Placeholder canvas

Placeholder canvas
Homeদেশজন্মদিন: গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়ার পরে ৭৪ বছর কেটে গেল, এখনও গেয়ে...

জন্মদিন: গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়ার পরে ৭৪ বছর কেটে গেল, এখনও গেয়ে চলেছেন, রঘুপতি রাঘব রাজা রাম….

Follow Us :

শুভাশিস মৈত্র: গান্ধীকে খুন করতে নাথুরাম গডসে যে রিভলভার ব্যবহার করেছিলেন, সেটা তিনি কিনেছিলেন গোয়ালিয়র থেকে। তাই গোয়ালিয়র নাকি হিন্দুত্ববাদীদের কাছে গর্বের শহর। যে শহর থেকে গান্ধী হত্যার অস্ত্র কেনা হয়েছিল, সেই স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতে ২০২০ সালে ১০ জানুয়ারি গোয়ালিয়র শহরে ‘গডসে লাইব্রেরি’ খুলেছিল অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভা। এই লাইব্রেরির নাম ‘গডসে জ্ঞানশালা’। গডসে লাইব্রেরিতে রাখা আছে গডসের চিঠি-পত্র, গডসেকে নিয়ে লেখা হিন্দুত্বাদীদের বই ইত্যাদি। যার মাধ্যমে প্রমাণ করা হবে গান্ধী হত্যাকারী নাথুরাম গডসে কত বড় জাতীয়তাবাদী ছিলেন, সাংবাদিকদের এমনই বলেছিলেন হিন্দু মহাসভার সহ সভাপতি জয়বীর ভরদ্বাজ।

গান্ধীকে সারা পৃথিবী কী চোখে দেখে? পশ্চিমবঙ্গর প্রথম মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল ঘোষ যে একসময়ে নিয়মিত বিদেশি জার্নালে কেমিস্ট্রির উপর বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ লিখতেন, সেটা খুব একটা লোকজন জানেন না। বিজ্ঞানে তাঁর প্রবল উৎসাহ। সেই প্রফুল্ল ঘোষ ১৯৫৩ সালে  প্রিন্সটোনে গিয়েছিলেন আইনস্টাইনের সঙ্গে দেখা করতে। আত্মজীবনীতে প্রফুল্ল ঘোষ লিখেছেন, ‘ তাঁর ঘরে দেখলাম মহাত্মাজির ছবি। আইনস্টাইন আমাকে বললেন, তিনি (গান্ধী) এ যুগের শ্রেষ্ঠ মানুষ’।

আরও পড়ুন: PFI Ban Impact: পিএফআইকে নিষিদ্ধ করলেও এসডিপিআইকে জিইয়ে রেখে লাভ কী, দ্বিধায় কর্নাটক বিজেপি 

বা মেডলিন স্লেড-এর কথা। জন্ম ইংল্যান্ডে ১৮৯২ সালে। পিয়ানোয় বেঠোফেন বাজাতেন, মাঝে মাঝে অনুষ্ঠানও করতেন। সঙ্গীত নিয়ে রোম্যাঁ রোলাঁর লেখা পড়ে মেডলিন ফরাসি ভাষা শেখা শুরু করলেন রোম্যাঁ রোলাঁর সঙ্গে দেখা করবেন বলে। ততদিনে দশ খণ্ডে জঁ ক্রিস্তফ লিখে রোম্যাঁ রোলাঁ সাহিত্যে নোবেল পেয়ে গিয়েছেন। ১৯২৪-এ মেডলিন যাচ্ছেন রোলাঁর সঙ্গে দেখা করতে। দু’জনের দীর্ঘ আলোচনার পর রোম্যাঁ রোলাঁ মেডলিনকে বললেন কিছু দিনের মধ্যেই তাঁর লেখা গান্ধীর জীবনী প্রকাশিত হবে, মেডলিন যেন সেটা পড়েন (তখনও গান্ধীর সঙ্গে রোম্যাঁ রোলাঁর দেখা হয়নি)। মেডলিন প্রশ্ন করলেন, ‘গান্ধী কে’? রোম্যাঁ রোলাঁ বললেন, ‘তিনি আমাদের সময়ের যীশু’।

