সেই সুখি পরিবারের পুতুলটার কথা মনে আছে? একটার পেটে আর একটা, তার পেট থেকে আর একটা, আবার একটা৷ এই করতে করতে সপ্তম পুতুল বের হত৷ আঙুল সমান, কিন্তু আমরা ছোটবেলায় তখনও অপেক্ষা করতাম, আরও একটা বের হল বলে। কংগ্রেসে সেরকমই কমিটি তৈরি হয়৷ দক্ষিণের জন্য এক কমিটি হওয়ার পরেই কর্নাটকের নির্বাচনের জন্য আরও এক কমিটি৷ চিন্তন শিবিরের জোগাড়ের জন্য এক কমিটি তো সেই শিবিরের আলোচনার তালিকা, আলোচ্য বিষয় স্থির করার জন্য আরেক কমিটি৷ তো এইভাবেই আগামী ২০২৪-এর নির্বাচন কে মাথায় রেখে, কী করিতে হইবে, তা নির্ধারণ করার জন্য এক কমিটি তৈরি হল৷ স্পেশ্যাল এমপাওয়ার্ড কমিটি৷ ওদিকে বিজেপি আগামী বিধানসভা, ২৪ এর লোকসভা নির্বাচনকে মাথায় রেখে ৭৩ হাজার এমন বুথ চিহ্নিত করে ফেলেছে, যেখানে বিজেপি দূর্বল৷ কংগ্রেস তখন স্পেশ্যাল এমপাওয়ার্ড কমিটি তৈরি করল এবং প্রশান্ত কিশোরকে আমন্ত্রণ জানানো হল, আপনি এই কমিটিতে আসুন, কংগ্রেসে আসুন। প্রশান্ত কিশোর অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন৷ মানে গত ১৫ দিন ধরে চলতে থাকা পিকে – কংগ্রেস আলোচনার আপাতত এটাই ইতি৷ আপাতত বলছি কেন? বলছি কারণ দলের নাম কংগ্রেস৷ জল ঘুলিয়ে খাওয়াটা ইদানিং এনাদের অভ্যেস।
এক বছর আগেও কেউ ভেবেছিল পঞ্জাবে কংগ্রেস হারবে? কয়েকটা আসন কমবে৷ আপ কয়েকটা বেশি পাবে৷ তো আ ব্যায়েল মুঝে মার, ক্যাপ্টেনকে সরানো হল৷ সিধুকেও আনা হল না৷ মধ্যিখান থেকে চান্নি, সব ঘেঁটে ঘ, পঞ্জাব হাতছাড়া হল৷ হল তো হল, কেউ দায় নিলেন? বলা হচ্ছে, কংগ্রেস তো অনেক কথাই বলছে, সত্যি কথা, ভালো কথাই বলছে, কিন্তু মানুষের কাছে তা পৌঁছচ্ছে না, কমিউনিকেটেড হচ্ছে না, অসম, বাংলা, ইউপি, পঞ্জাব, গোয়া, মণিপুর নির্বাচনের হারের বড় কারণ কমিউনিকেশনের অভাব৷ কিন্তু ২০১৫ থেকে দলের কমিউনিকেশনের দায়িত্বে রণদীপ সুরযেওয়ালা৷ প্রতিদিন নিয়ম করে প্রেসের সামনে ছড়া কেটেই যাচ্ছেন, টুইট করছেন, হয় কমিউনিকেশনে কোনও সমস্যাই নেই, নাহলে আছে, সমস্যাটা কী, সেটা কংগ্রেস জানে এবং