আশিস চট্টোপাধ্যায়: শব্দহীন গান শোনে আজও জোনাকির ভিড়ে মহানিম
গ্রামাঞ্চলে অন্ধকার দীর্ঘ মাঠে পৌষের হিম—
আমার শৈশব আমি ভুলব না
মুঠিতে শুকানো শিশির আমি তবু মুঠি খুলব না, …
কবিতার যে মস্লিন আবরণ তাঁকে কিছুটা দৃশ্যমান করে, বাদবাকি কিছু কিছু আঁধারে ঘেরা, সেই মানুষটিকে কে জানে? তাঁর মন জুড়ে যে অগাধ ক্রন্দন, প্রতিটি অশ্রুবিন্দু যার শুষে নেয় সময়ের ব্লটিং কাগজ, সেই সৌমিত্রকে চিনেছে কে? সেই কবে, বাংলা সিনেমা যখন সবে কৈশোর থেকে যৌবনে পড়বে পড়বে করছে, তখন, সেই দ্বন্দ্ব-মুগ্ধ সময়ের কৃষ্ণ প্রেক্ষাপটে অপুর সংসারের ঘর গেরস্থালি কেন ভালোবেসেছিলাম? কী ছিল ওই চোখে, ওই ঠোঁট আর ঋজু দেহে, সেই বাঁশি বাজানো সুঠাম পুরুষের, যে আম-বাঙালি তাঁর বিদগ্ধ প্রেমে? ভিতরের যে দহন, তা-কি বারবার প্লাবিত করেনি ব্যক্তিগত নানা চাওয়া-পাওয়াকে? সমাজ সংসারের দুঃখময় উজানে বারবার ক্ষতবিক্ষত এই সময়ের সাক্ষী হয়ে কাঠগড়ায় ওঠে না-কি এইসব পংক্তি —
… ভারী, দামী পাথরের টুকরোর মত সময়কে
ঢালু জমির ওপর গড়িয়ে যেতে দেখেছি
জলের দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে,
অনতিপ্রদোষের মধ্যে
সব ছবিগুলো ডুবে যাবে
ঝিল, জলের ভিতরে ছায়া আকাশনিমের।
কার মুখ দেখা যাবে
আততায়ী অত্যাচারী কিনা
এই সবই পড়ন্ত ছায়ার মধ্যে সন্ধান করেছিলাম
ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে যে সামনে এসে দাঁড়াল
সে আমার এতগুলি বছরের নিঃসঙ্গতা
হাস্যকর ভাঁড়ের পোশাকে। …
কতদিনই বা হলো সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াণের, দু’বছরও নয়। ২০২০-র ১৫ নভেম্বর চলে যাওয়া এই মহামানবকে কতটা মনে রেখেছে কলকাতা? তাঁকে যে ভোলা যায় না, অত সহজ নয় সে বিস্মরণ, এই কথাটাই যেন নীরব সোচ্চারে মূর্ত হয়ে উঠল দীপক চন্দের তুলিতে-প্যাস্টেলে, সাদা-কালো অথবা বৈদগ্ধ্য-মার্জিত রংয়ের মুর্ছনায় — ‘দীপক চন্দের তুলিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় : নানা রূপে’ শীর্ষক চিত্র প্রদর্শনীতে। রবিবার, ১১ সেপ্টেম্বর শুরু হয়েছে প্রদর্শনী, স্থান – কলকাতার নন্দন চত্বরে গগনেন্দ্র শিল্পপ্রদর্শশালা, চলবে ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। উদ্বোধন করলেন সৌমিত্র তনয় সৌগত চট্টোপাধায়। শিল্পী ছাড়াও ছিলেন দেবজ্যোতি নারায়ণ রায়, সাবধান চট্টোপাধ্যায়, অভিজিৎ বসু, পরাশর বন্দ্যোপাধ্যায়, পার্থ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। কথা বলছিলেন ওঁরা, প্রয়াত শিল্পী, কবি, সৌমিত্র-র নানা দিক নিয়ে। শিল্পী দীপক চন্দকে জিজ্ঞাসা করা গেল, কেন সৌমিত্রকে ভালো লাগে? সিনেমার কথায় গেলেনই না দীপক, সোজা বললেন, ‘ওঁর কবিতা, আবৃত্তিতেই নিহিত থাকে ভালো লাগার মূল ভিত্তি’। সেই সৌমিত্রকে তো ক্যামেরায় ধরা যায় না, তুলি ছাড়া সে মুগ্ধতা ফুটিয়ে তোলা যায় কীভাবে? বহুমাত্রিক কোন ধারণাকেই বা ক্যামেরায় বন্দি করা গিয়েছে? কবে?
