দেশ টুকরো করে এক স্বাধীনতা এসেছিল, দ্য গ্রেট বিট্রেয়াল। সেই বিরাট বিশ্বাসঘাতকতা ক্ষতচিহ্ন রেখে গেছে, তার দায় এখনও, এখনও বইছি আমরা। আরএসএস–হিন্দু মহাসভা– জিন্নাহ তুলে ধরলেন দ্বিজাতি তত্ত্ব, হিন্দু–মুসলমান আলাদা জাতি, কাজেই দাবি উঠল দুই রাষ্ট্রের। গান্ধীর যাবতীয় আপত্তিকে সরিয়ে রেখে কংগ্রেস দেশভাগে রাজি হল, কমিউনিস্টরা–হিন্দু মহাসভা আইনসভায় দেশভাগের পক্ষেই রায় দিয়েছিলেন, দ্য গ্রেট বিট্রেয়ালে সামিল ছিলেন প্রত্যেকেই। এখন সুযোগ সুবিধে মতো এ অন্যের দিকে আঙুল তোলেন, নিজের পাপ আড়াল করেন। সেদিন কংগ্রেস, হিন্দু মহাসভা, কমিউনিস্টদের প্রতিরোধ থাকলে, কেবল জিন্না এই ভারত ভাগ করতে পারতেন না। ইতিহাস তো তাই বলছে। তারপর সেই খণ্ডিত দেশেও বিশ্বাসঘাতকতার বিশাল ইতিহাস। যাঁরা বললেন গরিবি হাটাও, তাঁরা আসলে গরিব মানুষের বিরুদ্ধেই কাজ করেছেন। যাঁরা গাইলেন সাম্যের গান, তাঁরা সরকারে এসে গুলি চালালেন। যাঁরা আরও এগিয়ে বিপ্লবের পথে সমাজটাকেই বদলে দেওয়ার কথা বললেন, তাঁদের পথে পড়ে রইল রক্তাক্ত মৃতদেহ আর এক রোমাঞ্চকর আত্মত্যাগের কাহিনি, যা ভাঙিয়ে এখনও কিছু মানুষ করে খাচ্ছেন এবং সবশেষে সবকা সাথ সবকা বিকাশ করনেওয়ালাদের বিশাসঘাতকতার ফল তো হাতের সামনে। দেশের ১ শতাংশ মানুষের হাতে চলে গেছে ৪০.৫ শতাংশ সম্পদ, বছরে বছরে বাড়ছে বিলিওনিয়ারের সংখ্যা, ১০ শতাংশ মানুষের কাছে ৭৭ শতাংশ সম্পদ। এরপর আছেন উচ্চ, মধ্য, নিম্ন মধ্যবিত্ত, তাদের বাদ দিলে দেশের ৬০ শতাংশ মানুষের কাছে ৭ শতাংশ সম্পদ আছে, সবকা সাথ সবকা বিকাশ। দেশের আঞ্চলিক দলগুলোর কি আলাদা ছবি? তাও নয়। সেখানেও আশাভঙ্গের ছবি সর্বত্র।
আমাদের রাজ্যেই পরিবর্তন আর পরিবর্তনের পরের ছবি কি মিলছে? মুখ্যমন্ত্রীর এখনও ছোট গাড়ি কিন্তু বাকিদের? ২০১১তে মদন মিত্রের অতগুলো দামি গগলস আর বান্ধবী ছিল? কেষ্ট মোড়লের অত সম্পত্তি? পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের অত্ত টাকা আর জমি? ছিল নাকি আবু সুফিয়ানের প্রাসাদবাড়ি? তাকিয়ে দেখুন কে চন্দ্রশেখর রাওয়ের দিকে, তেলঙ্গানা আলাদা রাজ্যের দাবি তুলেছিল যে কে চন্দ্রশেখর রাও, তিনি এই মুহূর্তে দেশের সবথেকে পয়সাওয়ালা মুখ্যমন্ত্রী, তাঁর একটা টয়লেট তৈরি হয়েছে ১৭ কোটি টাকায়। ওনার তরফে জানানো হয়েছে, খরচ ১৭ নয় ৪ কোটি, বিরোধীরা বাড়িয়ে বলছে। টয়লেটের জন্য ৪ কোটি। জগন রেড্ডির রাজত্বে প্যারালাল মেশিনারি আছে যাঁরা রাজ্যের বিভিন্ন প্রকল্পের টেন্ডার পাশ করান, আগে কমিশনের হিসেব, তারপরে টেন্ডার এবং দ্রুত স্বচ্ছতার সঙ্গে সেই প্রক্রিয়া এগিয়ে যাবে, সঙ্গে এটাই আশ্বাস। দেশের ফকির যিনি যে কোনও মুহূর্তেই ঝোলা লেকে নিকল পড়েঙ্গে, তাঁর কথা যত কম বলা যায় ততই ভালো। কেবল তেনার সুরক্ষার জন্য প্রতিদিন খরচ হয় ১.