সাড়া যে মেলে না তাও নয়। ব্যস, ওনারা ভাবেন এই তো বনধ করে খানিক ঘুরে দাঁড়ানো গেল, তাহলে বোধহয় ৭ শতাংশ থেকে খানিকটা বেশিই আসবে, বিজেপি নিজেদের হিন্দু পোলারাইজেশনের ভোটব্যাঙ্ক-এর কথা ভাবছে। খেয়াল করেছেন মমতা রাস্তায় তেমন পুলিশ নামানোও বন্ধ করেছেন, কেবল কিছু প্রশাসনিক সার্কুলার দিয়ে বনধকে তামাশা বানিয়ে ছেড়েছেন। পুলিশ থাকলেও তেমন জোরাজুরি করেননি। কারণটা কিন্তু ওই একই। আমি বনধ-এর বিরুদ্ধে এই অবস্থান ছাড়লেন না, বিরাট ঝামেলা হলে বিজেপি বিরোধী মানুষের আন্দোলনে উল্টো প্রভাব পড়ত, সেটাও হতে দেন না এবং সিপিএম, বাম বাড়লে বাড়ুক, শূন্য থেকে কোথায় বা যাবে? খানিক বাড়লে মমতার লাভই হবে। সিপিএম ৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৮-২৯ শতাংশ হলে মমতা এই নির্বাচনে ৩২-৩৪টা আসন পাবেন, অতএব হে ভারতবাসী, ভুলবেন না, এখানে রাজনৈতিক দল মসনদ ছাড়া অন্য কোনও অঙ্ক নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। হয় গদি বজায় রাখার, নয় গদি পুনরুদ্ধার করার, না হলে গদিতে বসবার জন্যই এই আকুতি মিনতি।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | হাওয়া ঘুরছে, চাকা ঘুরছে
ভয়। এ এক অদ্ভুত অনুভূতি। ৪৭-এ দেশ স্বাধীন হয়েছিল। ইয়ে আজাদি ঝুটা না সচ্চা সে নিয়ে আজও বিতর্ক চলছে। কিন্তু ধরুন জওহরলাল প্রধানমন্ত্রী, কম বিরোধিতা হয়নি, কমিউনিস্ট থেকে নিজের জামাই ফিরোজ গান্ধী, তীব্র বিরোধিতা করেছে, সংসদে দাঁড়িয়ে অটল বিহারী বাজপেয়ী থেকে হীরেন মুখোপাধ্যায়। ধরুন ইন্দিরা গান্ধী, জেএনইউ-তে তখন ছাত্র নেতা সীতারাম ইয়েচুরি। সেখানে ইন্দিরা গান্ধী গেছেন, সীতারাম ইয়েচুরি ছাত্রদের দাবিপত্র পড়ে শোনাচ্ছেন, ইন্দিরা গান্ধী শুনছেন, ছবিটা দেখেছি আমরা। এবার আজকের কথা ভাবুন। কী সাংঘাতিক। ভয় দেখানো চলছে সারা দেশের মানুষকে, জেএনইউ ক্যাম্পাসে যদি মুখোশধারীরা ঢুকে ভাঙচুর করতে পারে তাহলে আপনি ভয় পাবেন না? সন্ত্রস্ত সেই ছাত্র, তাদের অভিভাবক, দেশের মানুষের সামনে একবারও এলেন না প্রধানমন্ত্রী। ছাত্রছাত্রীদের কথা শুনলেন না। অহঙ্কারী শাসকদের এরকমই হয়। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, “আমি ওনাকে বললাম (নন্দীগ্রাম ঘটনা ঘটার পরে বুদ্ধবাবুকে বললাম) যান, হাত তুলে গিয়ে ওই মানুষদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিন, মানুষ বুঝবেন, গেলেন না।” না, বুদ্ধবাবু যাননি, ফল পেয়েছেন। আজ প্রধানমন্ত্রী একই কাজ করছেন, ক্ষমতাসীনরা একই কাজ করেন, বার বার। মানুষের দরবারকে তাদের বড্ড ভয়। ভাবুন একবার প্রধানমন্ত্রী এখনও মণিপুরে যাননি, নির্বাচনী প্রচার করতে যাওয়ারও সাহস হয়নি, জানেন ওখানের মানুষ বিরোধিতা করবেন, রাস্তায় নামবেন। এদিকে সরকারে আছে বিজেপি, ডাবল ইঞ্জিনের সরকার অথচ প্রধানমন্ত্রী যেতেই পারছেন না। কলকাতায় আসছেন। ডেলি