এন্টায়ার সায়েন্স পড়ে ফেলার পড়ে, পুকুর থেকে খালি হাতেই কুমির ধরার পরে, কল্পনার স্টেশনে কাপের পর কাপ চা বিক্রি করার পরেও আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী অলিম্পিক্স মেডেলের মানে বুঝে উঠতে পারেননি। তাই তিনি যখন সাধু পরিবৃত হয়ে মাথায় ছাই মেখে সংসদে বসে, ঠিক তখনই দিল্লি পুলিশ পেটাচ্ছে কাদের? যাঁরা দেশের জন্য অলিম্পিক্স মেডেল এনেছেন। এবং ঠিক সেই সময়ে উজ্জয়িনীর মহাকাল মন্দিরে ক্রেনে করে তোলা হচ্ছে সপ্ত ঋষির ছ’জনকে, কারণ ৩০-৪০ কিলোমিটার বেগে ঝড়ের সামনে সেসব মূর্তি ছিটকে পড়েছে, ভেঙে গিয়েছে। বিরাট খরচ করে এই মূর্তি, এই বিরাট মহাকাল মন্দির গত বছরে ১১ অক্টোবর আমাদের হিন্দু হৃদয় সম্রাট উদ্বোধন করেছিলেন, মাথায় চন্দন লেপে ভব্য, দিব্য আর অলৌকিক এই মন্দির প্রাঙ্গণে তাঁর অনুভূতির কথা জানিয়েছিলেন, সেই দেশের প্রধানমন্ত্রী যে দেশে অলৌকিকতা নিয়ে কুসংস্কার বিরোধী আইন আছে, অলৌকিকতার গুলগল্প ছড়ালে জেলে পোরার ব্যবস্থাও আছে। সে থাক, আরএসএস–বিজেপি, মোদি–শাহ কবে আর আইন কানুনকে তোয়াক্কা করেছেন। তিনি উদ্বোধন করার আগেই মধ্যপ্রদেশের এক কংগ্রেস বিধায়ক অভিযোগ করেছিলেন যে এই মহাকাল মন্দির নির্মাণে বিরাট দুর্নীতি হয়েছে, লোকায়ুক্তে অভিযোগও দায়ের করেছিলেন। সেটার পরেই মুখ্যমন্ত্রী পয়লা মার্চ ২০২২-এ মহাকাল মন্দিরের কাজ দেখতে আসেন, সন্তুষ্ট হয়ে ফিরে যান। ২৭ মে আবহাওয়া দফতর বলছে ৪০-৪৫ কিলোমিটার বেগে ঝড়ের সামনে কোটি কোটি টাকা খরচ করার পরে তৈরি মূর্তি ভেঙে চুরমার। কন্ট্রাক্টের দায়িত্ব পেয়েছিল গুজরাতের, হ্যাঁ, গুজরাতের মেসার্স এম পি বাবারিয়া ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যান্ড সিভিল কন্ট্রাক্টর। মধ্যপ্রদেশের মন্দির, বরাত পেল গুজরাতের কোম্পানি, ১০০ বছরের গ্যারান্টি দেওয়া হয়েছিল, ছ’ মাসে ভেঙে পড়ল। আচ্ছা এই ঘটনাটা যদি আমাদের বাংলায় হত, উফফফ হুক্কা হুয়ার চোটে টেকা দায় হয়ে যেত। দুর্নীতি, হিন্দু দেবতা ঋষিদের অপমান, মুসলিম তোষণ নিয়ে এমনকী দিল্লিতেও রিপাবলিক টিভির অনুষ্ঠান হত। এরাজ্যে তেনাদের ছানাপোনারা চোখে চোখ রেখে মোদিজির প্রচারে নেমে পড়তেন। কিন্তু হয়েছে মধ্যপ্রদেশে, সরকার বিজেপির, তাই জাতীয় টিভি চ্যানেল, যাদের ডাক নাম গোদি মিডিয়া, তারা এ খবর দেখানোর প্রয়োজনও মনে করেনি, এমনকী ঠাকুর দেবতা, মহাকাল, সপ্ত ঋষি ভাঙিয়েও পকেটে টাকা আসছে, সেকথা মানুষকে জানায়নি।
