সাত দফার ভোটের মাত্র আর এক দফার ভোট বাকি, সেই ১৯ এপ্রিল প্রথম দফার ভোট শুরু হয়েছিল, তারও দিন কুড়ি আগে থেকে প্রচার, সে প্রচার বন্ধ হবে ২৯-এ, আর শেষ দফার ভোট পড়বে পয়লা জুন। এক দীর্ঘ নির্বাচনী প্রচার দেখলাম আমরা, বাংলার মানুষেরা। কেন এত লম্বা সময়? কারণ প্রতিটা দফায় প্রধানমন্ত্রীকে আসতে হবে, বিষ ছড়াতে হবে, প্রতিটা কেন্দ্রে গিয়ে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে এক বাইনারি তৈরি করতে হবে, তাই সাত দফায় ভোট। কিন্তু এই বিরাট লম্বা ভোটপ্রচার দেখে একবারও কি মনে হল এটা লোকসভার নির্বাচন? মনে হল যে এটা দেশের আইনসভার নির্বাচন, যেখানে বসে দেশের বাজেট পাশ হবে, মানুষের জন্য, সারা ভারতের মানুষের জন্য প্রকল্প রচনা করা হবে। তাই নিয়ে বিতর্ক হবে, দেশের জল জঙ্গল পরিবেশ সংরক্ষণের কথা হবে, দেশের বিকল্প শক্তি ভাণ্ডারের কথা হবে, দেশের মানুষের শিক্ষার কথা হবে, স্বাস্থ্যের কথা হবে। যদি সেই আইনসভার আমাদের দেশের লোকসভার নির্বাচনই এটা হয়, তাহলে সেগুলোই তো আমাদের এই নির্বাচনী প্রচারের ইস্যু হওয়ার কথা, সেগুলো নিয়েই চুলচেরা বিতর্ক হওয়ার কথা। কথা হওয়া উচিত লেবার ল নিয়ে, কথা হওয়া উচিত কৃষকের ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নিয়ে। কিন্তু সেসব কোথাও একবারের জন্যও কি শুনতে পেলেন? তার বদলে যা হল তা তো আমরা মাত্র তিন বছর আগেই বিধানসভার নির্বাচনে শুনে ফেলেছি, মানুষ সেসব শুনেছেন, তাঁদের রায়ও দিয়েছেন, তাহলে? সেটাই আমাদের বিষয় আজকে, লোকসভা নয়, বাংলার মানুষ বিধানসভার নির্বাচনে ভোট দিচ্ছেন।
হাই পিচ ক্যাম্পেন যাকে বলে আমরা তা দেখলাম। প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, অন্তত চার রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, অন্তত এক ডজন মোদি মন্ত্রিসভার মন্ত্রী এলেন রাজ্যে প্রচার করতে, সঙ্গে রাজ্যের বিরোধী দলের নেতারা। তাঁদের মুখে আমরা কি শুনলাম যে কৃষকদের আয় বাড়ানোর জন্য দেশের সরকার কী করেছে, কী করবে? ছোট ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে, মোদি সরকার সেই সমস্যা নিয়ে কী ভাবছেন, সেটা কোথাও শুনলেন নাকি? শুনলেন কোথাও যে বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য দিল্লির সরকার কী করেছেন বা কী করতে চলেছেন? নদীবাঁধ থেকে জঙ্গল নদীর দূষণ ভাঙন আর অবাধে লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে এই মোদি, শাহ, যোগীদের দল একটা কথাও বলেছে নাকি?
আরও পড়ুন: Aajke | গুজরাতে ৯ শিশু সহ ৩৩ জনের পুড়ে মারা যাওয়া ইউটিউবার প্রতিবাদীদের চোখ এড়িয়ে গেল কেন?
