দীর্ঘ দু’ মাস একটানা প্রচারের পর মাইক বন্ধ, মাদার অফ ডেমোক্রেসির ফাদার চলে গেছেন ধ্যানে বসতে। আজ দিদিমণি সম্ভবত কালীঘাটের বাড়িতেই, যুবরাজ ওয়ার রুম সাজিয়ে নিচ্ছেন সময় পেয়ে, ৪ তারিখে সেখান থেকেই কাজ হবে। শান্তিকুঞ্জে গার্গল করছেন শুভেন্দু অধিকারী, ক’দিন চিল চিৎকারে কাঁপিয়েছেন দশ দিগন্ত। এত জনকে দেখে নেব বলেছেন যে ততজনকে দেখার জন্য মিনিট দশেক সময় দিতে হলেও ওনার রাজনীতি ছাড়ার বয়স হয়ে যাবে। ওদিকে সুকান্ত তো ছুটি ছুটি মোডেই আছেন। কেবল দিলু ঘোষ রোজকার মতোই সকালে হাঁটতে হাঁটতে ফিল্মি ডায়ালগ দিচ্ছেন। কমরেড সেলিম তাকিয়ে আছেন ৪ তারিখের দিকে, আবু তাহেরের মুখটা সামনে ভাসছে আর দিল্লির নতুন সংসদ ভবন। দেব অধিকারী সম্ভবত তাঁর জীবনের টাফেস্ট ক্যাম্পেন শেষ করে নতুন প্রজেক্টের প্ল্যানিংয়ে। রচনা ব্যানার্জির চোখের সামনে থেকে ধোঁয়া সরে গেছে, লকেট চ্যাটার্জি কালীবাড়িতে কি পুজো দিতে যাবেন? শত্রুঘ্ন সিনহা রাজ্য ছেড়েছেন পরশু, মিঠুন ফিরে গেছেন আপন কুলায়। দেবাংশুর খেলা হবে দিয়ে তৃণমূলের প্রচার শেষ হয়েছে, বিজেপির মাস্টার ক্যাম্পেনার আপাতত ধ্যানে। কংগ্রেসের অধীর চৌধুরী নিশ্চয়ই বহরমপুরে, হিসেব মেলাচ্ছেন। এই বয়সে ক’দিন প্রচুর ধকল গেছে প্রদীপ ভট্টাচার্যের, তিনিও বিশ্রামে। গণতন্ত্রের নেত্য থামার মুখে। এই যে শয়ে শয়ে নেতা, বিভিন্ন রংয়ের ফ্ল্যাগ নিয়ে আমাদের জীবনের মান উন্নয়নের জন্য ৬০-৬৫ দিন টানা পরিশ্রম করলেন তা কি নতুন কিছু? প্রতিবার ভোট আসে, প্রতিবার এই একই ভাবে মিটিং মিছিল, সভা বক্তৃতা, গলা চিরে আম আদমির কথা বলা দেশের রাজ্যের উন্নয়নের জন্য ঘাম ঝরানো এই মানুষজন ৪ তারিখের পরে অন্য মোডে চলে যাবেন। তখন বালতি নিয়ে মাঝরাস্তায় বসে চান করলেও আর কেউ সাবান মাখাতে আসবে না, আপনার মুখের সামনে মুখ এনে সেলফি? ভুলে যান। আবার বছর দুয়েকের আগে সেসবের কোনও চান্স নেই। আপনি দেখবেন এনারাই গাড়ির এসি চালিয়ে কালো কাচ তুলে হুউউউস করে চলে যাবেন, সেই তাঁরাই যাঁরা এই কদিন ধরে জানলা থেকে পারলে সবটুকু বার করে আপনার দিকে হাত নাড়াচ্ছিল, আপনার পাড়ায় এসে হাত জোড় করে হেঁ হেঁ করে ঘুরছিল, তাঁদের অনেকের দরজার বাইরের দরজার বাইরে রাস্তায় আপনাকে বসে থাকতে হবে যদি দেখা মেলে তাঁর। এটাই সেই রঙ্গ তামাশা যা শেষ হওয়ার মুখে আর তাই সেটাই আমাদের বিষয় আজকে।
সেই ৫২ সাল থেকে ভোট হচ্ছে, সবই নাকি আম আদমির জন্য, বাই দ্য পিপল অফ দ্য পিপল অ্যান্ড ফর দ্য পিপল, সেই পিপলের অবস্থা কেমন? দেশের ৫ শতাংশ মানুষের কাছে ২১ শতাংশ সম্পদ ছিল ১৯৫২তে। আজ? ১ শতাংশ মানুষের কাছে দেশের ৪০ শতাংশ সম্পদ জমা আছে। কার উন্নতি হয়েছে? দেশের প্রধানমন্ত্রীই বলছেন ৮০ কোটি মানুষকে মুফত-এর আনাজ, ফ্রি র্যাশন দিতে হচ্ছে। কেন? না হলে তাঁরা একবেলাও খেতে পাবে না, তাঁরা বিপিএল, বিলো পভার্টি লাইন।
আরও পড়ুন: Aajke | প্রধানমন্ত্রী বাঙালি হতে চান? পারবেন না