জানে বলেই এক হাই পাওয়ার কমিটি, এমপাওয়ার্ড কমিটি তৈরি হবে, সেই কমিটি যা বলবে তা কিভাবে একজিকিউট করা হবে, তার জন্য আবার একটা কমিটি, একজিকিউট ঠিক করে হল কিনা তার জন্য আবার একটা কমিটি, ভুল হলে কোথায় ভুল হল তার জন্য আবার একটা কমিটি, কমিটির পর কমিটি৷ আপাতত এটাই কংগ্রেস৷
তো সেরকম এক কমিটিতে প্রশান্ত কিশোরকে আমন্ত্রণ জানানো হল, তিনি প্রত্যাখ্যান করলেন৷ এরপর আরেক কমিটি তিনি কোন প্রস্তাবে রাজি হবেন, তা খতিয়ে দেখার জন্য তৈরি হতেও পারে, পিকের কাছে আবার অন্য প্রস্তাব যেতেই পারে৷ তিনি আবার প্রত্যাখ্যান করতেও পারেন, গ্রহণও করতে পারেন৷ তবে সেটা ২০২৪ এর মধ্যেই হবে৷ এমন গ্যারান্টি দিতে পারব না। সে কথা থাক, আজকের আলোচনা তিনটে বিষয় নিয়ে, প্রথমটা হল, পিকে এমন কী করতে চাইছিলেন, যার ফলে কংগ্রেসের উত্থান সম্ভব হত? দ্বিতীয় বিষয়, কোথায় আটকালো? কেন হতে হতেও শেষমেষ হল না পিকে- কংগ্রেস বোঝাপড়া, তৃতীয় বিষয়, এখানেই কি শেষ? পিকে কী করতে চাইছিলেন? এটা বোঝার জন্য রকেট সায়েন্স না জানলেও চলবে৷ সাফ কথা দলের নেতৃত্ব, দলের মুখের বদল চাই, বিজেপি বিরোধী দল ও মানুষদের সঙ্গে বৃহত্তম ও কার্যকরী ঐক্য চাই, ইউপিএকে ঢেলে সাজানো চাই৷ দলের সংগঠনকে ঢেলে সাজানো চাই, দলের আবর্জনা শেষ করে সদস্যপদ বাড়াতে হবে আর দলের কমিউনিকেশন, মানুষের কাছে বার্তা পৌঁছনোর একটা ঠিকঠাক ব্যবস্থা থাকতে হবে, এই তো। ৫৮৫ বা ৬০০ পাতার পিপিটিতে এর বাইরে আর তো কিছু ছিল না, কিন্তু এগুলো করার জন্য সাত বাসি লোলচর্ম, জিব ঝুলে যাওয়া নেতা নয়, তরুণ মুখ দরকার৷ সেটার ব্যবস্থা করতেই হবে, এবং কংগ্রেসকে তার স্বধর্মে ফিরে আসতে হবে, কোনও সফট হিন্দুত্ব ইত্যাদি নয়, ধর্মনিরপেক্ষতা, উদারবাদ, কল্যাণকামী রাষ্ট্র, পিছিয়ে পড়া, গরিব মানুষের জন্য সরকার৷ এই দর্শনে ফিরে আসতে হবে। প্রশান্ত কিশোর এগুলো করতে চেয়েছিলেন, করার কথা বলেছিলেন, কংগ্রেস কি এটা করবে? করা সম্ভব? সম্ভব যদি কংগ্রেস চায়৷ কিন্তু লাখ টাকার প্রশ্ন হল কংগ্রেস কি তা চাইবে?
