মুচিপাড়ার পরে বিধাননগরের পোলেনহাটে পিটিয়ে মারা হল দুজনকে, তার আগে বারাসত থেকে ছেলেধরা বলে গণধোলাইয়ের খবর এসেছে এবং খবর এসেছে চোপড়া থেকে। সেখানে এক জেসিবি, তার আসল নাম নাকি তাজিবুল হক, তিনি পারিবারিক সম্পর্ক ইত্যাদির বিচার করছেন প্রকাশ্যে দুই পুরুষ ও মহিলাকে বেঁধে বেত দিয়ে পিটিয়ে, চারিদিকে মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, তিনি পেটাচ্ছেন। ইনি নাকি এলাকাতে তৃণমূলের নেতা। ভিডিও সামনে এসেছে। তৃণমূল সর্বোচ্চ নেতৃত্ব দায় ঝেড়ে দিয়েছেন, জানিয়েই দিয়েছেন এই জেসিবি তাদের কেউ নয় আর এমএলএ আরও এক কাঠি সরেস, হামিদুল রহমান, চোপরার এমএলএ। জানিয়েছেন, মুসলিম রাষ্ট্রের নিয়ম কানুন তো আলাদা, এখানে সেটাই নাকি একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে, ওনারা এলাকার মানুষকে নাকি বুঝিয়েছেন ইত্যাদি। আসলে কোথাও এই ভাল্লুক, উল্লুক, জেসিবি, ট্রাক্টরেরা খুঁটির জোর ছাড়া নড়ে না, পিছনে খুঁটির জোর আছে বলেই না ওরকম প্রকাশ্যে দুজনকে বেঁধে অমন নৃশংসভাবে মারধর করতে পারে। করেওছে, মারতে মারতে যখন ক্লান্ত, যখন ছেলে ও মেয়েটি প্রায় নির্জীব, তখন এলাকার কয়েকজন এসে ওই জেসিবিকে সরিয়ে নিয়ে গেছে। এই হিংসা কোথা থেকে উঠে আসছে? একটা মোবাইলের চেয়ে একটা মানুষের দম কবে থেকে এতটা কমে গেল যে তা না পেয়ে একটা জ্যান্ত মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলতে হবে? এবং এসব তো শোনা যেত ইউপি, এমপিতে, বাংলাতে কবে থেকে এই সংস্কৃতির চারাগাছ কীভাবে বেড়ে উঠল? সেটাই বিষয় আজকে, পিটিয়ে মারা থেকে চোপড়া, আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে প্রশ্ন তো উঠবেই।
একটা মোবাইল পাওয়া যাচ্ছে না, কিছু মানুষ দেখিয়ে দিল একজনকে, তারপর কয়েকজন মানুষ মিলে পিটিয়ে পিটিয়ে সেই মানুষটাকে মেরে ফেলল। এ কি এক সাধারণ মানুষের পক্ষে করা সম্ভব? রটে গেল ছেলেধরা বেরিয়েছে, তারপরে একজনকে চিহ্নিত করা হল এবং তাকে পেটানো শুরু হয়ে গেল, গণধোলাই। একটা নয়, বেশ কয়েকটা ঘটনা। এবং অন্যদিকের ঘটনা চোপড়াতে, এক মুসলমান অধ্যুষিত এলাকাতে, এক মহিলা তাঁর স্বামীকে ছেড়ে অন্য আরেক পুরুষের সঙ্গে গ্রাম ছেড়ে চলে যায়, কিছুদিন পরে তারা ফিরে এসে জানায় যে তারা বিয়ে করেছে।
আরও পড়ুন: Aajke | কংগ্রেস-তৃণমূল জোট ভাঙলে কাদের সবচেয়ে বেশি আনন্দ?
এলাকার তৃণমূল নেতা তাজিবুল হক সালিশি সভায় ২ লক্ষ টাকা জরিমানা দিতে হবে বলে জানিয়ে দেয়। তারা দিতে পারেনি, অতএব তাদের বাইরে বের করে এনে বাঁধা হয়, তারপর তিনি নিজেই তাদেরকে মারতে থাকেন, ঘটনার ভিডিও করা হচ্ছিল, তাতেও তাঁর কোনও আপত্তি ছিল না। ছেলে মেয়েটি প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে, এই সময়ে গ্রামের কয়েকজন এসে ওই তাজিবুলকে সরিয়ে নিয়ে যান। তা না হলে এদিন জোড়া মৃত্যু ছিল অবধারিত। এলাকাতে তিনিই নেতা, তিনিই অভিযোগ শুনবেন, তিনিই বিচার করবেন এবং তিনিই শাস্তি নিজের হাতেই দেবেন। আসলে সমাজে হিংসা তো আছেই, কিন্তু সমাজে নিয়ম কানুনও আছে, দেশের নিয়ম কানুনও আছে, মানুষ সেগুলো মেনে চলে বলেই মোবাইল চুরি হল আর পিটিয়ে মার সেরকমটা হয় না। কিন্তু সংখ্যা বাড়ছে, বিপজ্জনকভাবেই বাড়ছে। মূলত দুটো কারণে। প্রথমটা হল আইন বিচার ব্যবস্থা পুলিশ ইত্যাদির ভূমিকা, মানুষ মনেই করে না যে পুলিশের কাছে গেলে পুলিশ বিচার করবে, পুলিশ গ্রেফতার করবে, অপরাধী শাস্তি পাবে। কাজেই সাধারণ মানুষের কোনও বিশ্বাসই নেই এসবের উপরে। সামান্য সুযোগ পেলেই তাঁরা নিজেদের হাতে আইন তুলে নিচ্ছেন। দু’ নম্বর কারণ হল রাজনৈতিক দাদাগিরি, শাসকদলে থাকার সুবাদেই কিছু মানুষ নিজেকে খাঞ্জা খাঁ মনে করছেন, এলাকার পুলিশ প্রশাসনও সেটাই মনে করাচ্ছে, তারা এসে থানায় বসলে আপ্যায়ন করে চা-বিস্কুট কোল্ড ড্রিঙ্কস খাওয়ানো হচ্ছে, তাদের নামে অভিযোগ এলে শোনা তো হচ্ছেই না, উল্টে সে খবর তারা পেয়ে যাচ্ছে, কাজেই এলাকায় এলাকায় তৈরি হচ্ছে নব্য খাঞ্জা খাঁ, তারাই রক্ষক, তারাই ভক্ষক। তাদের দেখলেই চেনা যাবে, এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এরা শাসকদলের ঘনিষ্ঠ, না হলে আর এসব হবেই বা কী করে? আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, শাসকদলের প্রশ্রয় ছাড়াই কি এই জেসিবি, তাজিবুল হকদের জন্ম হতে পারে? তাদের জন্যই কি শাসকদলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় না? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
একে তো এই তাজিবুলের ঘটনা, তাঁর দাদাগিরি, আইন নিজের হাতে নেওয়া, তার উপরে আরও জঘন্য ব্যাপার হল সেখানকার এমএলএ হামিদুল রহমানের বক্তব্য, এই নেতারাই মুসলমান সমাজকে আরও পিছিয়ে নিয়ে গিয়ে এক অন্ধকারে ফেলে রাখতে চান। নিজেরা মধ্যযুগে বাস করেন, মধ্যযুগীয় চিন্তাভাবনা নিয়ে বাঁচেন আর সেটাকেই লাগু করার চেষ্টা করেন, দেশের আইন সংবিধান ইত্যাদি নিয়ে যখন এত কথা চলছে তখন উনি পড়ে আছেন শরিয়তের জগতে, এও সত্যিই লজ্জাজনক।