গান্ধীর জীবনী পড়লেন মেডলিন। মেডলিন লিখেছেন, ‘ আমি পড়ছি, পড়ছি, পড়েই চলেছি, ছাড়তে পারছি না। মনে হচ্ছিল যেন আমার হৃদয়ে ভোর হচ্ছে, যখন শেষ হল, সত্যের সূর্যরশ্মি যেন আমার আত্মাকে স্পর্শ করল।

মেডলিন ঠিক করে ফেললেন তিনি গান্ধীর কাছে যাবেন। সেই জন্য তিনি মাটিতে আসন করে বসা অভ্যাস করতে শুরু করলেন। আমিষ খাওয়া ছেড়ে দিলেন। পশম দিয়ে সুতো কাটার চেষ্টাও করলেন।  সেটা অবশ্য খুব ভালো হল না। গান্ধীর সঙ্গে কথা বলবেন, তাই শুরু করলেন হিন্দি শেখা। গান্ধীকে লিখলেন, তিনি যেন তাঁকে অনুমতি দেন তাঁর আশ্রমে থেকে তাঁর আদর্শ মেনে চলার। ৩৩ বছর বয়সে মেডলিন ১৯২৫-এর ৬ নভেম্বর মুম্বাই এসে পৌঁছলেন। এর পর আশ্রমে পৌঁছে গান্ধীকে প্রণাম করলেন। গান্ধী বললেন, আজ থেকে তুমি আমার মেয়ে। গান্ধী মেডলিনের নতুন নাম রাখলেন, মীরা বেন।

 আরও পড়ুন: Mid-day Meal Scheme: মিড ডে মিলের খরচ বাড়াচ্ছে কেন্দ্র, স্কুল পড়ুয়াদের জন্য সুখবর

গত কয়েক বছরে হিন্দুত্ববাদীদের হাতে যে দু’জনের মূর্তি আক্রান্ত হয়েছে, তারা হলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। গান্ধী যখন গান্ধী হননি, দক্ষিণ আফ্রিকায় কর্মরত, ভারতীয়দের অধিকারের দাবিতে প্রতিবাদ কর‍ছেন, কাগজ বের করছেন, সেই সময়, ১৯০৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর, তাঁর কাগজ ‘ইন্ডিয়ান ওপিনিয়ন’-এ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। গান্ধী লিখেছিলেন, বিদ্যাসাগর ১৯ শতকে ভারতের শ্রেষ্ঠ মানুষ। গান্ধী লিখলেন, যদি বিদ্যাসাগর ইয়োরোপে জন্মগ্রহণ করতেন তাঁকে মনে রাখার জন্য বড় বড় স্মারক তৈরি হত। এখনও সেই স্মারক আছে, আছে বাংলার ধনী-গরিব সব মানুষের হৃদয়ে। গান্ধী যখন এই কথা লিখছেন, তখন তাঁর বয়স ৩৬। তিনি হয়তো তখন স্বপ্নেও ভাবেননি, ১৯৪৮ সালে তাঁকে গুলি করে হত্যা করবে হিন্দুত্ববাদী গডসে।  আর ২০১৯-এ তাদেরই হাতে কলকাতায় ভাঙা পড়বে বিদ্যাসাগরের মূর্তি। রামকৃষ্ণ যখন মারা যান, গান্ধীর বয়স তখন ২০-২২ হবে। কিন্তু কী অদ্ভুত ভাষার মিল। বিদ্যাসাগরের কাছে এসে ১৮৮২ সালে রামকৃষ্ণ বলেছিলেন, বিদ্যার সাগর দেখতে এলাম। আর ১৯০৫-এ বিদ্যাসাগর সম্পর্কে গান্ধী লিখছেন, ‘ওসেন অফ লার্নিং’।

