লকেট চট্টোপাধ্যায় খুব আহামরি অভিনেত্রী ছিলেন না কোনওদিন, কান্নার দৃশ্যে তাঁকে ঘনঘন গ্লিসারিন নিতে হয়েছে এবং লিখিত ডায়ালগের বাইরে তাঁকে কোনওদিনও একটা কথাও বলতে দেখা যায়নি কারণ নিজের থেকে ডায়ালগ তৈরি করার মেধাও তাঁর ছিল না, ডেডিকেটেড, বাধ্য, মিডিওকার অভিনেত্রী। কিন্তু রাজনীতিতে এসে তাঁর কাজকর্ম দেখে এটা পরিষ্কার যে এখন তিনি নিজের মেধা দিয়েই অনেক কথা এক নাগাড়ে বলেন, ভালোই বলেন, এখনও তিনি ডেডিকেটেড, বাধ্য ছাত্রী, বিজেপির ওপর তলা থেকে যা বলে দেওয়া হয়, সেটার মধ্যেই তাঁর বক্তব্যকে ধরে রাখেন। কিন্তু এখন কান্নার জন্য গ্লিসারিন লাগে না, এটা জানা ছিল না, সেদিন ওনার কান্না দেখে প্রমাণ হল, গ্লিসারিন ছাড়াও তিনি কান্না আনতে পারেন, সেই অর্থে তিনি এখন এক পরিপূর্ণ অভিনেত্রী। তিনি কাঁদতে কাঁদতে চোখ লাল করে ফেললেন, তিনি ফোঁপালেন, চোখের জল ফেললেন ক্যামেরার সামনে। ভাবুন একবার, হাওড়া পাঁচলায় এক মহিলাকে বুথের মধ্যে বিবস্ত্র করে হেনস্থা করেছে তৃণমূলের কর্মীরা, উনি সেই খবর পেয়েছেন, এবং আকুল হয়ে কাঁদতে কাঁদতে ওনার মনের দুঃখের কথা সাংবাদিকদের সামনে জানিয়েছেন, এক মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর রাজত্বের এই মর্মান্তিক ঘটনা এই প্রথম লকেট চট্টোপাধ্যায়কে ক্যামেরার সামনে গ্লিসারিন ছাড়াই কাঁদিয়ে ছাড়ল। সেটাই বিষয় আজকে, সেই কান্না নাটকের নেপথ্য কাহিনিই বিষয় আজকে। মণিপুর, লকেট কাঁদছে, কুমির কাঁদছে।
হ্যাঁ, ডিজি দুটো কথা বলেছেন। এক, ওই মহিলা পুলিশের কাছে এসে অভিযোগ জানাচ্ছেন না কেন? দুই, সিসিটিভির ফুটেজে এরকম কোনও হেনস্তার ছবি নেই। ব্যস, তারপর থেকে পাঁচলার এই বিষয় নিয়ে বিজেপির হীরণ্ময় নীরবতা। তাঁরা এখন মালদার ঘটনা নিয়ে বিস্তর অভিযোগ জানাচ্ছেন এবং প্রথম যা খবর পাওয়া যাচ্ছে তাতে ওখানে দুই মহিলাকে সত্যিই হেনস্তা করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, হেনস্তার পরে তাঁদের মিথ্যে মামলা দিয়ে ফাঁসানো হয়েছে, পুলিশ কর্তা বলেছেন তদন্ত চলছে। এক্ষেত্রে প্রশাসনিক গাফিলতি স্পষ্ট। সে ছবিও সংবাদমাধ্যমের কাছে আছে, সোশ্যাল মিডিয়াতেও আছে, যেখানে দুজন মহিলাকে হেনস্তা করা হচ্ছে। তাঁদের বিবস্ত্র করা হয়েছে এমন নয়, নগ্ন করে প্যারেড করানো হয়েছে এমনও নয়, কিন্তু তাঁদের নিগ্রহ করা হয়েছে, যাকে অনায়াসে মলেস্টেশন বলাই যায়। এ নিয়ে অবশ্য লকেট কিছু বলেছেন বলে আমার জানা নেই।
আরও পড়ুন: Aajke | ২১ জুলাই, কী বললেন অভিষেক, মমতা?
