বিশ্বকর্মা পুজোর দিন নয়, একটাও ঘুড়ি নেই আকাশে, পেটকাটি, চাঁদিয়াল, মোমবাতি, বগগা, কেউ নেই। কিন্তু আমার ভো কাট্টা বলে চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে, স্পষ্ট দেখতেই পাচ্ছি, পাশের বাড়ির ছাদে নরেন্দ্রভাই দামোদর দাস মোদী, হাতে লাটাই, দূরে তেনার কাটা ঘুড়ি, ল্যাগব্যাগ করে নেমে আসছে মাটিতে, ভেবলে গেছেন উনি, চোয়াল ঝুলে গেছে। আমার ভো কাট্টা বলে চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে, পাশের রাস্তা দিয়ে ফিরছে আমাদের অন্নদাতারা, তারাই কেটে দিয়েছে আত্মম্ভরিতার সেই বিরাট ঘুড়ি, ফুটো হয়ে গেছে সেই অহং এর ফানুস, বেশ লাগছে। সারা পৃথিবী দেখেছিল, বিদ্যুতের গতিতে জার্মান সেনারা ঢুকে পড়ছিল রাশিয়ায়, রাশিয়ার পতন হলে ইংল্যান্ড ধুলোর মত উড়ে যাবে। সেদিন স্তালিনগ্রাদের কাঁধে কাঁধ লড়াই, প্রতিটি রাস্তায় ব্যারিকেড, প্রতিটি পদক্ষেপে স্নাইপার রাইফেলের আক্রমণে ছিন্ন ভিন্ন হয়েছিল, না কেবল জার্মান বাহিনী নয়, চোয়াল ঝুলে গিয়েছিল হিটলারের, হাত আরও কাঁপছিল, গলার আওয়াজ কমেছিল। হ্যাঁ স্তালিনগ্রাদ এক ফাসিস্ট কে জাহান্নমের রাস্তা দেখিয়ে দিয়েছিল, সিধা জাহান্নুম।
জেনেইছিলাম, লালফৌজের মত দুর্জয় সুনিশ্চিত, আবার দখল নিয়ে দেবে প্রত্যাঘাত, অমর স্তালিনগ্রাদ। আর সিঙ্ঘু বর্ডার, গাজিপুর বর্ডার, টিকরি বর্ডার ভারতের নয়া ফাসিস্ত অবতার নরেন্দ্রভাই দামোদর দাস মোদীকে, তেনার জয়রথকে থামিয়ে দিয়েছে, জয় এসেছে ৩৭৮ দিন পরে, ৩৮০ দিন পরে ১১ ডিসেম্বার সেই অন্নদাতারা ফিরে যাবে তাদের ঘরে, সেই সাঁঝা চুলহা, সেই কড়ক তন্দুরি রোটি, দাল তড়কা মারকে, শীতের বেলার সরষো দি শাগ, মক্কে দি রোটি নিয়ে বসে আছে বৌ, কতদিন তাঁরা তাদের সন্তানদের আদর করেন নি, কতদিন তাম্বা আর কুর্তা পরে ভাঙ্গরা হয়নি তাঁদের গ্রামে, সরষে ক্ষেতের পাশে টান টান শুয়ে থাকা গ্রামে তারা ফিরছে, এক প্রবল প্রতিদ্বন্দীর মাথা হেঁট করে দিয়ে বিজয় গৌরবে তাঁরা ফিরছে, সেই ৬৭১ জন শহীদের আত্মত্যাগের কথা মনে করতে করতেই তাঁরা ফিরছে, এ এক ইতিহাস।
আসুন আন্দোলনের সালতামামিতে, আরেকবার নজর দেওয়া যাক। এমনিতেই কৃষকরা বিভিন্ন দাবি নিয়ে বহুদিন ধরেই আন্দোলন করছিলেন, বড় বড় সভা, সমাবেশ হচ্ছিল, বিরাট মিছিল বের হল মূলত বামপন্থীদের উদ্যোগে মহারাষ্ট্রে, লালঝান্ডা নিয়ে পদযাত্রা, দেখার মতন ছবি, কৃষকরা ১০০/১৫০ কিলোমিটার দূর থেকে হেঁটে মুম্বাই আসছেন, পায়ে ফোসকা, ক্লান্তি, মুখে শ্লোগান। এম এস পি চাই, তখনও আমাদের মেনস্ট্রিম মিডিয়া, গোদি মিডিয়া এম এস পি খায় না পাতে দেয়, তাও জানে না, কিন্তু মিছিল দেখে অবাক, কেরাণি রক্তে দোলা, ওই তো ওই তো কৃষকরা জেগেছে, গ্রাম থেকে শহরে আসছে তাঁদের দাবি জানাতে। তারপর কিছুদিনের মৌনতা, কিন্তু দাবিও ছিল, সংগঠন তৈরিও হচ্ছিল, কিন্তু এমন আন্দোলন তো সারা দেশ এ বহুদিন ধরেই চলছিল, অতবড় পদযাত্রা না হলেও, দাবি ছিল, সেচের, সারে ভরতুকির, এম এস পির। যে যখন ক্ষমতায় থেকেছে, কারোর কানে সে সব দাবি ঢোকেনি, মোদিজীও