
দ্য কেরালা স্টোরি এক কুৎসিত প্রোপাগান্ডা। এক জঘন্য প্রচার। সিনেমা পরিচালক নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়েই ছবি তৈরি করেছেন, এবং সঙ্গত কারণেই নরেন্দ্র মোদি থেকে অমিত শাহ ছবির প্রচার করেছেন, উত্তরপ্রদেশ আর মধ্যপ্রদেশে ছবিকে ট্যাক্স-ফ্রি করার কথা জানিয়েছেন। এবং উল্টোদিকে বিরোধীরা তার বিরোধিতা করেছেন। আছে কী ছবিটাতে? দেখানো হচ্ছে, একদল মুসলমান পুরুষ ও মহিলা এদেশে বসেই ষড়যন্ত্র করছে, তাদের টার্গেট কিছু হিন্দু মহিলা, যাদেরকে বিভিন্ন কৌশলে ভালোবাসার জালে ফেলে বিয়ে করে আফগানিস্তান নিয়ে গিয়ে টেররিস্ট বানানো হচ্ছে। সিনেমার শুরুতেই বলে দেওয়া হয়েছিল এরকম ৩২ হাজার মহিলার গল্প তাঁরা বলছেন। স্বাভাবিক কারণেই সে খবর ছড়িয়েছিল সবখানে, ৩২ হাজার হিন্দু মেয়ের কেবল ধর্মান্তরণ নয়, তাদের ইসলামিক টেররিস্ট করে তোলার সত্যি গল্প। কিন্তু সিনেমা রিলিজ হওয়ার আগেই পরিচালক জানিয়ে দেন ৩২ হাজার নয়, ৩ জনের গল্প বলা হচ্ছে। এরকম মিথ্যাচার কেন?
প্রশ্ন তো উঠল, কিন্তু পরিচালক জবাব দিলেন না, এ নিয়ে উচ্চবাচ্যও করলেন না। অথচ এই প্রচারের ফলে সারা দেশে এক মাহল তৈরি হয়েছে, বিজেপি, বজরং দল, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এই প্রচারকে আরও তীব্র করে তুলতে চায়। লক্ষ্য তো একটাই, চূড়ান্ত মেরুকরণ। ৮০ শতাংশ মানুষকে এক ব্র্যাকেটের মধ্যে আনা, হিন্দু ব্র্যাকেট। সেই ১৯২৫ থেকে এই চেষ্টার ফলে কতটা তাঁরা পেরেছেন? মাত্র ৫০ শতাংশকে তাঁদের ধারে নিয়ে যেতে পেরেছেন। শিক্ষিত উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্তের একটা অংশ সত্যিই তাঁদের এই মেরুকরণের ফলে এক ন্যারেটিভে বিশ্বাস করেছেন, যেখানে বেকারত্ব নয়, মূল্যবৃদ্ধি নয়, গ্যাস সিলিন্ডার নয়, ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে রাম জন্মভূমি, বজরংবলী, হিন্দুরাষ্ট্র। একেবারে দরিদ্র মানুষজন কি সেই মেরুকরণের শিকার হননি? হয়েছেন বইকী, কিন্তু তাঁদের বেঁচে থাকার লড়াই এতটাই তীব্র যে সেই লড়াই তাঁদের কাছে রাম, হনুমানের বাইরেও আরও অনেক কিছুর তীব্র চাহিদার জন্ম দিয়েছে। তাঁরা দু’ বেলা গরম ভাত চাইছেন, তাঁরা মাথার উপর ছাদ চাইছেন, তাঁরা স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা চাইছেন, সন্তানদের সুরক্ষিত ভবিষ্যৎ চাইছেন। কাজেই যত বেশি করে অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো মাথাচাড়া দিচ্ছে তত বেশি করেই গুমনামি, কাশ্মীর ফাইলস, কেরালা স্টোরির মতো সিনেমার দরকার হয়ে পড়ছে। আজ সেই কেরালা স্টোরির উপর রাজ্য সরকারের নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে রায় দিল সর্বোচ্চ আদালত। সেটাই বিষয় আজকে, উঠে গেল নিষেধাজ্ঞা।
আরও পড়ুন: Aajke | বোমা না বাজি?