এই মহাকাল মন্দিরে মঙ্গলবার থেকে শুক্রবার এই চারদিন দুপুর ১২টা থেকে ৪টে ফ্রি এন্ট্রি, বাকি দিনগুলোতে ভগবান দেখতে ৭৫০ টাকা লাগবে, আর ওই ছাই বা ভস্ম পেতে হলে আগে থেকে অনলাইনে ২০০ টাকার টিকিট কাটতে হবে। ছাইয়ের এমন আকাল। তো মহাকাল মন্দিরে বশিষ্ঠ, মরীচি, পুলস্ত্য, পুলহ, অত্রি, অঙ্গিরা আর ক্রতু ঋষিরা যখন মাটিতে পড়ে আছেন, সেই সময়ে দিল্লির রাস্তায় পড়ে আছেন খেলোয়াড়েরা, যাঁরা দেশকে এনে দিয়েছেন সোনা, রুপো, ব্রোঞ্জ মেডেল, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা থেকে, অলিম্পিক্স থেকে। কেন পড়ে আছেন? কারণ খেলোয়াড়েরা অভিযোগ করেছেন কুস্তিগির অ্যাসোসিয়েশনের ভারপ্রাপ্ত পাঁচবারের বিজেপি সাংসদ যৌন নির্যাতন করেন, তাঁকে ওই পদ থেকে সরানো হোক। খুব সাধারণ দাবি, একজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, পকসো ধারায় এফআইআর হয়েছে, তাঁকে গ্রেফতার করে ঘটনার তদন্ত হোক, আর অবশ্যই তাঁকে ওই পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হোক, যে পদকে ব্যবহার করে তিনি এই যৌন নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ৩৫ দিন ধরে লাগাতার ধরনায় বসেছিলেন কুস্তিগিরেরা, অলিম্পিয়াডরা, খেলোয়াড়েরা। ২৮ মে বিকেলে তাঁদের টেনেহিঁচড়ে যন্তরমন্তরের ধরনাস্থল থেকে নিয়ে হাজতে পোরা হল, তাঁদের দাঙ্গা লাগানোর, উসকানি দেওয়ার আইনি ধারায় অভিযুক্ত করা হল, যাতে সাত বছর পর্যন্ত কারাবাসও হতে পারে। ওধারে বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও-এর বাওয়াল দেওয়া এক কুসংস্কারাচ্ছন্ন, সাম্প্রদায়িক প্রধানমন্ত্রী এক বিশ্বাসঘাতক, গান্ধীহত্যার ষড়যন্ত্রকারীদের মাথা সাভারকরের জন্মদিনে দেশের নতুন সংসদ ভবনে সাধুসন্ত পরিবৃত হয়ে রাজদণ্ড হাতে নিয়ে প্রবেশ করছেন। যে সংসদে বসে হাততালি বাজাচ্ছেন এক যৌন নির্যাতনে অভিযুক্ত ব্রিজভূষণ শরণ সিং। এখানে দুটো জিনিস তো পরিষ্কার যে মেঘের তলা দিয়ে প্লেন গেলে রাডারে ধরা পড়ে না এই তথ্য যাঁর উর্বর মাথা থেকে বের হয়েছে, তিনি আর যাই হোক অলিম্পিক্স কাকে বলে, অলিম্পিক্স মেডেলের গুরুত্ব ইত্যাদি সম্পর্কে কোনও খবরই রাখেন না। আর দ্বিতীয় কথা হল, নিশ্চয়ই আপনাদের জানতে ইচ্ছে করছে যে, কে এই ব্রিজভূষণ শরণ সিং, এক রেসলিং ফেডারেশনের কর্তার এমন কী ক্ষমতা যার জন্য দেশের অলিম্পিয়াডদের যৌন নির্যাতনের অভিযোগ আসার পরেও তাঁকে তাঁর পদ থেকে সরানো যাচ্ছে না, তাকে গ্রেফতার করা যাচ্ছে না? কে ইনি?
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | মোদিজির স্ত্রী অনুপস্থিত কেন?
