skip to content
Monday, July 1, 2024

skip to content
Homeচতুর্থ স্তম্ভFourth Pillar: মানুষে আর অমানুষে ফারাক তো থাকবেই

Fourth Pillar: মানুষে আর অমানুষে ফারাক তো থাকবেই

Follow Us :

মাত্র ৭ দিন আগেই ঘটেছিল সেই দুর্ঘটনা, ২৭ জন মানুষ মারা গেছেন, তাঁদের শেষকৃত্যও শেষ হয়নি, কান্না থামেনি তাঁদের আত্মীয় পরিজনদের। ৩১ মার্চ ২০১৬-র কথা বলছি, নির্মীয়মাণ বিবেকানন্দ সেতু ভেঙে পড়ে যায়, বেলা ১২ নাগাদ সেই দুর্ঘটনা ঘটে, উদ্ধারকাজ শেষ হলে জানা যায় মারা গেছেন ২৭ জন মানুষ। সাতদিন পরে দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মাদারিহাটে নির্বাচনী বক্তৃতায়, সেই দুর্ঘটনাই ছিল অসলি প্রচার। কী বলেছিলেন তিনি? বলেছিলেন “দিদি বলছে এটা অ্যাক্ট অফ গড, আমি বলছি না, এটা অ্যাক্ট অফ গড নয়, এটা অ্যাক্ট অফ ফ্রড।” ঘটনার সাতদিনের মধ্যেই তিনি জেনে ফেলেছিলেন বিবেকানন্দ সেতু দুর্ঘটনা আসলে এক বড় দুর্নীতি এবং তার মাথায় আছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এখানেই শেষ নয়, এরপর তিনি বলেছিলেন, এটা আসলে ভগবানের ইশারা, ভোটের আগে ব্রিজ ভাঙাটা ভগবানের ইশারা, ভগবান জানিয়ে দিতে চাইলেন কতটা অপদার্থ এই রাজ্য সরকার। এই সরকারকে ফেলে দিন। মাঠজুড়ে ভক্তদের কোলাহল মোদি মোদি, মোদি। এবং জানানো দরকার যে অ্যাক্ট অফ গড কথাটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেননি, বলেছিলেন ওই ব্রিজ তৈরির দায়িত্বে থাকা কোম্পানির কর্মকর্তারা, মোদিজি তাঁর নির্বাচনী বক্তৃতায় যে অনর্গল মিথ্যে বলেন, এটাও ছিল সেরকমই এক মিথ্যে ভাষণ। কিন্তু মিথ্যের থেকেও বড় ছিল এক অমানবিক অসংবেদনশীল আচরণ। বক্তৃতায় একবারও ওই ২৭ জন মানুষের কথা, তাঁদের পরিবারের কথা, আরও যে জনা ৪০ মানুষ আহত হয়েছেন তাঁদের কথা একবারের জন্যও মুখে আনেননি তিনি। সেদিন তিনি ওই দুর্ঘটনা আর মৃত্যুকে পাশার ঘুঁটি চালার মতো চেলেছিলেন, নির্বাচনে জেতার জন্য এক জঘন্য অমানবিক কাজ করেছিলেন। ৬ বছর পরে গুজরাতে নির্বাচন, নির্বাচনের আগেই বিরাট দুর্ঘটনা ঘটে গেল মোরবির ঝুলতা ব্রিজ, হ্যাঙ্গিং ব্রিজে, এখনও পর্যন্ত ৪৫ জন শিশু সমেত ১৪৩ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে। এটা কি ভগবানের ইশারা? এটা কি অ্যাক্ট অফ গড? নাকি অ্যাক্ট অফ ফ্রড? না, মোদিজি এখনও জানাননি। কিন্তু ইতিমধ্যেই এই দুর্ঘটনাকে ঘিরে বেশ কিছু প্রশ্ন উঠেছে, সেগুলো নিয়ে আলোচনা করব। কিন্তু তার আগে এই মোরবি ব্রিজ নিয়ে দুটো কথা বলা দরকার। ১৮৩৯-এ ২০ ফেব্রুয়ারি এই ব্রিজ উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এসেছিলেন রিচার্ড টেম্পল, মুম্বইয়ের তৎকালীন গভর্নর। মোরবির রাজা এই ব্রিজ তৈরি করিয়েছিলেন ইতালির এক সংস্থাকে দিয়ে। তারপর থেকে এই সাসপেনশন ব্রিজ লোকের কাছে ঝুলতা ব্রিজ হয়েই থেকে গেছে। যাঁরা হরিদ্বারে লছমনঝুলা দেখেছেন তাঁরা জানেন এই ধরনের সাসপেনশন ব্রিজ লোকে চড়লে একটু দোলে, বেশি লোককে চড়তে দেওয়া হয় না, এরকম ব্রিজ সিকিমেও আছে। মোরবির এই ঝুলতা ব্রিজ ট্রিপ অ্যাডভাইসরেও