Placeholder canvas

Placeholder canvas
Homeচতুর্থ স্তম্ভFourth Pillar | সম্রাট মোদি জমানায় রামরাজ্য, বিচার এবং হত্যা 

Fourth Pillar | সম্রাট মোদি জমানায় রামরাজ্য, বিচার এবং হত্যা 

Follow Us :

ব্রাহ্মণ কাঁদছে, তাঁর সন্তান মারা গেছে, রাজা রামচন্দ্র জানতে চেয়েছেন, কাঁদছ কেন? ব্রাহ্মণ জানিয়েছে, যে শূদ্রের তপস্যা করার অধিকার নেই, সেই শূদ্র তপস্যা করছে, এবং এই অধর্মের ফলেই তাঁর পুত্রের অকালমৃত্যু হয়েছে। রাম বেরিয়ে পড়লেন সেই শূদ্রকে খুঁজতে, দক্ষিণের বনে সেই শূদ্রকে পেয়েও গেলেন। শূদ্র জানালেন, 
“তপস্বী বলেন আমি হই শূদ্রজাতি। 
শম্বুক নাম ধরি আমি শুন মহামতি।।
করিব কঠোর তপ দুর্লভ সংসারে। 
তপস্যার ফলে যাব বৈকুণ্ঠ নগরে।।” 

ব্যস, রাম তলোয়ারের এক কোপে সেই শূদ্রের গলা কেটে ফেললেন। অন্যায়ের শাস্তি। একইভাবে শূর্পনখা এসে রামকে বিবাহের প্রস্তাব দিল, রাম অস্বীকার করলেন কেবল তাই নয় খানিক খিল্লি করার জন্যই, ভাই লক্ষণকে দেখিয়ে দিলেন, তারপরে ক্রুদ্ধ শূর্পনখা সীতাকেই নষ্টের গোড়া বলে মনে করে তাঁকে আক্রমণ করলেন, রাম বাণ চালিয়ে শূর্পনখার নাক কান কেটে ফেললেন। এসব তো কৃত্তিবাসী রামায়ণে আছে। ন্যায় অন্যায়ের মধ্যে যাচ্ছিই না, কেবল বিচার পদ্ধতির দিকে খেয়াল রাখুন, রাজার মনে হল তাই মুণ্ডু কাটা গেল, রাজার মনে হল তাই নাক কান কাটা হল এক মহিলার। পুরাণ থেকে ইতিহাসে চলুন, মধ্যযুগের বিচার ব্যবস্থার বর্ণনাতেও আমরা পাই, রাজা বা সম্রাট বা সুলতান, নবাবের বিচার ছিল তাঁদের মর্জি অনুযায়ী। তারপর মানুষ সভ্য হয়েছে, মানুষ এক গণতান্ত্রিক কাঠামো গড়েছে, যেখানে এক স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা আছে, পেনাল কোড আছে, বিভিন্ন অপরাধের এবং তার শাস্তির কথা সেখানে লেখা আছে। আইন সভা, প্রশাসন আর বিচার বিভাগকে আলাদা করা হয়েছে। পুলিশের দায়িত্ব অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া নয়, তাকে আইনের আদালতে এনে হাজির করা, এরপর আইন অনুযায়ী তার বিচার করবেন বিচারপতি, তিনি শাস্তি বিধান দেবেন। পৃথিবীর অধিকাংশ বললে ভুল হবে কয়েকটা হাতে গোনা দেশ বাদ দিলে এই নিয়ম বজায় আছে সব দেশেই। আমাদের দেশও ব্যতিক্রম নয়। আছে, জনসংখ্যার চাপ আছে, স্বাভাবিকভাবে মামলা জমে থাকে, সময়ে বিচার পাওয়া যায় না, বিচার ব্যবস্থা গরিব মানুষজনের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। এসব আছে, কিন্তু তারপরেও এক বিচার বিভাগ আছে। 