কিন্তু এসবের সঙ্গে মণিপুরের তুলনা করা যায়? অত্যন্ত নির্বোধও সেরকম কোনও তুলনা করবেন না, কিন্তু বিজেপির বোধ তো নির্বোধদের চেয়েও কম, তাই মণিপুরের পাল্টা তাঁরা মালদা বা রাজস্থানের কথা বলছেন। মণিপুর যেখানে গত ২ মে থেকে জাতি দাঙ্গা শুরু হয়, মহিলাদের ধর্ষণ করার ৯টা ঘটনা তথ্যপ্রমাণ সমেত জানানো হয়েছে। যে সময় এই ঘটনাগুলো ঘটছে তখন দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কর্নাটকে ভোটের প্রচার করছেন, জয় বজরংবলী বলে চিৎকার করছেন, প্রধানমন্ত্রী বিদেশে যাচ্ছেন, আমেরিকা ব্রিটেন, ফ্রান্সের রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে হেঁ হেঁ করছেন, তাঁদের কোটি কোটি টাকার উপহার দিচ্ছেন, বিদেশ থেকে ফিরে মেরা বুথ মজবুত, দলের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করছেন। এর মধ্যে এখনও পর্যন্ত সরকারি হিসেবে ১৪২ জন মারা গিয়েছেন, যার মধ্যে ৮০ জন আদিবাসী, ৩১০ জন গুরুতর আহত। ৬০ হাজার ঘর ভাঙা হয়েছে, মানুষ ঘর ছেড়ে পালিয়েছেন, ২৫০-র বেশি উপাসনালয় ভাঙা হয়েছে। আগেই বলেছি ৯ জন মহিলাকে ধর্ষণের ঘটনার প্রমাণ এসেছে যার মধ্যে ৩ জন মৃত। দুজনকে নগ্ন করে প্যারেড করানো হয়েছে, সেই ভিডিও তুলে ভাইরাল করানো হয়েছে। একজনের স্বামী কার্গিলে দেশের জন্য লড়েছেন, একজন বৃদ্ধা উপজাতি মহিলাকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছে যাঁর স্বামী ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। সেই ঘটনা নিয়ে লকেট একটা কথাও বলেছেন? এক ফোঁটা চোখের জল ফেলেছেন? কিন্তু পাঁচলা নিয়ে এই কুমির কান্না কাঁদলেন কেন? কারণ তিনি বোঝাতে চান যে ওরকম মণিপুর তো সব রাজ্যেই ঘটে চলেছে, ও আর নতুন কী? কতটা ইনসেনসিটিভ হলে এরকমটা সম্ভব? কতটা ইনসেনসিটিভ হলে এইরকম আচরণ সম্ভব? আমরা প্রশ্ন করেছিলাম আমাদের দর্শকদের, লকেট চট্টোপাধ্যায় মণিপুর নিয়ে প্রতিবাদ করলেন না, কাঁদলেন না, ওনার কান্না ছিল কেবল পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া পাঁচলার ঘটনা নিয়ে, এটা কি কুমিরের কান্না? এটা কি এক অভিনেত্রীর অভিনয়? শুনুন মানুষ প্রশ্নের উত্তরে আমাদের কী জানালেন।
স্বাধীনতার পরে বেশ কিছু জাতি দাঙ্গা হয়েছে, ধর্মের ভিত্তিতেও দাঙ্গা হয়েছে, কিন্তু মণিপুরে যা চলছে তা এক লম্বা সময় ধরে চলতে থাকা স্টেট স্পনসর্ড জাতি দাঙ্গা। বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী মনে করেছিলেন, গুজরাতের মতো এক রাজ্য হবে, সাবজুগেটেড কুকি মিজোকে পায়ের তলাতে রেখে মেইতেদের শাসন। দেখা যাচ্ছে কুকি মিজোরা তা মেনে নেবে না এবং মেইতেদের মধ্যেও এক বিরাট অংশ তা মেনে নেবে না। মোদি–শাহ–বীরেন্দ্র সিংয়ের পরিকল্পনায় এই জাতি দাঙ্গা উত্তর পূর্বাঞ্চলে বিজেপিকে জনবিচ্ছিন্ন করবেই। আর সেই ধ্বংস, সেই হত্যা, ধর্ষণ, নারী অবমাননার ঘটনা থেকে মানুষের চোখ ফিরিয়ে দিতে বিজেপি আর তাদের পোষা মিডিয়া পথে নেমেছে, তারই অংশ লকেট চট্টোপাধ্যায়ের কুমিরের কান্না। কিন্তু সমস্যা হল বাংলার মানুষ কুমিরের কান্না চেনে, কুমিরের কান্না বোঝে।