এক নম্বর দর্শনীয় জায়গা। সেখানে রিভিউতে দেখতে পাচ্ছি মুম্বইয়ের পি মানসি জানুয়ারি ২০২২ এ লিখেছেন, তাঁরা ব্রিজে চলাকালীন কিছু ছেলে ব্রিজটাকে দোলাতে শুরু করে, তাঁদের কাছে এটা বিপজ্জনক মনে হয়, তাঁরা নেমে আসেন। অর্থাৎ ব্রিজ নাড়িয়ে দেওয়াটা আজকের বা কালকের ব্যাপার নয়, স্থানীয় ছেলেপুলেদের কাছে নিছকই মজা, কেউ তাদের বারণ করার ছিল না। তো সেই মোরবি ঝুলতা ব্রিজ গত সাত মাস বন্ধ ছিল। কেন? তার রিপেয়ারিং চলছিল, যাকে চুক্তিপত্রে রিনোভেশনও লেখা হয়েছে। দুর্ঘটনার ক’দিন আগেই ২৬ অক্টোবর গুজরাতি নববর্ষের দিনে এই মোরবি ব্রিজ মানুষের কাছে খুলে দেওয়া হয়, আগে টিকিট ছিল ১৫ টাকা, এবার নতুন টিকিটের দাম হল ১৭ টাকা। খুলে দেওয়ার পাঁচ দিনের মাথায় ঘটে গেল দুর্ঘটনা। বেশ কিছু প্রশ্ন উঠে আসছে, আসুন সেগুলো দেখা যাক। প্রথম প্রশ্ন, ব্রিজ ভাঙল কী করে? স্থানীয় মিউনিসিপ্যালিটি কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছে, ব্রিজে এক সময়ে মাত্র ১০০ জনের ওঠার কথা ছিল, কিন্তু সেদিন যখন দুর্ঘটনা ঘটে তখন ৫০০-র মতো মানুষ ব্রিজের উপরে ছিল। টিকিটের হিসেব থেকে দেখা যাচ্ছে ৪৭৫টি টিকিট বিক্রি হয়েছিল, এর উপরে কিছু ৮ বছরের নীচের শিশু ছিল, যাদের টিকিট কাটতে হয়নি। এই টিকিটের পয়সা কার ঘরে যায়? শেষ চুক্তি অনুযায়ী যে কোম্পানি রিনোভেশনের দায়িত্ব পেয়েছে তারাই বচ্ছরভোরের রক্ষণাবেক্ষণ করবে, টিকিট থেকে আয়ও তারাই পাবে। তাহলে এবার প্রশ্ন ওঠে কারা পেয়েছিল এই ব্রিজের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব? জানা যাচ্ছে টেন্ডার ডাকা হয়েছিল, শেষ মুহূর্তে গান্ধীনগর থেকে ফোন আসে এবং এই রিনোভেশনের দায়িত্ব দেওয়া হয় অজন্তা ম্যান্যফাকচারিং কোম্পানিকে। এরা কারা? ওরেভা গ্রুপের একটি কোম্পানি যারা অজন্তা ঘড়ি তৈরি করে, সিএফএল বাল্ব তৈরি করে, ই-বাইক তৈরি করে, মূলত ওই অজন্তা ঘড়ির সূত্রেই তাদের নামডাক। আপাতত মাথায় বসে থাকা মানুষটির নাম জয়সুখ প্যাটেল এবং আপনারা জেনে খুশি হবেন যে নীরব মোদি বা মেহুলভাই চোকসির মতো দু’ নম্বরি বিজনেস টাইকুনের মতোই ইনিও নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদির পরিচিত, নামে এবং মুখে। ক’দিন আগেই ৭ অক্টোবর ২০২১-এ এই জয়সুখভাই প্যাটেল আরেক মোটাভাই অমিত শাহের সঙ্গে বৈঠক করেছেন, রান অফ কচ্ছ নিয়ে তাঁর বিরাট পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিলেন এবং সেই প্রকল্প স্বাভাবিকভাবেই ছাড়পত্র পেতে চলেছে। যে প্রকল্পের কোনও কাজের সামান্যতম অভিজ্ঞতা এই ওরেভা গোষ্ঠীর কোনও কোম্পানিরই নেই। যেমন ছিল না ব্রিজ রিপেয়ারিং বা ব্রিজ রিনোভেশনের কোনও সামান্যতম অভিজ্ঞতা, কিন্তু জয়সুখ ভাই প্যাটেলই পেয়েছিলেন এই ব্রিজ রিনোভেশনের দায়িত্ব, যে ব্রিজ ভেঙে মারা গেল ৪৫ জন শিশু সমেত ১৪৩ জন মানুষ। পরিষ্কার অ্যাক্ট অফ ফ্রড, কিন্তু মোদিজির মুখে তালা। টেন্ডার পাস হওয়ার আগে গান্ধীনগর থেকে কে করেছিলেন ফোন? কীভাবে এক দিনের অভিজ্ঞতা না থাকার পরেও এক ঘড়ি বাল্ব তৈরি করার কোম্পানি