কিন্তু ২০১৪-র পর থেকে ভারতবর্ষের মসনদে বসেছেন মোদিজি, তারপর থেকে গোটা সমাজের মতই বিচার ব্যবস্থাও এক মধ্যযুগীয় অন্ধকারের দিকে চলেছে। ফেক এনকাউন্টার ছিল না? সেই কবে থেকেই তা ছিল, স্বাধীনতার পরে বহুবার পুলিশি হাজতে মানুষ মারা হয়েছে, দেহ লোপাট করে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে, কিন্তু কোনও সময়েই সেই এনকাউন্টারকে পুলিশের হাতের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়নি। সিনেমার ডায়ালগে এসেছে, কখনও সখনও ব্যক্তিগত পরিসরে পুলিশ অফিসার বা পলিটিক্যাল লিডার এনকাউন্টার কর দেঙ্গে বলে শাসিয়েছেন, কিন্তু বিধানসভায় দাঁড়িয়ে ঠোক দেঙ্গে গোছের মাফিয়াগিরি আমরা দেখিনি। আবার এর বীজ যে একেবারে ছিল না তাও নয়, মুম্বই ব্লাস্ট-এর পরে, মুম্বই মাফিয়াদের কন্ট্রোলে আনতে এই এনকাউন্টারকে অস্ত্র করা হয়েছিল, আজ তিন তো কাল পাঁচজন মুম্বই আন্ডারওয়ার্ল্ড গ্যাংস্টারের দেহ পড়ে থাকতে দেখেছি, কিছু পুলিশ অফিসার তো এনকাউন্টার স্পেশালিস্ট হিসেবেই পরিচিত হতে থাকলেন। মানুষ বেশ কিছু ক্ষেত্রে এই গ্যাংস্টারদের এনকাউন্টারে উল্লসিতও হল। কিন্তু অন্যায়ের এক অদ্ভুত চরিত্র আছে, তা কখনই কন্ট্রোলে থাকে না, দু’ চারটে জায়গায় অন্যায় হবে, বাকি জায়গায় অন্যায় হবে না, বা অন্যায়ের একটা পরিমাপ থাকবে, তার চেয়ে বড় অন্যায় হবে না, এরকমটা কিন্তু হয় না। অন্যায় বাড়তে থাকা, আকারে, আয়তনে কেবল নয় তার চরিত্রেরও গুণগত বৃদ্ধি হয়। যা আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি। দেশের অন্যতম অঙ্গরাজ্য উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর সাড়ে ছ’ বছরের আমলে ১০ হাজার এনকাউন্টার হয়েছে, হ্যাঁ ১০ হাজার। এবং তার কদর্য রূপ দেখার জন্য কোনও গবেষণা করার প্রয়োজন হয়নি। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন নহি ছোড়েঙ্গে, জুর্ম করনে বালোকো সাজা দেঙ্গে। তাঁর যেটা জুর্ম মনে হয়েছে, তিনি যাঁকে মাফিয়া মনে করেছেন, তাঁর গুলিবিদ্ধ শরীর পাওয়া গেছে, মজার কথা হল মানুষ উল্লসিত হয়েছে। মানুষের উল্লাস এই মানুষ মারার কর্মসূচিতে অক্সিজেন জুগিয়েছে। তিনি গর্ব করে বলছেন, জুর্ম মিটা কর রহেঙ্গে, নো টলারেন্স টু ক্রাইম। এই পর্যায়ে এসেই আমরা দেখলাম দীর্ঘদিন এই ব্যবস্থার সাহচর্যে বেড়ে ওঠা বিকাশ দুবের এনকাউন্টার। বিকাশ দুবে পুলিশ বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালাল, ১৩ জন পুলিশ মারা গেলেন, বিকাশ পালাল, তার ভাই, বন্ধুদের একে একে এনকাউন্টারে মারা হল, তারপর বিকাশ ধরা পড়ল মধ্যপ্রদেশে, অন্তত প্রাণে বাঁচতে চেয়েছিল। অন্য রাজ্য থেকে সাংবাদিকদের সামনে তাকে গ্রেফতার করা হল, নিয়ে আসা হবে লখনউ, তার আগে সাংবাদিকদের গাড়ি আটকানো হল। লখনউ ঢোকার আগে নাকি গাড়ি উল্টে গেল, বিকাশ দুবে পালানোর চেষ্টা শুধু করল না, পুলিশের রিভলভার ছিনিয়ে গুলি চালানোর চেষ্ট করল। কারও গায়ে গুলি লাগল না, কিন্তু পুলিশ গুলি চালাল, বিকাশ দুবে ওখানেই মারা গেল। এই শিশুপাঠ্য বিবৃতি পুলিশ দিল, সব্বাই জানল বিকাশ দুবেকে এনকাউন্টার করা হয়েছে, সব্বাই, মিডিয়া, পুলিশ, রাজনৈতিক নেতা, মানুষজন সব্বাই জানে। মজার কথা হল বিকাশ দুবে একজন নটোরিয়াস ক্রিমিনাল, তাই কেউ এই ফেক এনকাউন্টারের বিরুদ্ধে একটা কথাও বললেন না। অর্থাৎ কার্যত দেশের বিচারবিভাগীয় ব্যবস্থাই প্রশ্নের মুখে পড়ল। অপরাধী চিহ্নিত হবে, তার বিচার হবে, তার হয়ে তার উকিল আদালতে দাঁড়াবে, আত্মপক্ষ সমর্থন করার অধিকার থাকবে, বিচারে জেল হলে হবে, ফাঁসি হলে ফাঁসি হবে। কিন্তু এ তো উকিল আদালত, বিচার, বিচারকের অস্তিত্বই মানতে রাজি নয়, অপরাধী কে বলল? প্রশাসন, সরকার। তাকে ধরল কে? প্রশাসন সরকার। তারপর গুলি করে মারল কে? সেটাও ওই প্রশাসন সরকার। 

