ভদ্রলোকের ছিল দুটি ধুতি। একটা পরতেন। আর একটা থাকত ধোপার বাড়িতে। ধুতি বদলানোর দরকার হলে তিনি ধোপার বাড়িতে গিয়েই বদলে আসতেন।
কাণ্ডকারখানা দেখে খানিক আন্দাজ করা যায় ভদ্রলোক কে। মুক্তরাম বাবু স্ট্রিটের বাসিন্দা শিবরাম চক্রবর্তী। ‘মুক্তারামের মেসে, শুক্তারাম খেয়ে, তক্তারামে শুয়ে’ তিনি যে অসাধারণ হাস্যরস তৈরি করেছেন তাকে টেক্কা দিতে বাংলাবাজারে এখনও কেউ আসেনি। বোধকরি আগামী একশো বছরেও কেউ আসবেন না।
‘উইট’ এবং ‘পান’? বা শিবরাম!
‘উইট’ ও ‘পান’-এর কোনও জুতসই বাংলা নেই। কাছাকাছি একটা বাংলাই হতে পারে—শিবরাম। কে যেন চিৎকার করে ডাকছিল, ধনু, ও ধনু, ধনু রে। শিবরাম সেই ডাককে বললেন ‘ধনুষ্টঙ্কার।’ যিনি হর্ষবর্ধন-গোবর্ধন লিখেছেন, তাঁর হাত দিয়েই বেরিয়েছে দেবতার জন্ম বা মস্কো বনাম পণ্ডিচেরী। চরম অর্থকষ্টে দিন কেটেছে। শেষজীবনে সরকারি মাসোহারা পেয়েছেন কিছু। শোনা যায়, মৃত্যুর পাঁচ মিনিট আগেও বলেছেন, ‘ফার্স্ট ক্লাস আছি।’ জীবনটাকে স্রেফ তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে সিনেমা দেখে, রাবড়ি খেয়ে আর ঘুমিয়ে উত্তর কলকাতার মেসবাড়িতে কাটিয়ে দিয়েছেন শিবরাম। কে একবার তাঁকে এম্বুল্যান্সে চাপা পড়ে মৃত্যুর প্রসঙ্গ তুলেছিলেন। শিবরাম তাঁকে বলছিলেন, ‘এ অতি উত্তম ব্যবস্থা। যাতে চাপা পড়লাম, তাতে উঠেই হাসপাতালে গেলাম।’
কোথায় হাস্যরস?
শিবরাম জন্মেছিলেন ১৯০৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর উত্তর কলকাতার দর্জিপাড়ায়। সদ্যই তাঁর জন্মদিন গেল। তাই তাঁর কথা মনে পড়ে গেল হঠাৎই। বাঙালি জীবন থেকে হাস্যরস বস্তুটি বিদায় নিয়েছে। লাফিং ক্লাবের গায়ের জোরে হাসিটি অবশ্য আছে। বাংলা সিনেমাতেও খুনোখুনি, দীর্ঘশ্বাস, প্রেম, যৌনতা সবই আছে, শুধু শিবরামীয় নির্মল হাসিটি আর নেই। ভানু, জহর, রবি, অনুপ, চিন্ময়ের পর তেমন কোনও অভিনেতাও তৈরি হল না আর। এই অন্ধকারে শিবরামের কথাগুলো লেবুর ঝাড়ে জোনাকির মতো জ্বলতে থাকে।
শিবরাম ও তাঁর মেসবাড়ি
তাঁর মেসবড়িতে প্রচুর আঁকিবুকি থাকত। সেগুলো মোটেই কোনও উচ্চমানের শিল্পকর্ম নয়। বিভিন্ন লোকের নাম ও ঠিকানা। লেখার কালি দেখেই নাকি শিবরাম বুঝে যেতেন কে তাঁর কাছে টাকা পায়। নিজের সংসারে অভাব ছিল প্রবল। মাঝে-মাঝেই ধার করতে হতো। সেটা নিয়েও রসিকতা করতে ছাড়েননি শিবরাম। বলেছেন, ”যাঁরা বেঁচে আছেন তাঁদের সম্পর্কে কিছু না বলাই ভালো। একজনের সঙ্গে ভালো কথা বলে আর একজনের ভালোবাসা হারাতে আমি রাজি নই। কার কাছে কখন টাকা ধার চাইতে হয়।’
জীবনে মানুষ দেখেছেন অনেক। কে বন্ধু, কে শত্রু, এটা বোঝার জন্য নিজের মতো করে একটি ফর্মুলা তৈরি করেছিলেন শিবরাম। তাঁর নিজের কথায়, ”পৃথিবীতে বড় বয়সে বন্ধু বলে কিছু হয় না। বন্ধু হয় ছোটবেলায়। স্কুল-কলেজে পড়ার সময়। তার পর হয় এনিমি অথবা নন-এনিমি। এই নন-এনিমিদেরই আমরা বন্ধু বলে মনে করি।’ ধর্ম সম্পর্কে তাঁর এলার্জি ছিল। মন্দির-মসজিদ-গির্জা না বানিয়ে পায়খানা বানানোর প্রস্তাব শিবরাম ছাড়া আর কে-ই বা দেবেন!
এক ভাঁড় রাবড়ি আর একটা সিনেমার টিকিট পেলেই যাঁর জীবন চলে যেত তাঁর কাছে ধম্মকম্ম তো নেহাতই তুসচু।