সৌমিত্র তনয় সৌগত উদ্বোধন করতে করতে কী অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিলেন? বাবার নানা টুকরো টুকরো স্মৃতি কি বিষণ্ণ করেনি তাঁকে? এই প্রতিবেদকের প্রশ্নের জবাবে কিন্তু প্রত্যয়ের সঙ্গে জানালেন, পেশাজীবনকে ঘরে নিয়ে আসতেন না তাঁর পিতা। পড়াশোনার কথা উঠতে অকপট সৌগত বললেন, হাজার ব্যস্ততার মধ্যেও বাবা পড়িয়েছেন তাঁকে এবং তাঁর বোনকে, পড়িয়েছেন নিয়ম করে মা-ও। বাবার সঙ্গে কথা হতো কবিতা নিয়ে, জানান সৌগত। এখন কথা হলো, কবিতা তো জীবনেরই আবছায়া। সমাজ, প্রেক্ষিত, আলো যে অন্ধকারের জন্ম দেয়, বর্তমানের মুগ্ধতা সময়ের স্রোতে ক্ষয়ে যেতে যেতে যে আলগা বোধ জেগে থাকে, তা-ই তো কবিতা। জীবনের সারাংশ-ই তো কবিতা। কেমন ছিল সেই বোধ? জিজ্ঞাসা করা গেল, ‘মার্কসবাদী ছিলেন কি সৌমিত্র’? আমাদের চোখে যে দীর্ঘ ঋজু সৌমিত্র ভেসে ওঠেন, তা হয়তো সৌগতর চোখে ছিল না এই সন্ধ্যায়। চোখের আলোয় চোখের বাইরে তাকালেন তিনি, হয়তো দেখলেন পিতার স্পর্শ, কিংবা দেখলেন বাবার হাসির শব্দ, দেখা যে কেবল দেখা নয়, তা অনন্য বোধও, সেটার আশ্চর্য আলো সন্তানের মুখে। বললেন, একটুও দ্বিধা না রেখে, ‘প্রগতিবাদী নিশ্চয়ই ছিলেন বাবা, মার্কসবাদ সম্পর্কে আকর্ষণ তো ছিলই’। অনেকেই যেমনটি ভাবেন, মার্কসবাদী বীক্ষা তাঁর মননে দিশা জুগিয়েছে জীবনভর, সৌগত যেন সেই জানা কিন্তু ছোটো হরফে লেখা কথাটার উপর আতশকাচ ধরলেন। জানা কথাটি জানা গেল আর-বার, যেমন বারবার জেনেও শুনতে ইচ্ছে করে, আমি তোমায় বড় ভালোবাসি, তোমায় বড় ভালোবাসি।
তোমাকে বড় ভালোবাসি সৌমিত্র! তুমি আছ কি নেই, এ প্রেম তার থেকে বড়। এ যেন নিজের উপলব্ধিকেই সুন্দর রমণ। তোমার সঙ্গে, তোমার বীক্ষার সঙ্গে ঘর বেঁধেছিলাম, সৌমিত্র, সে ঘর ভেঙে গেছে। তবু ভোলা কি যায় সে অপূর্ব স্মৃতি? সেই কবে, মধ্যযুগে কবি জ্ঞানদাস লিখেছিলেন,
সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু অনলে পুড়িয়া গেল,/অমিয়া সাগরে সিনান করিতে সকলি গরল ভেল …