আরও পড়ুন: Fourth Pillar | কিম করনিয়ম? কী করিতে হইবে?   

তার মানে হল সরকারে থাকা কোনও দলের নেতা যদি বলেন, আপনি অপরাধী, তাহলে তাকে গুলি করে মারার অধিকারও তার থাকবে? চলুন মাত্র ক’দিন আগে ঘটে যাওয়া আতিক আশরফ ঘটনার দিকে নজর রাখি। মাসখানেক আগে প্রকাশ্য দিবালোকে এক আইনজীবী, উমেশ পাল, যাঁকে পুলিশ সিকিউরিটি দেওয়া হয়েছিল, তাঁকে খুন করল কিছু দুষ্কৃতী, এই এলাহাবাদেই। সেদিনই মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ যোগী বলেছিলেন ঠোক দো, কেউ বাঁচবে না। জুর্ম কা সাজা জরুর মিলে গা। সেই ঘটনায় যাদের নাম সামনে এসেছিল তাদের মধ্যে ৬ জন আজ বেঁচে নেই, ঘটনার পর থেকে তাদের এনকাউন্টার করা হয়েছে, আর আতিক আহমদ বা তার ভাই আশরফকে তো প্রকাশ্যেই গুলি করে মারা হল। আতিক আহমদের ছেলেকে পাওয়া গেল নিহত অবস্থায়, পুলিশ জানাল, তাদের ধরতে গেলে তারা গুলি চালায়, পুলিশ গুলি চালালে তারা মারা যায়। খুব সরল আর সোজা বয়ান। ওই ঘটনায় যে গাড়ি চালাচ্ছিল, আরবাজ, প্রয়াগ রাজে এনকাউন্টারে মারা যায়, উসমান বলে একজন সেই একই ভাবে এনকাউন্টারে মারা যায় ৬ মার্চে। এপ্রিল ১৩-তে এনকাউন্টারে মারা হল আতিক আহমদের ছেলে আসাদ আর তার সঙ্গী গুলামকে, ঝাঁসিতে। এরা প্রত্যেকেই ওই উমেশ পাল হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত ছিলেন। এই ঘটনার মাস্টারমাইন্ড নাকি আতিক আহমদ এবং তাঁর ভাই আসরফ আহমদ। 

