নয়াদিল্লি: ‘না, উনি আমাকে প্রধানমন্ত্রী করবেন না।’ মেয়ের প্রশ্নের জবাবে সোনিয়া গান্ধী (Sonia Gandhi) প্রসঙ্গে ঠিক এই কথাই জানিয়েছিলেন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি তথা দেশের কিংবদন্তি রাজনীতিক প্রণব মুখোপাধ্যায় (Pranab Mukherjee)। ২০০৪ সালে বিপুল ভোটে জিতে কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর দেশ তাকিয়ে ছিল তৎকালীন দলনেত্রী সোনিয়া গান্ধীর মুখের দিকে। কংগ্রেসের তাবড় নেতারা এবং অগণিত সমর্থক চাইছিলেন সোনিয়া প্রধানমন্ত্রী পদে বসুন। কিন্তু, আচমকাই তিনি বেঁকে বসেন। সকলকে হতাশ এবং চমকে দিয়ে জানিয়ে দেন, প্রধানমন্ত্রী পদে বসবেন না সোনিয়া গান্ধী। এরপরেই কংগ্রেসের প্রধানমন্ত্রী মুখ নিয়ে জোর চর্চা শুরু হয়। তখনই জল্পনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে জাতীয় রাজনীতিতে ‘চাণক্য’ নামে প্রসিদ্ধ প্রণব মুখোপাধ্যায়ের নাম।
সেই সময় কন্যা শর্মিষ্ঠা মুখোপাধ্যায় (Sharmistha Mukherjee) বাবার কাছে জানতে চান প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ কতটা রয়েছে? এর জবাবেই প্রণব জানিয়ে দেন যে, সোনিয়া গান্ধী তাঁকে প্রধানমন্ত্রী করবেন না। ‘ইন প্রণব, মাই ফাদার: আ ডটার রিমেমবার্স’ (In Pranab, My Father: A Daughter Remembers) নামে এ মাসেই প্রকাশিতব্য একটি জীবনী তথা স্মৃতিকথার মতো গ্রন্থে এসব ছোটবড় নানান ঘটনার কথা লিখেছেন প্রণব-কন্যা শর্মিষ্ঠা। প্রাক্তন কংগ্রেস মুখপাত্র শর্মিষ্ঠা খুব অল্পদিনের জন্য রাজনীতিতে এসেছিলেন। ২০২১ সাল থেকে রাজনীতির ময়দান থেকে সরে দাঁড়ান।
আরও পড়ুন: সংসদে হামলার হুমকি খলিস্তানি জঙ্গি পান্নুনের
এই গ্রন্থে শর্মিষ্ঠা বাবার বিস্তারিত জীবন কাহিনি বর্ণনা করেছেন। তিনি লিখেছেন, তাঁকে প্রধানমন্ত্রী না করার জন্য বাবার মধ্যে সোনিয়া গান্ধীর প্রতি কোনও বিদ্বেষ ছিল না। এমনকী মনমোহন সিংকে প্রধানমন্ত্রী করার জন্য তাঁর মধ্যে বিরোধিতার মনোভাব ছিল না। প্রণবের লেখা ডায়েরি, বাবা-মেয়ের ব্যক্তিগত গল্পগাছা, অন্যান্য বই ঘেঁটে শর্মিষ্ঠা এক নতুন প্রণবের মুখ ও রাজনৈতিক জীবনকে তুলে ধরেছেন এই গ্রন্থে। ইন্দিরা গান্ধীর দীর্ঘদিনের ছায়াসঙ্গী ও বিশ্বস্ত প্রণব কংগ্রেস সরকারে অর্থ, প্রতিরক্ষা, বিদেশমন্ত্রকের মতো গুরুদায়িত্ব সামলেছেন। সেই প্রণবের প্রতিই সোনিয়া গান্ধীর অনাস্থা তাঁকে ‘একনম্বর ব্যক্তি’ হতে দেয়নি। রাহুল গান্ধীর অপরিণত, অপুষ্ট রাজনৈতিক বুদ্ধি ও বুঝতে চাওয়ার অধৈর্য নিয়েও বইতে বর্ণনা করেছেন কন্যা, জানিয়েছে গ্রন্থের প্রকাশক রূপা পাবলিকেশনস।