এবার দ্বিতীয় বিষয়, কেন ভেঙে গেল পিকে–কংগ্রেস ডিল? যা কংগ্রেসকে করতে হবে তা সহজ শোনালেও আদপেই সহজ নয়, ২০২৪ এ কংগ্রেসের মুখ থেকে রাহুল গান্ধীকে সরে যেতে হবে, ইউপিএ-র মাথায় কংগ্রেস নয়, শরিক দলের নেতাদের একজনকে বসাতে হবে, এগুলো করার, মেনে নেওয়ার ধক আছে কংগ্রেসের? এগুলো করার জন্য যে ওপেন হ্যান্ড, লাগাম ছাড়া কাজ করার শর্ত পিকে দিয়েছিলেন, সেখানেই সমস্যা। তাহলে রণদীপ সিং সুরযেওয়ালা কী করিবেন? জি-২৩ র কপিল সিব্বল কী করিবেন? যাঁর রাজ্যসভার আয়ু শেষ হওয়ার পরে চোখে জল এসেছিল মোদিজীর, সেই গুলাম নবি আজাদ কী করিবেন? ১৩৭ বছরের গ্র্যান্ড ওল্ড পার্টির পুনরুত্থানের জন্য দরকার আমূল পরিবর্তন, খোল নলচে বদল৷ তাহলেই কংগ্রেস ২০২৪ এ ক্ষমতায় আসবে? তা নয়, অন্তত লড়াই এ থাকবে, কিন্তু ক্রমশ এই কমিটি আর চিন্তন শিবিরের চক্করে পড়ে থাকলে কংগ্রেস ইতিহাসের পাতাতেই থাকবে, সংসদে নয়৷ পিকে সেই খোল নলচে বদলানোর ক্ষমতা, বৃহত্তম ঐক্য গড়ে তোলার জন্য কথা বার্তা চালানোর ক্ষমতা চেয়েছিলেন৷ কংগ্রেসের নেতৃত্ব সেখানেই আটকে গিয়েছেন৷ কংগ্রেসের একটা অংশ, বিশেষ করে রাহুল ঘনিষ্ঠ বচাখুচা কংগ্রেস নেতারা এই ডিল চাননি৷
আচ্ছা রাহুল গান্ধীও কি চেয়েছিলেন? বিরাট আলোচনা চলছে, ৬০০ পাতার পিপিটি, সিনিয়র কংগ্রেস নেতারা মন দিয়ে শুনছেন, রাজস্থানের অশোক গেহলট আর ছত্তিশগড়ের ভূপেশ বাঘেল এলেন সেই আলোচনা তে, শচীন পাইলটকে নিয়ে আসা হল, এরকম একটা সিরিয়াস আবহে রাহুল গান্ধী কোথায়? তিনি বিদেশে। কেন? কোন মহাকার্যে? কেউ জানে না। ঘোড়াকে জলের ধারে আনা যায়, কিন্তু জল তো খাওয়ানো যায় না, তার জন্য ঘোড়ার জল খাবার ইচ্ছে তো থাকতে হবে৷ কংগ্রেসের কি ঘুরে দাঁড়ানোর ইচ্ছেটুকুও আছে? কে ভি থমাস, কেরালা কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা, সি পি আই এম এর এক সভায় হাজির হয়েছিলেন, গোপন নয়, সম্মেলন উপলক্ষে এক সেমিনারে, তো তিনি নাকি দলের শৃংখলা ভঙ্গ করেছেন৷ তাই তাঁকে দল থেকে তাড়ানোর সুপারিশ করা হচ্ছে৷ এ রাজ্যে মান্নান সাহেব শুনলে আঁতকে উঠবেন৷ আসলে দলের কোনও মাথামুন্ডু নেই, গো অ্যাজ ইউ লাইক চলছে৷ অতএব আপাতত ডান ডিল, ক্লোজড ডিল হয়ে গেল।