তা না না না করে কাটিয়েই দিতে পারতেন, তা না করে তিনি খাল কেটে কুমীর ঢোকালেন, মরিবার হল তার সাধ, তিনি কৃষকদের উন্নতির জন্য, কৃষির উন্নতির জন্য, কৃষি বিল আনলেন, বিল আনার বহু আগে ৫ জুন এই সংক্রান্ত অর্ডিনান্স জারি করা হল, দেশ তখন অতিমারীর কবলে, মাত্র মাস দুয়েক পরেই বর্ষাকালীন অধিবেশন, অনায়াসে তখন বিল আনা যেত, তা না করে সংসদকে এড়িয়ে তিনি অর্ডিনান্স জারি করলেন, তখনই কৃষকরা বুঝেছিল ডাল মে কুছ কালা হ্যায়, এরপর ১৪ সেপ্টেম্বার সংসদে বিল আনা হল, ২৩ সেপ্টেম্বার ২০২০।
আরও পড়ুন: চতুর্থ স্তম্ভ: সংসদ…সংসদীয় গণতন্ত্র
তিনি বর্ষা অধিবেশনে গায়ের জোরে কোনও আলোচনা ছাড়াই বিল পাস করিয়ে নিলেন, ২৭ সেপ্টেম্বার রাষ্ট্রপতি সই করে দিলেন, বিল আইন হয়ে গ্যালো। আন্দোলনের আগুনে তিনি নিজেই ঘি ঢাললেন, এমনিতে সাংবিধানিকভাবে, যুক্তরাষ্ট্র সরকার কৃষি আইন তৈরিই করতে পারেন না, কিন্তু দুরাত্মার ছলের অভাব হয় না, তিনি এই বিল কে কৃষি বিল বললেনই না, ফার্মারস প্রডিউস ট্রেড অ্যান্ড কমার্স অ্যাক্ট, ফার্মারস এগ্রিমেন্ট অফ প্রাইস অ্যাসিওরেন্স, ফার্ম সার্ভিসেস অ্যাক্ট, এসেন্সিয়াল কমোডিটিস (অ্যামেন্ডমেন্ট) অ্যাক্ট। প্রত্যেকটাই কৃষি সংক্রান্ত, প্রত্যেকে জানলেন এগুলো কৃষি বিল, কিন্তু টেকনিক্যালি এগুলো কৃষি বিল নয়, মানে ঘুরিয়ে নাক ধরা হল, প্রথম থেকেই বজ্জাতি টা কিন্তু কৃষকরা ধরে ফেলেছিলেন, কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়া হবে কৃষিক্ষেত্র, এই সত্যিটা তাঁরা বুঝে ফেলেছিলেন, আগস্ট মাস থেকেই আন্দোলন শুরু হয়ে গেল, আর বিল পাশ হবার দু’দিনের মাথায় ২৫ সেপ্টেম্বর ভারত বন্ধ ডাকা হল, মোদিজী বললেন এসব কিছু আন্দোলনজীবিদের ব্যাপার, আইন লাগু হবে। ২৫ নভেম্বার কৃষকরা ডাক দিলেন দিল্লি চলো, টিয়ার গ্যাস, লাঠি, জলকামান। ২৬ নভেম্বার আবার দেশজোড়া হরতাল, ১২ ডিসেম্বার লক্ষ লক্ষ কৃষক ট্রাক্টর সমেত চলে গেলেন দিল্লি বর্ডারে, টিকরি, সিঙ্ঘু, গাজিপুর বর্ডারে, হাজারে হাজারে ট্রাক্টর ঘিরে ফেললো দিল্লি, কাঁটা তার আর গজাল পুঁতে তাদের থামানোর চেষ্টা হল, তাঁদের দাবি দিল্লিতে ঢুকতে দিতে হবে, যন্তর মন্তরের সামনে তাঁরা ধরণায় বসবেন।
বিজেপির মন্ত্রী-নেতারা বললেন, এসব খলিস্থানি আর মাওবাদীদের কারবার। বিভিন্ন বিশিষ্ট মানুষজন এগিয়ে এলেন সমর্থনে, তাঁদের কে সরকারের দেওয়া উপাধি, পদক ফেরাতে শুরু করলেন, এরমধ্যে সরকার কথা বলা শুরু করল, ততদিনে কৃষকদের একটাই দাবি, আগে ফার্ম বিল ফেরত নিন, তারপরে অন্য কথা, সরকারের সঙ্গে বৈঠকে তাঁরা নিজেদের খাবার নিয়ে গেলেন, সরকারের নুন খাবেন না। একেই হিন্দিতে বলে তেবর, ইংরিজিতে অ্যাটিটিউড, সরকার কিন্তু সাফ জানালো আইন ফেরত নেবার প্রশ্নই নেই।