প্রথমটা দেশের চাওয়ালা কাম চৌকিদারের জন্য বলা, আপনারাও শুনে নিন। অলিম্পিক্স মেডেল আমাদের দেশে কেন গুরুত্বপূর্ণ? অলিম্পিক্স হল খেলার জগতের সবথেকে বড় সম্মান, যেমন সিনেমায় অস্কার, মিউজিকে গ্র্যামি, সাহিত্যে, বিজ্ঞানে নোবেল। তো এই অলিম্পিক্সে আমাদের সাফল্য কেমন? আমাদের দেশ ১৯০০ থেকে ১৯৫১ পর্যন্ত দুটো সিলভার মেডেল আর একটা ব্রোঞ্জ মেডেল পেয়েছিল। কলকাতায় জন্মানো এক ব্রিটিশ নরম্যান রিচার্ড পেয়েছিলেন দুটো সিলভার আর হকি পেয়েছিল ব্রোঞ্জ। ৫২ সালে কে ডি যাদব, না যাদব শুনেই বিহার বা ইউপি ভাববেন না, উনি ছিলেন মহারাষ্ট্রের, তিনি ৫২তে কুস্তিতে ব্রোঞ্জ পেয়েছিলেন। ৪৭ থেকে আজ পর্যন্ত আমাদের দেশে এসেছে ৩০টা, হ্যাঁ, মাত্র ৩০টা মেডেল। তার বেশিরভাগটাই হকি থেকে, হকি থেকে ৯টা, একটাই সোনা, সেও আবার মস্কো অলিম্পিক্সে যেখানে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া এমনকী পাকিস্তানও অংশগ্রহণ করেনি, তাতে গুরুত্ব কমে যায় তাও নয় কিন্তু সবাই থাকলে কী হত সেই প্রশ্নও তো ওঠে। আর কুস্তি থেকে এসেছে ৭টা পদক, বক্সিং থেকে ৩টে, জ্যাভলিন থেকে একটা সোনা, ভারোত্তোলন থেকে ২টো মেডেল, শুটিং থেকে ৪, ব্যাডমিন্টন থেকে ৩ আর টেনিস থেকে লিয়েন্ডার পেজের জয় করে আনা মেডেল। হয়ে গেল ৩০। কত বড় এই জয়? হ্যাঁ ক্রিকেটে, কিছুটা হলেও ফুটবলে গ্ল্যামার আছে, স্পনসর আছে, টাকা আছে, ফ্যান ফলোয়ার আছে। রান্না করে বাচ্চা সামলে মেরি কমের মেডেল আনা, বজরং পুনিয়া বা সাক্ষী মালিকের মেডেল আনার সঙ্গে তার তুলনাও করা যায়? ক’টা দেশ ক্রিকেট খেলে? কতগুলো দেশ কুস্তিতে নেমেছিল? বক্সিংয়ে? ক্রিকেট খেলে কোটি কোটি টাকা কামিয়ে, স্পনসর নিয়ে, ধারাবিবরণী দিয়ে, ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হয়ে প্রচুর রোজগার করার পরে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের মনে হতেই পারে যে দিল্লির রাস্তায় পলিটিক্স হচ্ছে, কিন্তু দেশের গ্রামীণ এলাকা থেকে আসা এই খেলোয়াড়েরা কি এতটুকু মর্যাদাও পেতে পারেন না? তাঁদের কথা শোনারও প্রয়োজন নেই? তাঁদের রাস্তায় ফেলে পেটাতে হবে? এক রিটায়ার্ড এসপি, আস্থানা বলেছেন, প্রয়োজনে বুলেট ব্যবহার করে এই খেলোয়াড়দের আন্দোলন বন্ধ করতে হবে। এই আস্থানাকে অলিম্পিক্স ভিলেজেও ঢুকতে দেওয়া হবে না, তিনি কেবল তেল লাগানোর জন্য এ ধরনের ভাষা প্রয়োগ করছেন।