পেয়ে যায় ব্রিজ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব, এর জবাব তো মানুষ চাইবেই। স্থানীয় মোরবি মিউনিসিপ্যালিটিতে আছে বিজেপির বোর্ড, যারা এই টেন্ডার দিয়েছিল, তাঁদের তরফে সন্দীপ সিং ঝালা জানিয়েছেন যে এই কোম্পানি কাজের শেষে কোনও ফিট সার্টিফিকেট নেয়নি। কোম্পানি জানিয়েছে তাঁরা ২ দিন আগেই ফিট সার্টিফিকেট পেয়েছেন। তাহলে তো প্রশ্ন ওঠেই যে যদি ফিট সার্টিফিকেট না নিয়েই ব্রিজ খুলে দেওয়া হয়, তাহলে খুলে দেওয়ার পরে ৪ দিন ধরে স্থানীয় মিউনিসিপালিটি প্রশাসন কি ঘাস ছিঁড়ছিল? আর যদি ২ দিন আগেই ফিট সার্টিফিকেট দেওয়া হয় তাহলে জানানো হোক কীসের ভিত্তিতে ওই সার্টিফিকেট দেওয়া হল? ১৪০ বছরের পুরনো মাচ্ছু নদীর ওপরে এই ব্রিজকে এক ইঞ্জিনিয়ারিং মার্ভেল বলা হত, আজ তা ছেঁড়া তারের মতো ঝুলছে, কে দায়ী? মোদিজিই তো বকলমে চালান গুজরাত, তাঁকে জবাব দিতে হবে না? হ্যাঁ গ্রেপ্তার হয়েছে ৯ জন, তারা কারা? অরেভা কোম্পানির দুজন স্থানীয় ম্যানেজার, দুজন টিকিট বুকিং ক্লার্ক আর কয়েকজন সিকিউরিটি গার্ড, এদেরকে শিখণ্ডী রেখে কাদের বাঁচানোর চেষ্টা চলছে? জয়সুখ প্যাটেলকে কবে গ্রেপ্তার করা হবে? যারা এই টেন্ডার পাশ করিয়েছিল, সেই বজ্জাতদের কবে গ্রেপ্তার করা হবে? কবে খুঁজে বার করা হবে সেই ফোন যিনি করেছিলেন, যে ফোনের পর আগু পিছু না দেখেই টেন্ডার দেওয়া হল জয়সুখভাই প্যাটেলকে? মনে পড়ছে না আপনাদের, মোদিজির সেই বিখ্যাত উক্তি, না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা? কোথায় গেল সেই বাওয়ালি? চোখের সামনে ১৪৫টা লাশ, এখনও নৌটঙ্কি করে চলেছে এই সরকার। রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি যাদের তারা অন্যদের দুর্নীতি নিয়ে কথা বলে চলেছে। কোথায় বসে আছেন টাচ মি নট খোকাবাবু? ১৪৫ জনের মৃত্যু, মৃত্যু নয়? কোনও মহিলা পুলিশ আপনাকে ছোঁবে না, পুরুষ পাহারা নিয়েই চলে যান বর্ধমানের পূর্বস্থলীতে হাবিবুলের বাড়ি। হ্যাঁ আমাদের রাজ্যেরও এক কিশোর এই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন, সাহস থাকে যান সেখানে, টাচ মি নট খোকাবাবু সেখানে গিয়ে বলুন কেন এক ঘড়ি বাল্ব কোম্পানিকে দেওয়া হয়েছিল ব্রিজ রক্ষণাবেক্ষণের টেন্ডার? কত টাকার বিনিময়ে? এ জবাব তো চাইবার হক আছে এই বাংলার মানুষের। চুপ করে শান্তিকুঞ্জে বসে আছেন, কারণ জবাব নেই। ২০১৬তে ২৭ জনের মৃত্যুকে সামনে রেখে ভোট ভিক্ষেয় নির্লজ্জভাবে বেরিয়েছিলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী, আর ২০২২-এ ১৪৫ জনের মৃত্যুর পরেই গুজরাতে আসন্ন নির্বাচনের আগে মিডিয়া গিয়েছিল রাহুল গান্ধীর কাছে, প্রতিক্রিয়া নিতে। রাহুল গান্ধী জানিয়েছেন, মর্মান্তিক দুঃখজনক ঘটনা, আহতদের চিকিৎসা হোক, মৃতদের পাশে দাঁড়াচ্ছি সমবেদনা নিয়ে আর বলছি এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা নিয়ে রাজনীতি করবেন না। হ্যাঁ, ঠিক এই কথাই বলেছেন তিনি, ফারাক তো থাকবেই। মানুষে আর অমানুষে ফারাক তো থাকবেই। 

 

RELATED ARTICLES

Most Popular