মন্ত্রী হওয়া ছাড়াও প্রণব মুখোপাধ্যায়ই দেশের একমাত্র বাঙালি রাষ্ট্রপতি হন। ২০১২ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত তিনি রাষ্ট্রপতি ছিলেন। ২০২০ সালের ৩১ অগাস্ট ৮৪ বছর বয়সে প্রয়াত হন। বইয়ের ‘দি পিএম ইন্ডিয়া নেভার হ্যাড’ পরিচ্ছেদে শর্মিষ্ঠা লিখেছেন, প্রধানমন্ত্রীর দৌড় থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন সোনিয়া। আর তাতেই সংবাদমাধ্যম এবং রাজনৈতিক মহলে নানান গুঞ্জন শুরু হয়ে যায়। মনমোহন সিং ও প্রণব মুখোপাধ্যায়ের নাম নিয়ে জল্পনার জলঘোলা হতে থাকে।
শর্মিষ্ঠার লেখায় রয়েছে, বাবা তখন এত ব্যস্ত যে দিন দুয়েক বাবার সঙ্গে দেখাই হয়নি আমার। কিন্তু, ফোনে আমার সঙ্গে কথা হয়েছিল। উচ্ছ্বাসের বশে আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করি, তুমি কি প্রধানমন্ত্রী হচ্ছো? ওনার এককথায় উত্তর ছিল, না, উনি আমাকে প্রধানমন্ত্রী করবেন না। মনমোহন সিং হতে পারেন। প্রণব তখন আরও বলেন, যত দ্রুত সম্ভব প্রধানমন্ত্রীর নাম ঘোষণা করা উচিত। এই অনিশ্চয়তা দেশের পক্ষে মঙ্গলজনক নয়। কন্যা জানিয়েছেন, এরপরেও বাবা সাংবাদিকদের কাছে বলেছিলেন, সোনিয়া গান্ধীর কাছ থেকে তাঁর কোনও প্রত্যাশাই ছিল না। বইতে রয়েছে, যদি কোনও আশাই না থাকে, তাহলে হতাশা থাকারও কারণ নেই। উল্লেখ্য, আগামী ১১ ডিসেম্বর প্রণব মুখোপাধ্যায়ের জন্মদিনে বইটি প্রকাশ করা হবে।
শর্মিষ্ঠার কথায়, ইন্দিরা গান্ধী হত্যাকাণ্ডের পরেও প্রণব মুখোপাধ্যায়ের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছিল। বারবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ হাতছাড়ার চাপা কষ্টও ছিল প্রণবের মধ্যে। তিনি বলতেন, অবশ্যই আমিও প্রধানমন্ত্রী হতে চাই। যে কোনও রাজনীতিকেরই এই উচ্চাশা থাকে। কিন্তু, আমি সেটাই চাই, এর উত্তরের জবাব সেটাও নয়।
প্রণব এক জায়গায় লিখেছিলেন, সোনিয়াজি জানেন তাঁর সীমাবদ্ধতার কথা। উনি বুদ্ধিমতী, কঠোর পরিশ্রমী এবং ওনার সব থেকে বড় শক্তি হল, উনি জানেন এবং স্বীকার করেন তাঁর দুর্বলতা। কিন্তু, রাহুল সম্পর্কে ২০০৯ সালের ২৯ জানুয়ারি প্রণব ডায়েরিতে লিখেছেন ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক প্রসঙ্গে। তারপর আরও বেশ কয়েক জায়গায় রাহুল সম্পর্কে তাঁর অভিমত লিখেছিলেন প্রণব। সেখানে রয়েছে, রাহুলের মধ্যে রাজনৈতিক পরিপক্কতা আসেনি। রাষ্ট্রপতি ভবনে মাঝেমধ্যে এসে দেখা করতেন। প্রণব তাঁকে প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য মন্ত্রিসভায় যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। রাহুল তা শোনেনি, লিখেছেন শর্মিষ্ঠা। ২০১৩ সালের ২৫ মার্চ প্রণব ডায়েরিতে লিখেছেন, রাহুলের মধ্যে বহু বিষয়ে জানার উৎসাহ ছিল। কিন্তু, একটা থেকে অন্যটায় খুব দ্রুত সরে যেতেন। বুঝতে পারতাম না, কতটা তাঁর মাথায় ঢুকেছে বা বুঝতে পেরেছেন।
অন্য খবর দেখুন