অনিমেষ বৈশ্য: আমার মা-কে তিনি দিয়েছেন সবুজ রঙের শাড়ি। আমার মা তাঁকে দিয়েছেন চন্দন রঙের চাদর। তিনি আমার মায়ের স্বজন। নিবাস বাংলাদেশে। সবুজ শাড়িটা এসেছে ও-পারের কোনও বাজার থেকে। চন্দন রঙের চাদরটা যাবে এ-পার থেকে। শাড়িতে হলুদের গন্ধ। চাদরে মধুফুলের গন্ধ। বস্ত্র খণ্ড দুটি অখণ্ড জাতীয় পতাকার মতো লুটোচ্ছিল আমার খাটে।
বাংলাদেশ পঞ্চাশ। কিন্তু সত্যিই কি পঞ্চাশ? নাকি আরও বেশি? একশো, দুশো, আবহমানের। দুজনের বহু কাল বাদে দেখা। পাশাপাশি বাড়ি ছিল। এক উঠোনে কিতকিত খেলেছেন। নিঝুম দুপুরে পেয়ারা বা বাতাবি চুরি করেছেন এর-তার বাগানে। দুজনের দেখা হতেই গলা জড়াজড়ি। তার পর কান্না। তার পর অবিরাম বাংলাদেশ খোঁজা।
—-আমাগো ঘরের পিছনে পুষ্কুনিডা আছে অহনও? কত হাঁস আছিল। সাদা ডানা, খয়েরি ডানা…।
—-হ আছে তো।
—-হাঁসগুলাইন?
—-হ আছে তো। কত নয়া নয়া হাঁস।
—-সুবল মানে সুবইল্যার পাও ভাঙসিল দুয়ারে উষ্টা খাইয়া। কত ডাক্তার-বদ্যি দেহাইছিলো হ্যার বাপে।
—-সুবইল্যা বুড়া হইসে। আমরাও তো বুড়ি হইসি। অহনও খুড়াইয়া খুড়াইয়া হাডে সুবইল্যা। একবার হ্যায় ইন্ডিয়ায় গিয়ে থাকব কইয়া পোডলা লইয়া রওয়ানা দিল। কিন্ত বর্ডার অব্দি গিয়া আবার হেই খুড়াইয়া খুড়াইয়া ফিরা আইল। তার পর করসে কী জানস? পুষ্কুনিতে লাফ দিয়া শুধু সাঁতরায়। আর উডে না। সইন্ধা হইয়া যায়। সুবল উডে না। তার পর উইডা কয়, ইন্ডিয়ায় এমন পুষ্কুনি আছে? জলে নামলে পুঁটি মাছের ঝাঁক দুই পাওয়ের ফাঁকে আইয়া ঘুইরা বেড়ায়? তার পর সুবইল্যার মতো মরদও কাইন্দা-কাইড্ডা একসা।
–সুবইল্যা বিয়া করে নাই? ইস্কুলে যহন পড়ত, তহন কইত, আমি বিয়া করলে মহারানিরে করুম। নইলে করুম না। আচ্ছা, আমাগো ইস্কুলের পিছনের নদীডা আছে না শুকাইয়া গ্যাছে রে? বর্ষায় নদীর জলে ইস্কুল ভাসে অহনও?
—বিয়া তো করসে। তবে রানি কই পাইব। এক মাস্টারের মাইয়ারে বিয়া করছে। (দুজনের হাসি।) নদী আছে। নদী যাইব কই। মাইনষে যায়। নদীর কাছে মুজিব যা, ইন্দিরাও তাই।
দুজনে হাসতে থাকে। তার পর খাটের উপর আসনপিঁড়ি হয়ে বসে। দুজনে মুড়ি খায়। পুকুর, হাঁস, সুবলের ভাঙা পা ছাড়িয়ে কানের দুল, চুলের ফিতে, রঙিন চুড়ি রিনরিন করে বাজতে থাকে চার দেওয়ালে।
একটাই জীবন। এক জীবনে মানুষ কতবার গৃহহীন হয়?
বাড়ি বদলে যায়। সারা জীবনের এক পয়সা, দু’পয়সা জমিয়ে কেউ একটা ঘর বানায়। তার পর বাগানে পুঁতে দেয় একটা গন্ধরাজের চারা। ঘরের চালে লকলকিয়ে ওঠে লাউয়ের ডাল। সংসার ভরভরন্ত হয়। নতুন ঘরদোরের স্বপ্নে গেরস্তের নেশা লাগে। লেবুর ঝাড়ে সন্ধ্যায় জোনাকি জ্বলে, সাদা সজনে ফুলে বসন্তের দখিনা হাওয়া তিরতির করে কাঁপে। তার পর হঠাৎ একদিন কেউ জানতে পারে, এ বাড়ি তার নয়। এই গন্ধরাজ চারা আজ থেকে অন্যের। এ এক অনন্ত শিকড় ওপড়ানোর গল্প। হাসন রাজার গান মনে পড়ে, ‘ভালা কইরা ঘর বানাইয়া কয়দিন থাকমু আর?’ এই বাংলার বয়স নেই। এর দেওয়ালে মহাকালের মাটি লেপা আছে।
আমাদের বাড়িতে একটা পেল্লাই কাঠের আলমারি ছিল। দুটো পাল্লা। কী করে বাংলাদেশ থেকে আলমারিটি এ দেশে এসেছিল জানি না। বর্ডার পেরিয়ে, হাঁস-মুরগি, কই-খোলসে, শিঙ্গি-মাগুরের অনন্ত ঘাই পিছনে ফেলে এই আলমারিটিকে আমার ঠাকুরদা এ-পারে এনে ফেলেছিলেন। একটা আস্ত বাংলাদেশ ঘাপটি মেরে থাকত আলমারিতে। কাঁসার থালা, পিতলের কলসি, রাম দা, ছেঁড়া পাটি, পরিত্যক্ত হুঁকো, কাঠের খড়ম —-কী না ছিল সেখানে। উঁকি দিলেই পূর্বপুরুষের শ্বাসপ্রশ্বাস শোনা যেত। খুঁজলে দোলের আবির অথবা নবান্নের পিঠেপুলির খোঁজ পাওয়াও বিচিত্র ছিল না। এই জাদুঘরকে ফেলে আসেননি ঠাকুরদা। তাঁর দ্যাশ লুকিয়ে ছিল ওই আলমারিতে।
ওই আলমারিটি ভাঙলে অন্তত তিনটে নতুন আলমারি হতো। কিন্তু ঠাকুরদা তা হতে দেননি। একবার দেশ ভেঙেছে। এত ভাঙনের আওয়াজ আর সয় না। আসবাব ভাঙলে অতীত ভাঙে। নদী, মাঠ, বকুল গাছ, ঘুঘু-ডাকা দুপুর সব ভেঙে যায়।
আলমারি থাকবে। মাটির গন্ধও থাকবে। উদ্বাস্তুর পায়ের তলায় সর্ষে। অনন্ত মাঠঘাট, নদী-বিল পেরিয়ে তবে না ষোলো কলা পূর্ণ।!
বাংলাদেশের বয়স নেই। মুনি-ঋষির মতো সোজা হয়ে বসে আছে অযুত বর্ষ। আমার মা ও মায়ের স্বজন মুখোমুখি চৌকিতে বসে। খয়েরি ডানার হাঁস সবুজ শাড়ি ও চন্দন রঙের চাদরের উপর সাঁতার কাটতে থাকে। দুজনে হাসে। কাঁদে। আর মাঝে-মাঝে বলে ওঠে, আয় আয় আয়।