বদলে আমরা শুনেছি, মমতা চোর, শুনেছি এখানে সরকার মুসলমান তোষণ করেন। শুনেছি এখানে হিন্দুরা বিপন্ন, শুনেছি মতুয়াদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে, শুনেছি বিরোধীরা আসলে কীভাবে মুসলমানদের জন্যই রাখা থাকবে সব সরকারি চাকরি, শুনেছি মমতার রাজত্বে কীভাবে বেড়ে উঠছে শেখ শাহজাহানদের দল, শুনেছি সন্দেশখালির মহিলাদের উপর অত্যাচারের কথায় প্রধানমন্ত্রীর বুকে ব্যথা হয়েছে, মণিপুরের ক্ষেত্রে অবশ্য তা হয়নি। আমরা শুনেছি বাংলার সরকার এক অসৎ নিকম্মা সরকার যারা মানুষের জন্য কাজ করে না, বাংলার সরকার মানুষকে কিছু পাইয়ে দিয়ে ভোট চায়, বাংলার সরকার দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয় ইত্যাদি ইত্যাদি। আচ্ছা এই প্রচারই তো মোদি-শাহ-যোগী-নাড্ডাজিরা তিন বছর আগে এখানে করেছেন, ফল তো হাতে নাতে, অবকি বার ২০০ পারের জায়গায় ৭৭। সেই প্রচার, সেই একই প্রচার এই লোকসভার নির্বাচনের সময় আবার কেন? ওদিকে বাম কংগ্রেসের দিকে তাকিয়ে দেখুন। ২০২১-এর নির্বাচনে তাঁদের বক্তৃতা আজ চালিয়ে দিলে কেউ কোনও ফারাক বের করতে পারবে না, তার মানে কী? এটা কি বিধানসভার নির্বাচন হচ্ছিল? আসলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই সুরটা বেঁধে দিয়েছেন বহু আগেই, শুরু থেকেই তিনি নিজের কোর্টে খেলাটা নিয়ে গেছেন। প্রতিটা জনসভাতে গিয়ে উনিও বিধানসভা প্রচারের মতোই তিনি এই রাজ্যে কী কী করেছেন তার ফিরিস্তি দিয়েছেন, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার থেকে কন্যাশ্রী থেকে স্বাস্থ্যসাথী। উনি জানেন এই কাজের ফিরিস্তি মোদিজি দেবেন না, আর বাম-কংগ্রেসের এ নিয়ে কিছু বলার নেই, ওনারা দিদি মোদি এক হ্যায় বলে ২০২১-যা বলেছেন তাই বলে যাবেন, বাস্তবেও তাই হয়েছে। এবং তার ফলে এক বিশুদ্ধ বিধানসভা ভোটের প্রচার দেখলাম আমরা, যেখানে লড়াইটা মমতা বনাম মোদি, বাম কংগ্রেসের। আমরা এই প্রশ্নটাই আমাদের দর্শকদের কাছে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এই যে দু’ মাস ধরে প্রচার চলছে, সেটা কি লোকসভা নির্বাচনের? নাকি সেই বিধানসভা নির্বাচনের মতোই মমতা বনাম বিজেপি, বাম আর কংগ্রেসের লড়াই? শুনুন কী বলেছেন মানুষজন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানতেন এই লড়াই মোদি বনাম মমতা নয়, রাজ্য সরকার বনাম বিজেপি-কংগ্রেস-বাম করে তুলতে হবে। তিনি জানতেন তাঁর ভরসা ওই লক্ষ লক্ষ মানুষ যাঁদেরকে আমরা ডাইরেক্ট বেনিফিসিয়ারি বলি, যাঁরা লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের টাকা পাচ্ছেন, কন্যাশ্রীর টাকা পাচ্ছেন, সবুজসাথীর সাইকেল পাচ্ছেন, স্বাস্থ্যসাথীর চিকিৎসার সুযোগ পাচ্ছেন। উল্টোদিকে কেবল তীব্র মমতা বিরোধিতা মানুষের কাছে কোনও বিকল্প নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাতে পারেনি, ভোট হয়েছে এক্কেবারে ২০২১-এর মতো, ফারাক হল বামেদের স্পেস ছেড়ে রেখেছিলেন মমতা, কাজেই বামেদের ভোট খানিক বাড়বে। সব মিলিয়ে ২০২১-এর নির্বাচনেরই ফলাফল যদি হয় আমি তো অবাক হব না।