গত ১০ বছরের পৃথিবীর মধ্যে সব থেকে বেশি সংখ্যক বিলিওনিয়ার তৈরি হয়েছে আমাদের দেশে। দেশে নিজের বাড়ি গাড়ি আছে, এসি আছে ফ্রিজ আছে, মোবাইল আছে এমন লোকের সংখ্যা জনসংখ্যার ১০ শতাংশের কম। কিন্তু নির্বাচনের পর নির্বাচন আসে, কত কথা হয়, রোটি কপড়া আউর মকান, মাঙ্গ রহা হ্যায় হিন্দুস্তান। সে কবেকার স্লোগান, আজও প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে বলছেন ২০৪৭-এর মধ্যে সব্বার পাকা ছাদ হোগা, কবে হোগা? ৪৭-এ। ততদিন উনি থাকবেন? রাজনীতিই করবেন? না হলে কে দায় নেবে? এখনও দেশের আধা আবাদি শিক্ষার আলো পায়নি, কিন্তু তাদের চাকরির সংরক্ষণ নিয়ে বিস্তর কথা হচ্ছে। বিরোধীরা বলছেন ৫০ শতাংশের বেশি সংরক্ষণ চাই, বিজেপি বলছে আপনাদের সংরক্ষণ কেড়ে মুসলমানদের দেব না। কিন্তু সেই চাকরিটা কোথায়? কিসের সংরক্ষণ? এখনও দেশের ২৭ শতাংশ গ্রামে পানীয় জলের ব্যবস্থা নেই। এখনও ৫০ শতাংশ স্কুলে হয় শিক্ষক নেই, নয় ব্ল্যাকবোর্ড নেই, ঘর নেই, কিন্তু ৫২ থেকে কতবার সেই সব কথা বলেই আম আদমির ভোট নেওয়া হয়েছে। গত ক’ বছরের সঙ্গে ফারাকটা হল আগে তবুও এসব বস্তুগত চাহিদা, রোটি, কপড়া, মকান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পানীয় জল, বিদ্যুৎ ইত্যাদির কথা হত, এখন তা অলীক কল্পনাতে নামিয়ে আনা হচ্ছে। রামলালাকে নিয়ে এসেছেন মোদিজি তাই ভোট দাও, আমরা কাশী মথুরাতেও মন্দির তৈরি করব তাই ভোট দাও, হিন্দু খতরে মে হ্যায় তাই ভোট দাও। মানে আর আমাদের ন্যূনতম চাহিদার কথাও হয়ে উঠছে না নির্বাচনের ইস্যু। সংবিধান, গণতন্ত্র, রামলালা, হিন্দুদের বিপদ, মুসলমান আইডেন্টিটি, সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি শব্দের মধ্যেই ঘুরছে আমাদের গণতন্ত্রের মহোৎসব। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, বছরের পর বছর নির্বাচন আসে, আমরা ভোট দিই, সত্যি কি দেশের সাধারণ মানুষের নির্বাচিত সরকার মানুষের জন্য কাজ করে? এখনও দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ দু’বেলা খেতে পায় না, কিন্তু তারা ভোট দেয় কেন? শুনুন কী বলেছেন মানুষজন।
গণতন্ত্রে এক দেশের সরকার যদি কেবল ধনী, বিলিওনিয়ার, সচ্ছল মানুষদের জন্যই কাজ করে যেতে থাকে, যদি দেশের সম্পদের সিংহভাগ জড়ো হয় কিছু মানুষের মধ্যে, যদি দেশের অধিকাংশ মানুষ আরও আরও গরিব হতে থাকে, তাহলে বুঝতেই হবে যে সিস্টেমে কোথাও বেশ ভালো রকমের সমস্যা আছে। আর যখন মানুষের ন্যূনতম প্রয়োজনের বদলে অলীক কল্পনার কিছু বিষয় হয়ে ওঠে নির্বাচনের মূল ইস্যু, তখন বুঝতে হবে তলার সারিতে, লোয়ার ডেপথ-এ ক্ষোভ জমা হচ্ছে, সেই ক্ষোভকে সামাল দেওয়ার জন্যই এই সব অলীক রামলালা, মুসলমান বা হিন্দু খতরে মে হ্যায়, মন্দির মসজিদ ইত্যাদি আবেগকে সামনে আনা হয়। সমস্যা হল তাও বেশিদিন কাজ করে না, মানুষ পেটের খিদে তো খুব বেশিদিন চেপে রাখতে পারে না, তার মুখ থেকে বের হবেই, ভাত দে হারামজাদা, বাজে বকিস না।