প্যাসেঞ্জারের মতোই আসছেন। এখানে অবিজেপি বিশেষ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকার, এখানে যদি তাঁর গাড়ি আটকানো হয়, এয়ারপোর্ট থেকে বের হতে না দেওয়া হয় তাহলে বিজেপি বলবে দেখুন রাজ্যের কী হাল? দেখুন প্রধানমন্ত্রীকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না, আইন শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। একটা রুটিন ১৪৪ ধারা লাগু নিয়ে কত্ত প্রতিবাদ শোনা গেল। তাহলে মণিপুরে কী হয়েছে? ওই যে শুরুতে বললাম ভয়। ওরা ভয় পেয়েছে।
কিন্তু ভয় এক মজার জিনিষ, তারও LAW OF DIMINISHING RETURNS আছে। ভয় দেখালে প্রথমে মানুষ ভয় পায়। তারপর ভয় দেখালে একটু হলেও ভয় পায়। কিন্তু যদি ক্রমাগত ভয় দেখানো হয় তাহলে একদিন ভয় কেটে যায়। এবং তখন যারা ভয় দেখায় তারা ভয় পেতে শুরু করে।
আমাদের ঐতিহ্য তো ছিল গণতন্ত্রের, আমাদের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের সমাজ বানাবেন বলেছিলেন, সে কি আইন করে? ভাকরা নাঙ্গল থেকে দামোদরে মাইথনে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, আইআইটি, ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ, এসব তাঁর কিছু কাজ। মোটের ওপর ঠিক হোক ভুল হোক সোভিয়েত ধাঁচের উন্নয়নকেই মডেল করে কাজ করেছিলেন।
পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী, খুব সংক্ষিপ্ত সময়, কিন্তু একটা স্লোগান সবাই মনে রাখবে, জয় জওয়ান জয় কিষান। তাতে কৃষকরা সত্যিই কতটা লাভ পেয়েছিলেন তা নিয়ে আপনি তর্ক করতে পারেন, কিন্তু কৃষকদের বিষয়টা যে গুরুত্ব পেয়েছিল, সেটা তো সত্যি।
তারপরে ইন্দিরা গান্ধী। গরিবি হটাও, ব্যাঙ্ক কয়লাখনি জাতীয়করণ করা ছিল বিরাট কাজ। আর কলঙ্কজনক অধ্যায় হল জরুরি অবস্থা। যদিও সেই জরুরি অবস্থার পর আবার সেই গরিবি হাটাও, সবকো শিক্ষা সব কো কাম ইত্যাদি।
এরপর রাজীব গান্ধী। ইয়ং ইন্ডিয়া, কমুনিকেশনে বিপ্লব এল, গোর্খা থেকে অহমিয়া থেকে নাগাল্যান্ড জ্বলছিল। চুক্তি হল। আমরা বলেছিলাম অ্যাকর্ড সরকার। যাই হোক কী করে গ্রামের মানুষের কাছে সরকারি প্রকল্প পৌঁছবে তা নিয়ে কথা চলছিল। রাজীব গান্ধীই প্রথমে বলেছিলেন ১ টাকা দিল্লি থেকে গেলে গ্রামে পৌঁছয় ১৫ পয়সা। অন্তত বুঝেছিলেন।
ভি পি সিং-এর জমানা ছিল মণ্ডলায়নের। দলিত, এবং পিছিয়ে পড়া মানুষের আরও একটু বেশি সুযোগের কথা, সংরক্ষণ। সত্যি করে কী হল জানি না কিন্তু এটা তো সত্যিই যে দলিত পিছিয়ে পড়া মানুষজনের সামাজিক অবস্থা একটু হলেও শুধরোল।