৬৩ কোটি টাকা, দেশের জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রীর জান কা খতরা আটকাতে দেড় কোটি টাকা উবে যায় প্রতিদিন। ফকিরের নয়া বাংলোর খরচ ৪৬৭ কোটি টাকা। দেশের মহামহিম রাষ্ট্রপতির তিনরাতের বনভোজনের খরচ ১.৬৪ কোটি টাকা। এবং কী আশ্চর্য বলুন, এসব জানার পরেও দেশে কোনও হেলদোল নেই, কোথাও কোনও রাগ নেই, ঘৃণা নেই, কেবল মাওয়িস্টরা দেশের জওয়ানদের মেরে তাদের রাগের কথা জানাচ্ছেন, পালটা গুলি খেয়ে মরছেন। বাড়ি বানাচ্ছে ফকির, মারা যাচ্ছে জওয়ান। এসবের মাঝখানেই নতুন বিশ্বাস ভঙ্গের খবর এল।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | তাহলে সেই ২০০০ মানুষকে মারল কে? নাকি তাঁরা মরেননি, স্রেফ উবে গেছেন?
অরবিন্দ কেজরিওয়ালের বাড়ি রিনোভেশন করানোর জন্য খরচ করা হয়েছে ৪৫ কোটি টাকা। হ্যাঁ, রিনোভেশনেরই খরচ ৪৫ কোটি টাকা, নতুন বাড়ি তৈরি হলে তার খরচ কত হত কে জানে? কীভাবে রিনোভেশন হবে? মানে একজন ইন্টিরিয়র ডিজাইনার আর্কিটেকচার তো বলবেন, কোথায় কী থাকলে মুখ্যমন্ত্রীর ঘর দৃষ্টিনন্দন হবে, তাঁর কনসালটেন্সি ফিজ ১ কোটি টাকা। আসছি, আরও ডিটেইল পাওয়া গেছে এই রিনোভেশনের, সে কথায় আসছি, কিন্তু আসার আগে বিশ্বাসভঙ্গের ইতিহাসের পাতাগুলো একটু উল্টেপাল্টে দেখে নেওয়া যাক। আন্না হাজারের ২০১১তে লোকপাল বিলের দাবিতে আন্দোলন, গড়ে উঠল মঞ্চ, ইন্ডিয়া এগেইন্সট করাপশন, পাশে দাঁড়ালেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল, প্রশান্ত ভূষণ, ওনার বাবা শান্তিভূষণ, কবি কুমার বিশ্বাস, সাংবাদিক আশুতোষ, সমাজকর্মী যোগেন্দ্র যাদব, প্রাক্তন আইপিএস অফিসার কিরণ বেদী, অভিনেতা অনুপম খের ইত্যাদিরা, নাম হল টিম আন্না। দেশ জানল, মন্দিরে রাত কাটানো, দুটো জামাকাপড় আর একটা থালার মালিক এক এক্স আর্মিম্যান সমাজকর্মী আন্না হাজারে লড়াই শুরু করেছেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে, তখন ইউপিএ সরকার। একের পর এক দুর্নীতি সামনে আসছে। বিজেপি তার সর্বশক্তি নিয়েই টিম আন্নার পেছনে দাঁড়াল। এই আন্দোলনের এই পর্যায়ে মঞ্চে দেখা গেল বাবা রামদেবকে, সুষমা স্বরাজ বা অরুণ জেটলিকে। হ্যাঁ, যে কোনও জমায়েতে বিজেপি লোক পাঠাত হাজারে হাজারে। ক্রমশ দুর্নীতিই হয়ে উঠল ইস্যু, দুজন