এবার তৃতীয় বিষয়, তাহলে কি সত্যিই ক্লোজড ডিল? সেটা বলার সময় এখনও আসেনি৷ দু’ধারেরই চুক্তি ভাঙার খবর দেবার ব্যাপারে, অত্যন্ত ধীর স্থির প্রতিক্রিয়া, সেই দিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে, এ আলোচনা আবারও যে কোনওদিন শুরু হতে পারে৷ তার ইঙ্গিতও আছে। এমন খোল নলচে বদল, কংগ্রেসের ইতিহাসে অন্তত দু’বার আছে৷ একবার ১৯১৫-তে গান্ধিজী দেশে ফেরার পরে, চম্পারণ সত্যাগ্রহের পরেই কংগ্রেসের মুখে স্বরাজের কথা শোনা গেল৷ আপোষহীন স্বাধীনতার কথা শোনা গেল৷ যে সমস্ত এলিটদের হাতে বাঁধা পড়েছিল কংগ্রেস, তাদের হাত থেকে রাজ্যে রাজ্যে গান্ধী বাবার চেলারা এগিয়ে আসতে লাগলেন, কংগ্রেসের লড়াই নিছক আবেদন নিবেদন থেকে আন্দোলনের রাস্তায় এল, জুড়ে নেওয়া হল দেশের আপমর জনগণকে, এলিটরা বসে বসে দেখলেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তের উকিল, কৃষক নেতা, ছাত্র, বুদ্ধিজীবী দলের নেতৃত্ব দিতে উঠে আসলেন, গান্ধিজীর পেছনে এসে দাঁড়ালেন, নতুন অস্ত্র হাতে পেলেন, অহিংসা আর সত্যাগ্রহ। সেটা ছিল ১৮৮৫তে জন্মের পরে কংগ্রেসের পুনরুত্থান, এক্কেবারে খোলনলচে বদলে এক নতুন কংগ্রেস।
এরপর কামরাজ প্ল্যান৷ ১৯৬৩তে, ইন্দিরা গান্ধী কংগ্রেসের রাজনীতিকে বদলে দিলেন, যারা ইন্দিরাকে মনে করেছিলেন গুংগি গুড়িয়া, চুপ করে থাকা পুতুল, যাঁরা ভেবেছিলেন ব্যাক সিট ড্রাইভিং করবেন, সামনে ইন্দিরাকে রেখে, সেই সব প্রাচীনপন্থী বৃদ্ধ কংগ্রেস নেতাদের অবাক করে দিয়ে, দলের খোল নলচে বদলে নিজের হাতে ক্ষমতা নিলেন ইন্দিরা৷ সেটা ছিল কংগ্রেসের দ্বিতীয় পুনরুত্থান৷ এরপর কংগ্রেস কেবল নেমেছে, নির্বাচনে ভালো ফল করেছে হয় তো৷ কিন্তু সাংগঠনিকভাবে নেমেছে৷ গান্ধী পরিবারকে ঘিরে গড়ে উঠেছে সুযোগ সন্ধানী গ্রুপ৷ কংগ্রেসের গণতান্ত্রিক চেহারাকেই বর্বাদ করা হয়েছে দিনের পর দিন৷ এবং একের পর এক ল্যাটারাল এন্ট্রি হয়েছে দলে৷ যা দলের দৈন্যতাকেই প্রকাশ করেছে৷ গান্ধী পরিবারের সামান্যতম বিরোধিতাকে ঠাঁই দেওয়া হয়নি৷ কে কত সোনিয়া ঘনিষ্ঠ, কে কত রাহুল ঘনিষ্ঠ তার প্রতিযোগিতা চলেছে৷ রাজ্যে রাজ্যে অনুগত সেই বাহিনীর হাতে কোণঠাসা হয়েছেন, মমতা, জগন রেড্ডি, শরদ পাওয়ার, জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া, জিতিন প্রসাদ৷ কেউ তৈরি করেছেন নিজের দল, কেউ বা আরও সহজ পথে যোগ দিয়েছেন বিজেপিতে। টিম রাহুল? টিঁকে আছেন শচীন পাইলট৷ কতদিন টিঁকে থাকবেন কেউ জানে না, দলে এসেছেন কানহাইয়া কুমার, কোথায় তিনি কেউ জানে না৷ গুজরাটের হার্দিক প্যাটেলের গলায় অন্য সুর। এখনই দরকার কংগ্রেসের পুনরুত্থান৷ দলের জন্য, দেশের জন্য, ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য, সংবিধানের জন্য। কিন্তু হু উইল বেল দ্য ক্যাট? বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধিতে তো হইবে, কিন্তু প্রশ্ন বাঁধিবে কে?