বাংলায় কংগ্রেস বাম ঐক্য নিয়ে বহু প্রশ্ন তো ছিলই, একসময়ের চরম প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দল যখন এক মঞ্চে এল তখন দলের লোকজনেরাই অবাক হয়েছিলেন, মেনে নিতে পারেননি অনেকে। দু’ দলেরই একটা বড় অংশ মনে করে এই জোট অনৈতিক, এই জোট দলের পক্ষে ক্ষতিকর। কিন্তু জোট হয়েছে এটাও তো বাস্তব। ওদিকে তৃণমূল কংগ্রেস আর কংগ্রেসের জোট তো অত্যন্ত স্বাভাবিক, কিন্তু ইদানিং অধীর কংগ্রেসের জমানায় তা এক অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবং এসবের মধ্যেই বিরোধী ঐক্যের বৈঠক, পাটনায় বরফ জমেওনি, গলেওনি। কিন্তু বেঙ্গালুরুতে বরফ গলে উষ্ণ জল। রাহুল গান্ধী বাদাম খাওয়াচ্ছেন মমতাকে, ভাবা যায়! সেই বাদাম খাবার কথা সামনে আসতেই অধীর চৌধুরীর রাজনৈতিক ভবিষ্যতে গ্যামাক্সিন। এটা বলাই যায় যে বাংলায় সিপিএম তৃণমূল কংগ্রেস জোট হবে না, কিন্তু হাইকম্যান্ডের চাপে কং তৃণমূল জোট হওয়া সম্ভব, সেক্ষেত্রে কং বাম জোটের দফারফা হবেই। সেটাই প্রশ্ন, সেটাই আমাদের বিষয় আজকে, কংগ্রেস বাম ঐক্য থাকবে?
হাঁস ছিল, সজারু, (ব্যাকরণ মানি না)
হয়ে গেল ‘হাঁসজারু’ কেমনে তা জানি না।
বক কহে কচ্ছপে – “বাহবা কি ফুর্তি !
অতি খাসা আমাদের বকচ্ছপ মূর্তি ।”
সুকুমার রায়, আমরা সব্বাই পড়েছি আর ভাবার চেষ্টা করেছি সেই বকচ্ছপ মূর্তির কথা। তেমন এক মূর্তি হল এই কংগ্রেস বাম ঐক্য। বাম মানে ওই সিপিএমকে নিয়েই চলা যাক, কারণ বাকিরা তো নোটার চেয়েও কম ভোট পেয়ে স্মৃতি তুই বেদনা হয়ে গিয়েছে। তো সিপিএম, তাদের এক প্রকাণ্ড কর্মসূচি আছে, তাহাই আসল লক্ষ্য, আর আসল সেই লক্ষ পাওয়ার জন্য কত শত কৌশল। তাহলে দাঁড়াল কী? নীতিগত এক লক্ষ্য আছে, কিন্তু তা অর্জন করার জন্য কৌশলের অবকাশও আছে। ধরুন সিপিএম-এর পার্টি প্রোগ্রামে দল শেষমেশ তো সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থা চায়, তা নাকি আবার ঝপ করে আসবে না, তাই আমাদের দেশের মাটি পরীক্ষা করে তাঁদের নিদান তাঁরা জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব করবেন। একচেটিয়া পুঁজিপতিদের দূর করে দিয়ে, তাদের কারখানা, শিল্প, সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে এক্কেবারে কারখানার লেবার বানিয়ে দেবেন, তুমিও কাজ করো মাইনে নাও। আচ্ছা একথা গোপনে নয়, মাত্র ১০ টাকা, ২০ টাকা খরচ করলেই এই প্রোগ্রামটা পাওয়া যায়, তো টাটাবাবু বিড়লাবাবু, অধুনা আম্বানি, আদানিরা নিশ্চই সেই চটি বইটি পড়েছেন এবং বিলক্ষণ জানেন যে তাঁহাদের উৎখাত করা হইবে। কিন্তু সেই টাটাবাবুর সঙ্গে সিপিএম মুখ্যমন্ত্রীর চুক্তি হল, তিনি বাংলায় এলেন মোটর কারখানা করতে, কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে, যদিও তিনি জানেন যে ওই জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের পরেই এই কারখানার মালিকানা আর ওনার হাতে থাকবেই না। নাকি উনি ভালো করেই জানেন যে ওসব হল সিপিএম-এর বাওয়াল, যা ওনারা নিজেরাই বিশ্বাস করেন না, লেখার হয় লিখেছেন।
আরও পড়ুন: Aajke | মণিপুর, কুমির কাঁদে, লকেট কাঁদে
