এই শহরে বছরের বেশিরভাগ সময়েই তাপমাত্রা থাকে হিমাঙ্কের নীচে। সূর্যের দেখা পাওয়া এখানে অত্যন্ত মুশকিল। এমনিতে অন্য যে কোনো শহরের মতোই মনে হতে পারে। শীতল আবহাওয়া একপ্রকার অসহনীয়। ঠাণ্ডার কামড়ে মানুষ স্বাভাবিক জীবনযাপন করেন। শীতকালে গোটা শহরকে দেখলে মনে হবে পুরু বরফের চাদরের নীচে ঘুমে আছে আস্ত একটা শহর। এই শহর রাশিয়ার বুকে অবস্থিতি। এটা হল অয়মিয়াকন শহর (Oymyakon)। অয়মিয়াকন নদীর নামে নামকরণ হয়েছে এই অয়মিয়াকন শহরের। স্থানীয় ভাষায় ‘অয়মিয়াকন’ শব্দের অর্থ, আনফ্রোজেন ওয়াটার। অর্থাৎ যে জল কখনও জমে যায় না। নামের সঙ্গে এই শহরের আবহাওয়ার কোনও মিল নেই , কারণ এ শহরের সবকিছুই জমে যায়।কিন্তু অয়মিয়াকন নদীটিও জমাট বেঁধে যায় শীতে। তবে নদীর তলদেশে প্রাকৃতিক উষ্ণ জলের প্রবাহ রয়েছে, যা কখনওই জমে না।
অয়মিয়াকন (Oymyakon) রাশিয়ার সাইবেরিয়ান (Siberia, Russia) একটি অঞ্চল। সাইবেরিয়ার নাম যারা শুনেছেন তারা সবাই জানেন সাইবেরিয়াও একটি শীতপ্রধান এলাকা। সেখানেও অনেক শীত পড়ে। কিন্তু অয়মিয়াকনের ঠাণ্ডার মতো নয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সাইবেরিয়ান এই অঞ্চলটিতে যতই তুষারপাত কিংবা শীত পড়ুক না কেন এই বিরূপ আবহাওয়ায়ও মানুষ বেঁচে থাকার অভ্যাস করে নিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই অয়মিয়াকনে মানুষের বসবাস চলে আসছে। তীব্র শীতের সাথে মোকাবিলা করে তারাও যাপিত জীবন কাটাচ্ছে।
এই অঞ্চলটির ভূগৌলিক গঠনই এমন যা এই এলাকাকে শীতল থাকতে বাধ্য করে। এর পাশে দুটি প্রধান উপত্যকা রয়েছে। এই উপত্যকাগুলো শহরের ভিতরে বাতাসকে আটকে রাখে এবং শীতল জলবায়ু তৈরি করে। ফলে এখানকার তাপমাত্রা সারা বছরই অত্যন্ত ঠাণ্ডা থাকে এবং ঘন ঘন তুষারপাত হয়।শুধু শীতের সময় গোটা শহরটা বরফে ঢেকে যায়। তখন রাস্তায় কাউকে দেখা যায় না একেবারেই। অথচ হঠাৎ লক্ষ্য করতে পারেন, সমস্ত গাড়ির ইঞ্জিন (Car Engine) চালু করা রয়েছে। যেন রাস্তার ধারে ট্রাফিক সিগন্যালে আটকে রয়েছে সমস্ত গাড়ি। কিন্তু তাদের মধ্যে কোনো যাত্রী নেই। পৃথিবীর যে সমস্ত অঞ্চলে মানুষের স্থায়ী বসতি রয়েছে, তার মধ্যে অয়মিয়াকন শীতলতম (Coldest Inhabitat)। শীতকালে এখানকার তাপমাত্রা এতটাই নেমে যায়, যে গাড়ির ইঞ্জিন একবার বন্ধ করলে আর চালু করা যায় না। অয়মিয়াকনের বাসিন্দাদের প্রধান খাবার ঘোড়ার মাংস। তাই এলাকায় ঘোড়াপালন করেন বাসিন্দারা। ঘোড়াগুলিও এই প্রবল শীতে খাপ খাইয়ে নিয়েছে।