দুরকমভাবে এই দূর্নীতিবিরোধী আন্দোলন থেকে ফসল তুললেন। প্রথমেই সেই ফসল গেল নরেন্দ্র মোদির ঘরে, তিনি সভায় সভায় বললেন, না খানে দুঙ্গা না খাউঙ্গা, বললেন বিদেশের ব্যাঙ্ক থেকে কালা ধন ওয়াপস আয়েগা, আর তখন নাকি দেশের প্রত্যেক মানুষের অ্যাকাউন্টে ইউঁহি পন্দরহ পন্দরহ লাখ আ জায়েঙ্গে। মাথায় রাখুন, সেদিন উনি একটা কথাও রামমন্দির বা কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা নিয়ে বলেননি, বলেছেন বিকাশের কথা, সবকা সাথ, সবকা বিকাশ। এসেছেন ক্ষমতায়, মানুষকে দেওয়া প্রত্যেক প্রতিশ্রুতি হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে তেনার রথযাত্রা এখনও চলছে। অন্য ফসল উঠেছিল কেজরিওয়ালের বাড়িতে। তিনি হয়ে উঠলেন দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলনের মুখ এবং তার সঙ্গেই বিজেপি বিরোধিতা, যোগেন্দ্র যাদব ইত্যাদিদের উপস্থিতি খানিক বাম হাওয়া জোগাল। অরবিন্দ কেজরিওয়াল বললেন, কেন নেতাদের এত বড় গাড়ি? কেন লাল আলো? কেন নির্বাচনে কোটি কোটি টাকা খরচ করা? কেন এত বাহুবলী? কেন এত অস্বচ্ছতা? কেন দুর্নীতিবাজ মন্ত্রীদের দল থেকে তাড়ানো হচ্ছে না? সরকারি প্রকল্পের টেন্ডার প্রক্রিয়াতে কেন এত অস্বচ্ছতা? মানুষ দেখল, এক আম আদমি তাদের সামনে। গলায় মাথায় মাফলার, খুকখুক করে কাশে, আইআইটি পাশ, ইউপিএসসির চাকরি ছেড়ে মানুষের মাঝখানে। তিনি ২০১৫র দিল্লি নির্বাচনে বললেন, আমাদের নির্বাচন লড়ার টাকা নেই, মানুষ টাকা দিল, কিছুদিনের মধ্যেই ক্রাউড ফান্ডিং ২০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেল। কেজরিওয়াল জানালেন, ব্যস, আর টাকা দিতে হবে না, ২০ কোটি তো বিরাট টাকা, এত টাকা কী হবে? আজ সেই অরবিন্দ কেজরিওয়ালের বাড়ি কেবল রিনোভেশনের বাজেট ৪৫ কোটি টাকা, যে ইন্টিরিয়র ডিজাইনার বা আরকিটেক্টকে এই কাজে নিয়োগ করা হয়েছে তার ফিজ এক কোটি টাকা। ভিয়েতনাম থেকে মার্বেল এসেছে, সেই ইমপোর্টেড ডাইওর মার্বেল কিনতে আর লাগাতে খরচ হয়েছে ৬.০২ কোটি টাকা। স্মার্ট লাইটিং আর হিটিং, মানে সবটাই রিমোট কন্ট্রোল করা যাবে, বাড়িতে আসার আগে গরম জল করা যাবে, এসি চালানো যাবে, সেসব যন্ত্রপাতি কিনতে লাগাতে খরচ ২.৫৮ কোটি টাকা। কেবল ফায়ার ফাইটিং ইকুইপমেন্টস-এর খরচ হয়েছে ২.৮৫ কোটি টাকা। রান্নাঘরের সরঞ্জাম কিনতে ১.১ কোটি টাকা, ২০ লক্ষ টাকার কার্পেট কেনা হয়েছে, জানালা দরজার পর্দার খরচ ৪০ লক্ষ টাকা। কার জন্য? এক আম আদমির নেতার জন্য। যিনি বলেছিলেন নেতারা এতবড় গাড়ি চড়ে কেন?