২৬ জানুয়ারি, ২০২১ কৃষকরা ট্রাক্টর মিছিল নিয়ে ঢুকলেন দিল্লি, একদল ঢুকে পড়ল লাল কেল্লায়, সরকারের ষড়যন্ত্রে সেদিন সে রাস্তায় তাঁদের আটকানোও হয়নি, দিল্লির রাস্তা না জানা কিছু কৃষক লাল কেল্লায় চলে গেলেন, অতি উৎসাহীরা সংগঠন আর শিখ ধর্ম পতাকাও তুললেন, ব্যস, গোদী মিডিয়া নেমে পড়ল প্রচারে, দেশদ্রোহী, দেশে অরাজগতা আনতে চায়, খালিস্থানি টাকা আসছে, মাওবাদীরা ঢুকে পড়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি, ২৬ জানুয়ারির ঘটনায় একটু হলেও কৃষকনেতারা হতাশ হয়েছিলেন, আপাতত ধরণা তুলে নেবার কথাও শুরু হয়ে গ্যালো, কিছু কৃষক ফেরাও শুরু করলেন, বিজেপি নেতারা ভাবলেই এইবার ঘা দেওয়া যাক, শেষ করে দেওয়া যাক কৃষক আন্দোলন কে, গুন্ডা নিয়ে তাঁদের বিধায়ক নেতারা বিভিন্ন জায়গায় হাঙ্গামা শুরু করলেন, বিকেইউ নেতা টিকায়েত আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন ২৮ জানুয়ারি, অহিংভাবে গ্রেফতারি দেবার পর তাঁরা ধরণা ছেড়ে চলে যাবেন, এরমধ্যেই বিকেল থেকে আর এস এস – বিজেপি বাহিনী নেমে পড়ল, গাজিপুর বর্ডারে পুলিশ আর বিজেপির গুন্ডারা গিয়ে হুমকি দিল জায়গা খালি করে দিতে হবে, টিকায়েত কে অপমান করা হল৷ সেদিন মিডিয়ার সামনে হাউ হাউ করে কাঁদছিলেন এই জাঠ টিকায়েত নেতা, হু হু করে পশ্চিম উত্তররদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে, কৃষকরা আবার ফেরত আসতে শুরু করল, এবার মুসলিম জাঠরাও এসে পাশে দাঁরালেন টিকায়েতের, জল আর খাবার নিয়ে হাজির হল জাঠ মুসলিম মহিলারা, ভাই এর পাশে দাঁড়াতে, এইভাবেই টুকরো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেয়৷
আরও পড়ুন: চতুর্থ স্তম্ভ : ধান কাটি, কাটি ধান, ধান কাটি
যে আন্দোলন হঠাৎই পিছু হটছিল, তা আরও জোর পেল, এরপর বাংলায় হার আর উত্তর প্রদেশের সমীক্ষা, দেশের চা ওলা কাম চওকিদার হঠাৎই ক্যামেরার সামনে, ত্যাগ তপস্যা, কিছু কৃষককে বোঝাতে পারা যায় নি, তাই আইন ফেরত নিচ্ছি, আবার কোনও আলোচনা ছাড়াই, সংসদে আইন ফেরত নেওয়া হল, এবার বাড়ি যান, কৃষকরা বললেন এম এস পি র কী হবে? ৬৭১ জনের মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ চাই, ৬০/৭০ হাজার মামলা হয়েছে, ফেরত নিতে হবে৷
এদিকে মোদি সরকারের অবস্থা ভিক্ষে চাই না মা, কুত্তা সামলা। কোনরকমে কৃষকদের বাড়ি পাঠাতেই হবে, তাই অগত্যা চিঠি পাঠাল সরকার। সব কি মেনে নিল সরকার? না মানে নি, কিন্তু আরও বড় এক সম্ভাবনা তৈরি করে দিল মোদি সরকার, আন্দোলনের পাঠশালায় প্রথম পাঠ রাস্তায় থাকা, শিখে নিল দেশের মানুষ, এবার আওয়াজ উঠছে শ্রম আইন ফেরত নাও, সি এ এ ফেরত নিতে হবে, আফস্পা ফেরত নিতে হবে। চোর পেছনে দৌড়লে গেরস্তের জোর বাড়ে, দেশের মানুষ বুঝেছেন, এ সরকার, সরকারের নেতার মুখের বুলি ৫৬ ইঞ্চি, সিনা ৫.৬ ইঞ্চি, আগে দশমিকটা বোঝা যায় নি, অতএব নতুন সম্ভাবনার মুখে দাঁড়িয়ে ভারতবর্ষ, ভোট দিয়ে নয়, কেবল ভোট দিয়ে নয়, রাস্তায় নেমেও সরকারকে মাথা নোয়াতে বাধ্য করা যায়, সরকারের বিষদাঁত উপড়ে ফেলা যায়। কৃষকরা লড়লেন, জিতলেন। আমরা কী শিখলাম? আমরা শিখলাম আন্দোলনের ভাষা, মানুষকে সঙ্গে নিয়ে রাস্তায় নামলে, প্রবল প্রতিপক্ষও হার মানে, মানতে বাধ্য হয়। জনস্রোতে নানান মতে, মনোরথেরও ঠিকানা, হবে জানা। পথে এবার নামো সাথী, নামো।