কে এই আতিক আহমদ? এই প্রয়াগরাজেরই একজন কোট আনকোট বাহুবলী। যিনি ফুলপুর থেকে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন। কোন ফুলপুর? যে ফুলপুর থেকে নেহরু তিনবার নির্বাচন লড়েছিলেন, জিতেছিলেন, এরপর সেখান থেকে বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত জিতেছিলেন। তারপর সোশ্যালিস্ট নেতা জনেশ্বর মিশ্র, এরপরে ভি পি সিং জিতেছিলেন এই ফুলপুর থেকে। ফুলপুরের একবারের সাংসদ ছিলেন কমলা বহুগুণা, হেমবতীনন্দন বহুগুণার স্ত্রী। সেই বিখ্যাত আসনে এই আতিক আহমদ সাংসদ হয়েছিলেন। তার আগে তিনি পাঁচবার এলাহাবাদ পূর্বের বিধায়কও ছিলেন। তিনি যখন সাংসদ হন, তখন এলাহাবাদ পূর্বে আসনে নির্বাচনে নামেন আতিক আহমদের ভাই আশরফ আহমদ। সেই সময় তার বিরুদ্ধে দাঁড়ায় বিএসপির হয়ে রাজু পাল নামে একজন, তিনিও ওই বাহুবলী গোত্রেরই ছিলেন। জিতেও যান। তাঁকে হত্যা করার চক্রান্ত চলতে থাকে। একবার নয়, দুবার নয় তিনবার আক্রমণ হয়, তিনবারের বার তিনি মারা যান। সেই হত্যার মামলায় অভিযুক্ত ছিলেন আতিক আহমদ এবং তাঁর ভাই আশরফ। নিয়ে চলে যাওয়া হয়েছিল গুজরাতের এক জেলে, কিন্তু সেখান থেকেই তিনি নাকি এই মামলার সাক্ষী এবং উকিল উমেশ পালকে খুন করার পরিকল্পনা করেন। কাজেই তাঁকে নিয়ে আসা হয় উত্তরপ্রদেশে, প্রয়াগরাজে মানে এলাহাবাদে। তিনি এবং তাঁর ভাই দুজনেই বার বার বলেন যে তাদের মেরে ফেলার চক্রান্ত চলছে, জেলের মধ্যেই তাঁদের মেরে ফেলা হবে এরকম কথাও তাঁরা বলেছিলেন। হাইকোর্টে তাঁরা আবেদনও করেন, হাইকোর্ট ওনাদের সুরক্ষার বিষয়ে নজরও দিতে বলে, তারপরে আতিকের ছেলেকে এনকাউন্টারে মারা হয়। তার দু’দিন পরে কেন জানা নেই রাত দশটার সময়ে আতিক এবং আশরফকে মেডিক্যাল টেস্ট করানোর জন্য হাসপাতালে নিয়ে আসা হচ্ছিল। কেন জানা নেই সেই রাত দশটাতেও বেশ কিছু সাংবাদিক এই খবর পান, তাঁদের ভিড় জমা হয়, তাঁরা আতিক আশরফের সঙ্গে কথাও বলতে থাকেন, হঠাৎ তিনজন আতিক আর আশরফকে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলি করেন। আতিক, আশরফ দুজনেই ঘটনাস্থলেই মারা যান, হত্যাকারীরা জয় শ্রীরাম জয় শ্রীরাম বলে। 

খুব স্বাভাবিক যে প্রশ্নগুলো উঠেছে তা হল, একজন প্রাক্তন সাংসদ, পুলিশের প্রহরার মধ্যে থাকার পরেও কীভাবে তাঁকে হত্যা করা হল? দুই, হত্যাকারীরা হত্যা করার পরে পালাল না বরং জয় শ্রী রাম বলে স্লোগান দিতে থাকল, তাহলে কি এটা একটা পলিটিক্যাল মার্ডার? তিন, হত্যাকারীদের ৫ লক্ষ টাকার টার্কিস জিগানা পিস্তল কেনার খরচ কে বা কারা জোগাল? চার, আগের দিন মেডিক্যাল টেস্ট হওয়ার পরেও পরের দিন আবার মেডিক্যাল টেস্ট কেন দরকার হল? পাঁচ, কেন রাত দশটায় এই মেডিক্যাল টেস্টের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। ছয়, পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে হাই প্রোফাইল বন্দিদের খুন করা হচ্ছে, পুলিশের তরফে একটা গুলিও চলল না কেন? সাত, আতিক আহমদ এবং তাঁর ভাই হাইকোর্টের কাছে তাঁদের হত্যা করার চক্রান্ত চলছে বলে জানিয়েছিলেন, তার প্রেক্ষিতে কোনও ব্যবস্থাই কেন নেওয়া হয়নি? এরকম আরও বহু উঠতে থাকা প্রশ্নের সম্ভাব্য জবাব হল ঠান্ডা মাথায় আতিক এবং আশরফকে খুন করাল যোগী প্রশাসন। ওই যে বলেছিলেন ঠোক দো, দিলেন। আপনার মনে হতেই পারে এরা তো ছিল মাফিয়া, বাহুবলী, মুসলমান, কিন্তু এরপর কোনওদিন আপনিও ওই প্রশাসনের মুখোমুখি হতেই পারেন, সেদিন? সেদিন কি পুলিশ প্রশাসন নিয়ম মেনে কাজ করবে? হলফ করে বলতে পারি না, করবে না, এবং সেদিন আপনার পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য একটা মানুষকেও খুঁজে পাবেন না, নিশ্চিত। কাজেই এই অমানবিক, অগণতান্ত্রিক ফেক এনকাউন্টারের বিরোধিতা করুন। মোদি–শাহ–যোগী আমাদের এক মধ্যযুগে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছেন, আমরা তা হতে দিতে পারি না।

RELATED ARTICLES

Most Popular