মানে এমনটা আমি বলছি না যে এই নেতারা যে যে স্লোগান দিয়েছেন সেটা করেছেন, অনেকে চেষ্টা করেছেন, খানিকটা পেরেছেন, বা খুব একটা কিছুই করতে পারেননি। এরপর নরসিমহা রাও। পণ্ডিত মানুষ, এসেই মুক্তকচ্ছ হয়ে দরজা হাট করে ওই সমাজতান্ত্রিক ধাঁচ ইত্যাদি যা বলা হত তার উল্টোদিকে হাঁটা শুরু করলেন। খোলা বাণিজ্যনীতি, উদারনীতি এসবই ছিল তাঁর স্লোগান। তিনিই ইউনাইটেড নেশনস-এ দেশের বিরোধী দলনেতাকে পাঠিয়েছিলেন দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে, গিয়েছিলেন বিজেপি নেতা অটল বিহারী বাজপেয়ী। মাথাতেও আসবে আজকের প্রধানমন্ত্রীর? এলেন অটল বিহারী বাজপেয়ী, বিজেপির মিলিজুলি সরকার। স্লোগান? শাইনিং ইন্ডিয়া। সোনালি চতুর্ভুজ, ন্যাশনাল হাইওয়ের ভোল পাল্টে গেল। আবার বলছি তাতে গরিবস্য গরিবদের কী হল কে জানে কিন্তু কথা হচ্ছিল উন্নয়ন নিয়ে, স্কুল কলেজ রাস্তা ব্রিজ কারখানা চাকরি এসব নিয়ে, শাইনিং ইন্ডিয়া নিয়ে। এরপর মনমোহন সিংহ। একধারে উদার অর্থনীতি, বিদেশি পুঁজির ঢালাও বিনিয়োগ, অন্যদিকে দুর্নীতি। একসঙ্গে চলল। জিডিপিও উঠছে, লুঠপাটও চলছে। নির্বাচন হল, সীমাহীন দুর্নীতির বিরোধিতায় নামল দেশের মানুষ। সরকার পড়ে গেল।
এই পর্যন্ত প্রত্যেকটা সরকারের বিরোধিতা হয়েছে। বিরোধী দলেরা করেছে, ছাত্র যুবক রাস্তায় নেমে করেছে, ভারত বনধ হয়েছে। দেশও চলিতেছিল নড়িয়া নড়িয়া। ক্ষুধা ছিল, শিক্ষার অভাব ছিল, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অভাব ছিল। ছিল তো। একজন প্রধানমন্ত্রীও তাঁর বিরোধীদের দেশদ্রোহী বলেছেন? একবারের জন্যও? বলেছেন যে বিরোধীরা আসলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের গরু কেড়ে নেবে? মঙ্গলসূত্র ছিনিয়ে নেবে? বলেছেন যান বিরোধীরা কোট আনকোট ওদের দরবারে মুজরো করতে যান? কোনও প্রধানমন্ত্রী বলেছেন নাকি যে দেশের সবথেকে বড় বিরোধী দল বা বিরোধী দলের নেতারা পাকিস্তানের সাহায্যে বিরোধিতা করে?
তাহলে এই চূড়ান্ত সাম্প্রদায়িক এক সরকারকে, নরেন্দ্র মোদির সরকারকে মানুষ কেন আনলেন? দুর্নীতি যেন না হয়, সরকার যেন সবার জন্য রোটি কপড়া মকানের বন্দোবস্ত করেন। এই তো। সরকারে এসে সবথেকে বড় কাজ করলেন ডিমনিটাইজেশন। অর্থনীতি বাবা গো মা গো বলে চিৎকার করছে, তারমধ্যে জিএসটি এল। জিডিপি নামছে, বেকার বাড়ছে, গরিবি বাড়ছে, মুল্যবৃদ্ধি আকাশ ছুঁয়েছে। ৩৭০ ধারা তুলে নেওয়া হল, তিন তালাক তুলে নেওয়া হল, নাগরিকত্বের বিল পাশ করানো হল, মন্দির ওহি বনেগা হল।
এই সরকার কী চায়? মানুষ যা চায় অন্তত তা যে এরা চায় না সেটা এখন জলের মতো পরিষ্কার। ৪৭ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত অনেক কাজ হয়েছে, অনেক অনেক অনেক কাজ বাকি। কিন্তু এরকম অকাজ হয়নি, এরকম অবিমৃষ্যকারিতা এর আগে ভারতের মানুষ দেখেনি। একটা উন্মাদের পাঠক্রমের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি আমরা। জানি রাত গাঢ় হলে সকাল আসে। জানি এই অপদার্থ সরকার চলে যাবে কিন্তু সমস্যা হল অর্থনীতি বা সমাজে যে গভীর ক্ষত তৈরি হয়ে গেল, হয়ে যাচ্ছে তাকে মেরামত করতে বহু বহুদিন, বহু সময় লাগবে। আমরা পিছিয়ে পড়লাম, দেশ পিছিয়ে পড়ল।