কত বড় ক্ষমতাবান এই মানুষটা? এই ব্রিজভূষণ শরণ সিং কত ক্ষমতা ধরেন? কতটা ক্ষমতা থাকলে একজন পকসোতে অভিযুক্ত বলতে পারে, এই আইনটাকেই বদলে দেব। নাকি এনার জানা আছে এমন কিছু যা বলে দিলে মুখ পুড়বে মোদি-শাহের? কে ইনি? ছ’ বারের সাংসদ, সাতবারের হতেন, একবার জেলে ছিলেন বলেই নিজের স্ত্রীকে জিতিয়ে এনেছিলেন। একবারের সমাজবাদী দলের সাংসদ, পাঁচবারের বিজেপির সাংসদ। পথচলা শুরু বাবরি মসজিদ ভাঙার সময়ে। তখন ইনি করসেবক ছিলেন, গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিলেন। তিনি টাডাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন, কেন? কারণ তিনি নাকি দাউদের শার্প শুটারদের আশ্রয় দিয়েছিলেন। কিছুদিন আগে লল্লনটপ বলে এক ওয়েব পোর্টালকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলে, “মেরে জীবন মে মেরে হাতো সে এক হত্যা হুই হ্যায়, লোগ কুছ ভি কহে, ম্যায়নে এক হত্যা কি হ্যায়।” মানে নিজেই বলছেন লোকে যাই বলুক না কেন আমি মাত্র একটাই হত্যা করেছি। আসলে ওনার বিরুদ্ধে অসংখ্য হত্যার মামলা আছে, ছিল। উনি তার জবাবে জানিয়েছেন যে, না তিনি মাত্র একটাই হত্যা করেছেন। সেই তিনি উত্তরপ্রদেশের গোন্ডা থেকে বিজেপির নির্বাচিত সাংসদ। একবারই বিজেপি একে দল থেকে তাড়িয়েছিল, না হত্যা, ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন ইত্যাদির অভিযোগে নয়, ওনাকে তাড়ানো হয়েছিল কারণ উনি ইউপিএ ওয়ানের শেষে যখন নিউক্লিয়ার ডিল বিতর্কের সময় আস্থা ভোট হয়, সেই সময় কংগ্রেসকে সমর্থন করেছিলেন। তারপর বিজেপির সঙ্গে বিবাদ মিটে যায়, এখন অনেকেই বলে যে কেবল গোন্ডাই নয় পাশাপাশি ৬-৭ টা আসনে তিনি অত্যন্ত প্রভাবশালী, আর সবাই জানে ভোটে জেতার জন্য যৌন নির্যাতন বিজেপির কাছে কোনও ইস্যুই নয়, ওসব বেটি পড়াও তো পোস্টারের জন্য, বেটিরা পড়ে আছে রাজপথে। এই বাহুবলী ক’দিন আগেই জানিয়েছেন, ৫ জুন তিনি অযোধ্যায় ১১ লক্ষ সাধুদের নিয়ে মিছিল করবেন। যদি সত্যিই করেন, তাহলে বোঝা যাবে যে দেশের সাধুসন্তরা এক যৌন নির্যাতনকারীর পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। কেবল কল্পনা করুন সেই দৃশ্যটা, অলিম্পিক্সের আসরে বাজছে দেশের জাতীয় সঙ্গীত, বাজছে জনগণমন অধিনায়ক জয় হে, ত্রিবর্ণ পতাকা উড়ছে, সাক্ষী মালিক বা বজরং পুনিয়ার চোখে আনন্দের জল, আমরা টিভিতে দেখছি, মেডেলের সংখ্যা বাড়ছে। ফেক ডিগ্রি নিয়ে মেকি এক দেশপ্রেমিকের কাছে এর কোনও মূল্য নেই আমরা জানি, আমরা জানি যারা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ব্রিটিশদের সঙ্গে ছিল, যারা দেশের রাষ্ট্রপিতাকে হত্যা করেছে তাদের কাছে ওই পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত আর মেডেলের কোনও দাম নেই, কিন্তু আপনাদের? আপনাদের কি এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে এখনই প্রতিবাদ করাটা প্রয়োজনীয় নয়? প্রতিবাদ করুন, দেশের গৌরব এই খেলোয়াড়দের সঙ্গে থাকুন।