ঠিক সেইরকমই ওই পার্টি প্রোগ্রামে লেখা আছে দেশের শত্রু কারা, কাদের সঙ্গে সিপিএম লড়বে, সেখানে ভারি স্পষ্ট করে লেখা আছে যে কংগ্রেস হল এদেশের অবশিষ্ট জমিদার ভূস্বামী, দেশের একচেটিয়া শিল্পপতিদের প্রতিনিধি। এই এদেরকে সরিয়েই, মানে উৎখাত করার জন্যই তাঁরা জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব করবেন, দেওয়ালে এখনও মাঝেমধ্যে লেখেন ওনারা, জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব সফল করুন। মানে কংগ্রেসের নেতারা ২০ টাকা খরচ করেই পড়ে ফেলতে পারেন বা পড়ে ফেলেছেন যে সিপিএম জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব করবে এবং ওনাদের উৎখাত করবে। কিন্তু আপাতত হাত মেলাচ্ছেন, বিজেপিকে সরানোর জন্য, বিজেপি সরে গেলেই কংগ্রেসকে উৎখাত করবে সিপিএম। মজার শোনাচ্ছে না? ফ্যাক্ট চেক করে দেখুন এমনটাই লেখা আছে সিপিএম-এর পার্টি প্রোগ্রামে। নেহরু থেকে গান্ধী বিভিন্ন ধরনের স্যোশালিজমের কথা বলেছেন বটে কিন্তু কমিউনিজম নিয়ে দুজনের বিস্তর সমালোচনা ছিল, তাঁরা ওই দর্শনকে মেনে নেননি। মাত্র ২০১৯-এ নির্বাচনের সময়ে রাহুল গান্ধী কেরলে নির্বাচনী প্রচারের সময়ে বলেছেন, মার্কসবাদ এক মৃত দর্শন, আ ডেড ফিলোজফি। কিন্তু দুই দল এখনও দাবি করে তারা আদর্শ নিয়ে চলে, আদর্শের প্রতি দায়বদ্ধ। ছেড়েই না হয় দিলাম তাদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সেসব লড়াইয়ের কথা, সত্তর দশকে বা তার আগে সাঁইবাড়ি হত্যাকাণ্ড, হাতের পাঞ্জা কেটে নেওয়া, জ্যান্ত কই মাছ খাইয়ে দেওয়ার ইতিহাস তো আমরা জানি। আবার ওই সত্তরেই কংগ্রেসি গুন্ডাদের হাতে বহু কমরেড মারা গেছেন, পাড়া-ছাড়া হয়েছেন বহু পার্টি কর্মী, এ দাবি তো সিপিএম নেতারা করে থাকেন। কংগ্রেসি সরকারের গুলিতে বা কংগ্রেসি গুন্ডার হাতে নিহত কর্মীর শহীদ বেদী বাংলার কোন পাড়ায় নেই? কিন্তু তাদের এ বাংলায় ঐক্য মঞ্চ গড়ে উঠেছে, পলিটিক্স মেকস স্ট্রেঞ্জ বেডফেলোজ, আমরা সবাই জানি। কিন্তু দেশজোড়া বিরোধী ঐক্যের আবহে কংগ্রেসের বেশি দরকার তৃণমূলকে, তাই উপর থেকে চাপ আসছে, এবং প্রশ্ন অধীর বা বাংলা কংগ্রেস কি শেষ পর্যন্ত হাইকম্যান্ডের চাপে তৃণমূলের সঙ্গে ঐক্যে যাবে, সেরকম ঐক্য হলে সিপিএমের সঙ্গে ঐক্যের কী হবে?
সংসদীয় গণতন্ত্রে রাজনৈতিক ঐক্য নির্বাচনকে মাথায় রেখে হয়, তাতে কোনও আদর্শ ইত্যাদির বালাই নেই, থাকার কথাও নয়। একসময়ে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংয়ের সরকারের দুটো পায়া ছিল বিজেপি আর বাম। কংগ্রেস শিবসেনার ঐক্য হয়েছে, রাজনৈতিক ঐক্যের এক ভাঁড় হলেন নীতীশ কুমার, দু’ বার বিজেপির সঙ্গে, তিনবার ডিগবাজি খেয়ে লালুর দলের সঙ্গে, এ রাজ্যে বাম কং জোট। কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেস আর জাতীয় কংগ্রেসের জোট তো আগে হয়েছে, কেবল সেই কারণেই নয়, সোনিয়া থেকে রাহুল জানেন, মমতাকে সঙ্গে রাখার জন্য তাঁকে খুশি করতে হবে। অন্যদিকে সিপিএম বা বাম এই জোটের সঙ্গে থাকতে বাধ্য, সেইজন্যই এ বাংলায় কংগ্রেসের কাছে হাইকমান্ডের আদেশ আসবে, তৃণমূল এবং কংগ্রেসের জোট হবে, সেক্ষেত্রে বাম কংগ্রেসের জোট ভাঙতে বাধ্য।