নিষেধাজ্ঞা দিয়ে কি আটকানো যায় সিনেমা সাহিত্যের প্রভাবকে? কিছুদিন আগেই বিবিসির এক ডকুমেন্টারি আটকানোর চেষ্টা করেছিল মোদি সরকার, কী হল? মানুষ আরও বেশি দেখল। এই ওঁচা রদ্দি সিনেমা, যাকে সিনেমা বলাও যায় না, তা নিয়ে এই শোরগোল না হলে ক’জন এই ছবি দেখতে যেতেন? কতজন এই ছবি দেখে বাইরে এসে আহা আহা বলতেন? খুব সন্দেহ আছে। কিন্তু এই বিতর্ক, এই নিষেধাজ্ঞা এই ছবিকে এক আলোচনার বিষয় করে তুলল, বহু মানুষ কেবল সেই কারণেই ছবি দেখতে গেলেন। আর সেই সুযোগটা নিলেন মোদি–শাহ, বিজেপির নেতৃত্ব, তাঁরা এই বিতর্ককে উসকে দিলেন। আমরা বলতেই পারতাম, এই ছবিরই এক নায়িকা দেবলীনা ভট্টাচার্য, ভাটপাড়ার বামুনের মেয়ে, ব্যক্তিগত জীবনে বিয়ে করেছেন এক মুসলমানকে, এটাই তো ভারতবর্ষ। আমরা সম্প্রীতির হাজারো উদাহরণ তুলে ধরতে পারতাম। আমাদের এই বাংলার মেয়ে শর্মিলা ঠাকুর বিয়ে করেছেন নবাব পতৌদিকে, আমাদের এই বাংলায় আজান আর মন্দিরের ঘণ্টা একসঙ্গেই শোনা যায়, আমরা এসব বলতেই পারতাম। তা না করে রাজ্য সরকার নিষেধাজ্ঞা চাপালেন ছবির ওপর। একে তো সুপ্রিম কোর্টের আদেশে আবার মুখ পুড়ল, তার ওপরে এই নিষেধাজ্ঞা জন্ম দিল এক কিউরিওসিটির, যার ফলে একজন হলেও ছবির দর্শক বাড়বে। নিষিদ্ধ ফলের ওপর মানুষের আকর্ষণ তো আজ থেকে নয়, তাই এমন নিষেধাজ্ঞার কোনও দরকার ছিল না। আমরা মানুষের কাছে প্রশ্ন রেখেছিলাম, ছবি গান সাহিত্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা কি আসলে তার জনপ্রিয়তাকে বাড়িয়ে দেয়?
প্রোপাগান্ডা কেন? এক ন্যারেটিভ তৈরি করার জন্য। কিছু কথা মানুষের মনে গেঁথে দেওয়ার জন্য। সেটা যদি মাঠে ঘাটে বক্তৃতা হয়, তাহলে তাকে মাঠে ঘাটে প্রচার দিয়েই রুখতে হবে। যারা সেই প্রচার করছে তাদের জেলে পুরে নয়। ঠিক সেইরকম ভাবেই সেই প্রোপাগান্ডা যখন সাহিত্য, গান, কবিতা সিনেমার আকারে আসে, তখন সেই ন্যারেটিভের বদলে আমাদের নতুন গান লিখতে হবে, নতুন সাহিত্য, নতুন সিনেমা তৈরি করতে হবে। তা না করে কেবল নিষেধাজ্ঞা কোনও সমাধান হতেই পারে না। কেরালা স্টোরির এক নায়িকার ভাষায়, আমরা বিয়ে করেছি অনেকদিন, শুরুতে এ নিয়ে অনেক প্রশ্নও ছিল, এখন সেসব আর নেই। আমরা ভালো আছি। হ্যাঁ, এই সত্যিটাকেই আমাদের বলতে হবে, জনে জনে বলতে হবে।