নোয়াখালিতে ভয়ঙ্কর দাঙ্গা। গান্ধী পৌঁছলেন নোয়াখালিতে। ঠিক করলেন খালি পায়ে হেঁটে মানুষের কাছে যাবেন। প্রথম প্রথম তাঁর যাওয়ার পথে ভাঙা কাচ আর মল ফেলে রাখা হত। কিন্তু তাঁকে থামানো যায়নি। তিনি পায়ে হেঁটে মানুষের মনে আস্থা ফেরানোর চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন। অভিযোগ ছিল নোয়াখালির পুলিশ সুপার, ই এস এম আবদুল্লা আক্রান্ত মানুষকে নিরাপত্তা তো দেনইনি, উল্টে দঙ্গায় উসকানি দিয়েছেন। তাকে দেখে গান্ধী বলেছিলেন, ওহ্, তুমিই তা হলে সেই আবদুল্লা! তোমার কথা আমাকে অনেকে বলেছে। নোয়াখালিতে আক্রান্ত মানুষদের রক্ষা তো তুমি করই-নি, বরং অনেক ক্ষেত্রে আক্রমণকারীদের উৎসাহ দিয়েছ। আবদুল্লা গান্ধীর সামনে কোনও জবাব না দিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। গান্ধী আবদুল্লার কাঁধে হাত রেখে বললেন, তুমি আমার সঙ্গে এসো। যে পুলিশ সুপারের বিরুদ্ধে হিন্দুদের পুঞ্জিভূত অভিযোগ, গান্ধী তাকেই নিয়ে এলেন প্রার্থনাসভায়। শ্রোতাদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। গান্ধী আবদুল্লাকে নিজের পাশে বসালেন। পরে প্রতিদিন গান্ধী প্রতিটি আক্রান্ত গ্রামে গ্রামে ঘুরেছেন। বেশ কিছু দিন ছিলেন নোয়াখালিতে। আর আবদুল্লা ততদিনে একজন বিশ্বস্ত গান্ধী-ভক্ত। পরে আবদুল্লা বদলি হয়ে যান মুর্শিদাবাদে। দেশভাগের সময় গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে তিনি জানতে চাইলেন, তিনি কি ভারতে থেকে যাবেন না পাকিস্তানে চলে যাবেন। গান্ধী আবদুল্লাকে বললেন, না, তুমি পাকিস্তানে যাও। নতুন রাষ্ট্র, পাকিস্তানের তোমার মতো অফিসারের দরকার আছে। গান্ধীহত্যার পর  গান্ধীস্মৃতি রক্ষায় একটি তহবিল তৈরি হয়েছিল। সেই তহবিলে প্রথম যে হাজার টাকার মানিঅর্ডারটি ঢাকা থেকে পৌঁছেছিল, সেটা এস এম আবদুল্লার। এই হলেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী।

আরও পড়ুন: Durga Puja Weather: বৃষ্টি অসুরের সঙ্গে জনগণেশের লড়াই চলবে আজও

নোয়াখালি থেকে কিছুদিনের মধ্যেই গান্ধী ছুটে এলেন বিহারে। বিহারে নোয়াখালির বদলা নিতে দাঙ্গা শুরু হয়েছে। বিহারে তখন কংগ্রসের সরকার।  সেই সময় একদিন স্থানীয় কংগ্রেস নেতাদের ডেকে গান্ধী বলেছিলেন, যারা বলেন বিহারের দাঙ্গা নোয়াখালির বদলা, তাদের আমি বলি, এমন ভাবে ভাবা মানে গুন্ডামির প্রতিযোগিতায় নামা। তিনি কংগ্রেস সদস্যদের উদ্দেশে বললেন,  চোখের সামনে আপনারা দেখলেন নিরীহ মানুষকে খুন করা হচ্ছে, বাধা দিতে গিয়ে আপনাদের মৃত্যু হল না কেন! হয় করব না হয় মরব, এই ভাবনা নিয়ে ঝাপিয়ে পড়লেন না কেন!

এই হলেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী।

হিন্দুত্ববাদীদের গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়ার পরে ৭৪ বছর কেটে গেল, এখনও গেয়ে চলেছেন, রঘুপতি রাঘব রাজা রাম….

ঋণ: রেবেল এগেন্সট রাজ, রামচন্দ্র গুহ, বঙ্গসংহার এবং, সুখরঞ্জন সেনগুপ্ত

RELATED ARTICLES

Most Popular