অয়মিয়াকন গ্রামের ঠিক মাঝখানে রয়েছে একটি অতিকায় ষাঁড়ের মূর্তি। আর তার নিচে লেখা একটি রেকর্ড। ১৯২৪ সালের জানুয়ারি মাসে এই শহরের তাপমাত্র নেমে গিয়েছিল – ৭১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। তবে এই পরিমাপ গ্রামবাসীরাই করেছিলেন। আবহাওয়া দফতর হিসেব অনুযায়ী রেকর্ড উষ্ণতা –৬৭.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের। ১৯৩৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ছিল সেই রেকর্ড তৈরির দিন। সাইবেরিয়ার এই ছোট্ট শহরে শীতে তাপমাত্রা নেমে যায় শূন্যের চেয়ে ৭০ ডিগ্রিরও বেশি নীচে। অর্থাৎ ডিপফ্রিজে যে তাপমাত্রা থাকে, তার তিন-চার গুণ তাপমাত্রা কম এখানে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা মাত্র ৭০০ মিটার। কিন্তু এর আশপাশে কোনও সমুদ্র না থাকায় এখানকার চরমভাবাপন্ন শীতল তাপমাত্রা প্রশমিত হতে পারে না। এখানকার ঠান্ডা বাইরে যেতে পারে না।
এক সময় একসময় অন্তত আড়াই হাজার মানুষের বাস ছিল। শুধু তাই নয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তৈরি হয়েছিল সেনাছাউনিও। তবে মানুষের সংখ্যা ক্রমশ কমছে। অবশ্য সেটাই তো স্বাভাবিক। অয়মিয়াকন এমন একটা গ্রাম, যার সবচেয়ে কাছের শহরের চেয়ে কাছে রয়েছে উত্তরমেরুবৃত্ত। শুধু তাই নয়, শীতকালে এখানে দিনের দৈর্ঘ্য দাঁড়ায় মাত্র ৩ ঘণ্টা। আর ২১ ঘণ্টা ধরে থাকে অন্ধকার রাত। হিমশীতল রাত গুলিতে নিজেদের গরম রাখতে মানুষের একমাত্র ভরসা রাশিয়ার বিখ্যাত ভদকা। শুধু তাই নয়, সবসময় ঢেকে রাখতে না পারলে বোতলের মধ্যে ভদকাও বরফে পরিণত হয়।গরম ফুটন্ত জল আকাশে ছুড়ে দেওয়া হয় এখানে, তবে তা তখনই বরফ হয়ে যায়। বয়ে আসা কনকনে হাওয়ায় যেটুকু জলীয় বাষ্প, সেটুকুও চোখের পাতায় লেগে বরফ হয়ে যায়। যে কোনও খাবার জমে এতই শক্ত হয়ে যায় যে তা আর খাওয়ার উপযোগী থাকে না। শুধু তাই নয়, ফুটন্ত জলে কাপড় কাচলেও তা বরফ হয়ে জমে গোটা পোশাক এমন শক্ত হয়ে যায়, যে তা আর ব্যবহারের উপযোগী থাকে না। প্রচণ্ড ঠান্ডায় শরীরের অনাবৃত কোনও অংশের রক্ত জমাট বেঁধে এই ফ্রস্ট বাইট হয়। ফ্রস্ট বাইট হলে আক্রান্ত প্রত্যঙ্গের কোষগুলি পচে গিয়ে ধীরে ধীরে শরীর থেকে খসে পড়ে। ঠিক সময়ে খসে না পড়লে পচন বাড়তে থাকে সারা শরীরে। এখানকার মানুষের এ বিপদ নিত্যসঙ্গী। এভাবেই একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে অমিয়াকনে থাকছেন মানুষজন। এমন অসহনীয় পরিস্থিতির জন্য অনেকেই থাকতে চাইছেন না। কেউ কেউ রয়ে গিয়েছেন স্মৃতিকে আঁকড়ে আবার কেউ কেউ রয়েছেন নিরুপায় হয়ে।