skip to content
Monday, July 1, 2024

skip to content
Homeফিচারফ্ল্যাশ ব্যাক

ফ্ল্যাশ ব্যাক

Follow Us :

১৯৭১, অগস্ট মাস।
সিপিএমের সোনারপুর আঞ্চলিক কমিটির সদস্য নারায়ণ চৌধুরীকে গ্রেফতার করেছিল সিদ্ধার্থ রায়ের পুলিশ। নিয়ে যাওয়া হয় সোজা সোনারপুর থানায়। থানায় পৌঁছনোর পরই শুরু হয় নারায়ণের উপর অমানুষিক আক্রমণ। অনবরত রুল ও লোহার রডের ঘায়ে সমস্ত শরীর রক্তাক্ত। সিপিএমের রাজনীতিতে বিশ্বাসী হওয়াটাই হচ্ছে পুলিশের কাছে একমাত্র অপরাধ। এই অপরাধে থানার বিকৃতমনা পুলিশ নৃশংস অত্যাচার চালালেন নারায়ণের উপর। জোর করে দু’জন তাঁর হাত বেঁধে রাখে। আর একজন ধারালো অস্ত্রের সাহায্যে তাঁর মাথায় ইংরেজিতে সিপিএম এই তিনটি অক্ষর খোদাই করে দেয়। তিনি জ্ঞান হারান

তার পরেও নারায়ণের উপর অত্যাচার চালিয়েছিল ‘পুলিশের উর্দি পরা নরপিশাচের দল’।
৩১ অগস্ট নারায়ণকে আলিপুর আদালতে হাজির করা হয়। তিনি পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। ম্যাজিস্ট্রেট তাঁকে কাছে ডাকেন। মাথার দিকে তাকিয়ে চমকে ওঠেন তিনি। মাথায় খোদাই করা ছিল তিনটি অক্ষর, সিপিএম। ম্যাজিস্ট্রেট বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, আমরা এক পুলিশি রাষ্ট্রে বাস করছি। যে পুলিশ এই বীভৎস কাজ করেছে, তাদের হাতে নাগরিকদের নিরাপত্তা বিপন্ন হয়ে পড়েছে।
(ঋণ শিকার: অন্ধকারের দিনগুলি, কুমুদ দাশগুপ্ত ও পরিতোষ পাল সম্পাদিত)
এর চার বছর পরেই দেশে নেমে এসেছিল এক বিভীষিকাময় অন্ধকারের রাজত্ব, যার পোশাকি নাম জরুরি অবস্থা। সে স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এক কলঙ্কিত অধ্যায়।

কাট টু ২০২১, ৫ জুলাই

রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় ফাঁসানো মাওবাদী তকমা লাগানো অশীতিপর সমাজকর্মী জেস্যুইট পাদ্রি স্ট্যান স্বামী মারা গেলেন। কোথায়, না মুম্বইয়ের হোলি ফ্যামিলি হাসপাতালে ভেন্টিলেটরে থাকা অবস্থায়। তিনি ছিলেন জেল হেফাজতে। গত সপ্তাহেও স্ট্যান জামিনের আর্জি জানিয়েছিলেন। সোমবার সেই আর্জির শুনানি ছিল। তার আগে রবিবার রাতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। রাতেই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।সোমবার মামলার শুনানি শুরুতেই স্ট্যানের আইনজীবী আদালতকে জানান, আর শুনানির দরকার নেই। তাঁর মক্কেলের জামিনেরও প্রয়োজন পড়বে না। আজ দুপুরে তাঁর মক্কেল মারা গিয়েছেন।