মজার কথা হল সরকারি নিয়ম অনুযায়ী ১০ কোটির বেশি টাকা খরচ হলে ওপেন টেন্ডার ডাকতে হয়, এটা নিয়ম। সেই ওপেন টেন্ডার এড়াতে আম আদমি পার্টির কেজরিওয়ালজি এই খরচকে চারটে আলাদা ভাগে ভেঙে ওপেন টেন্ডার ছাড়াই এই কাজ করিয়ে নিলেন। তাঁর চারজনের, মানে দুই পুত্র কন্যা এবং স্ত্রী সমেত চারজনের পরিবারের জন্য ৭টা বেডরুম, আটটা টয়লেট, দুটো কিচেন? আম আদমি? মনে পড়ে যাচ্ছে না জর্জ অরওয়েলের অ্যানিম্যাল ফার্ম-এর কথা, পশুখামার। যেখানে পশুদের নেতামাত্রই সব কিছু পাবে আর বাকিরা খেটে মরবে কিন্তু কথা হবে সাম্যের, সমান অধিকারের। অ্যানিম্যাল ফার্ম-এ বলা আছে, অল অ্যানিমালস আর ইকুয়াল, বাট সাম আর মোর ইকুয়াল দ্যান আদারস। কেজরিওয়াল কেবল নয়, আমাদের দেশের প্রত্যেক রাজনীতিবিদ, প্রত্যেক চিন্তাশীল মানুষ, সেলিব্রিটি, আর মোর ইকুয়াল। এক সমাজকর্মীকে দেখেছি প্লেনে বিজনেস ক্লাসের সফরে, এক বিপ্লবী নেতাকে দেখেছি এসি গাড়ি না থাকায় মিটিং বাতিল করতে। রাজনৈতিক নেতাদের কথা বাদই দিলাম, তাঁরা তো আছেনই মোটা হরফে বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস লেখার জন্য। আসলে ত্যাগব্রতের যাবজ্জীবন ভারি কঠিন ব্যাপার, দেখানোর জন্য? হ্যাঁ, দেখানোর জন্যই সই আমার দেশের এক নেতা রাজনীতিতে নেমে আম আদমির পোশাক পরেছিলেন, শেষ দিন পর্যন্ত সেটাই ছিল সেই হাফ নেকেড ফকিরের পোশাক, যেদিন মারা গিয়েছিলেন, মাথায় রাখুন দিল্লিতে ৩০ জানুয়ারি, সেই ঠান্ডাতেও ইতালিয়ান বেরেত্তা পিস্তলের গুলি খেয়ে যখন সেই মানুষটা লুটিয়ে পড়ছে মাটিতে, সেদিনও তাঁর পরনে ওই খেটো ধুতি আর একটা চাদর। আমরা বিশ্বাসঘাতক, জাতির পিতাকে হত্যাই শুধু করিনি বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাসকে হই হই করে এগিয়ে নিয়ে চলেছি।