সারা জীবন স্ট্যান আদিবাসীদের অধিকার রক্ষার সংগ্রাম করে গিয়েছেন। শান্তির বাণী প্রচার করেছেন। সেই ৮৪ বছরের বৃদ্ধ নাকি শহুরে মাওবাদী, তিনি এবং আরও কয়েকজন নাকি প্রধানমন্ত্রীকে খুনের ষড়যন্ত্র করেছিলেন। গত বছরের ১২ অকটোবর এনআইএ রাঁচির বাড়ি থেকে স্ট্যানকে তুলে আনে। ইউএপিএ-র কঠোর ধারা এনে তাঁকে জেলবন্দি করা হয়েছিল। তারও আগে ২০১৮ সালে ভীমা কোরেগাঁও এবং এলগার পরিষদের মামলায় সুধীর ধাওয়ালে, সোমা সেন, রোনা উইলসন, সুধা ভরদ্বাজ, গৌতম নওলাখা, অরুণ ফেরেরা, ভারভারা রাও, ভারনন গঞ্জালভেসের মতো শিল্পী, মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিক, অধ্যাপককে শহুরে মাওবাদী সাজিয়ে গ্রেফতার করে রাষ্ট্রশক্তি। স্বামীকে জড়ানো হয় ভীমা কোরেগাঁও এবং এলগার পরিষদ মামলাতেও। যিনি পার্কিনসন রোগের কারণে তরল ছাড়া কোনও খাবার মুখে তুলতে পারেন না, তিনি দেশ জুড়ে হিংসা ও অশান্তি পাকানোর চক্রান্তে লিপ্ত ছিলেন। এটা বিশ্বাসযোগ্য? কিন্তু কী আর করা যাবে? রাষ্ট্র যখন বলেছে, তখন সেটাই মেনে নিতে হবে।

কী নৃশংস এই রাষ্ট্রশক্তি দেখুন। চশমা ছাড়া স্ট্যান একেবারে অন্ধ। সেই চশমা ছাড়াই তাঁকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল এনআইএ বাহিনী। এমনকী জেলেও তাঁকে চশমা ব্যবহার করতে দেওয়া হয়নি। বারবার তাঁর জামিনের আবেদন খারিজ করে দেওয়া হয়েছে।
১৬ জন অভিযুক্তের মধ্যে স্ট্যান চলে গেলেন। ৮১ বছরের বৃদ্ধ কবি ও গণশিল্পী ভারভারা রাও ছয় মাসের জন্য জামিন পান। বাকি ১৪ জন এখনও জেল জীবন কাটাচ্ছেন। কবে তাঁদের মুক্তি হবে, কেউ জানে না। নাকি তাঁদের হালও স্ট্যান স্বামীর মতোই হবে কি না, জানা নেই তাও। ১৪ জনের পরিবার চরম দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগে দিন কাটাচ্ছে। জেলে কেউ নানা অসুখে ভুগছেন, কেউ করোনায় ভুগেছেন বা ভুগছেন। তবু রাষ্ট্রের হেলদোল নেই। জেলবন্দি বর্ষীয়ান অধ্যাপক সোমা সেনের কন্যা কোয়েল বলেন, ওঁদের বোধহয় মেরে ফেলার জন্যই আটকে রাখা হয়েছে। তাঁর এই আশঙ্কা একেবারেই অমূলক নয়।

আসলে রাষ্ট্র কী না পারে! সত্যিকে মিথ্যা প্রমাণিত করতে পারে রাষ্ট্র, মিথ্যাকে সত্যি করে তুলতে পারে, হ্যাঁ-কে না করতে পারে, আবার উল্টোটাও পারে। আমরা জানি না, জেলে এই শিল্পী, বুদ্ধিজীবী, মানবাধিকার কর্মীদের উপর কী ধরনের অত্যাচার হচ্ছে। সেই খবর বাইরে আসার পথও বন্ধ। এও এক জরুরি অবস্থাই বটে। বিরোধীরা তো প্রায়ই অভিযোগ করেন, দেশে যেন অঘোষিত জরুরি অবস্থা চলছে।
সব দেখেশুনে মনে হচ্ছে, ১৯৭১সালে আলিপুর আদালতের সেই ম্যাজিস্ট্রেটের কথাই সত্যি। আমরা এক পুলিশি রাষ্ট্রে বাস করছি। তখনও করতাম, এখনও তাই।

মনে পড়ছে কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সেই কবিতার লাইনগুলো, এই রাজা আসে, ওই রাজা যায়, শুধু পোশাকের রং বদলায়, দিন বদলায় না।

RELATED ARTICLES

Most Popular