২৩ আগস্ট ১৯৪৫, পৃথিবীর মানুষ খবর পেল, ১৮ আগস্ট, তাইহকুতে এক বিমান দুর্ঘটনায় মারা গেছেন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস, বিদেশের কাগজে, দেশের কাগজে হেডলাইন নেতাজীর মৃত্যু। সঙ্গে সঙ্গেই জন্ম নিয়েছিল অবিশ্বাস, অনেকেই ভেবেছিল ১৯৪১ এর মহানিষ্ক্রমণের মতই আবার নেতাজী কোথাও চলে গেলেন, ব্রিটিশদের ফাঁকি দিয়ে। ৬ আগস্ট, ৯ আগস্ট জাপানের হিরোসিমা নাগাসাকিতে ফেলা হয়েছে অ্যাটম বোমা, ১৫ আগস্ট জাপ সম্রাট হিরোহিত জানিয়ে দিয়েছেন, জাপান আত্মসমর্পণে রাজী। জাপ সেনাবাহিনী, জাপ প্রশাসনে চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা, নেতাজীর আই এন এ নিয়ে তাদের সিদ্ধান্তহীনতা প্রকাশ পাচ্ছে, আই এন এ জাপানের সঙ্গেই আত্মসমর্পণের কথা বলে নি, তাদের সঙ্গে কী ব্যবহার হবে, সম্পর্ক কী হবে কারো জানা নেই। কিন্তু নেতাজীর সঙ্গে ব্যক্তিগত যোহাযোগার সম্পরকের ভিত্তিতে ওনাকে জকাপান ছেড়ে যাবার ব্যবস্থা করেছিল সেনাবাহিনীর কিছু অফিসারেরা। সেই যাবার সময়েই নাকি ঘটেছে দুর্ঘটনা, উনি আহত হন, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানেই মারা যান। একমাত্র ভারতীয় সাক্ষী কর্নেল হাবিবুর রহমান। তাঁকে ওখানেই দাহ করা হয়, অস্তিভস্ম রাখা হয় রেনকোজির মন্দিরে। অবিশ্বাস কি কিছু মানুষ করেছিলেন? তাঁর দাদা শরৎ বসু, গান্ধিজী, বাংলার বহু রাজনৈতিক নেতা, এমন কি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও খবরটা প্রথমে মেনে নেন নি। ইংরেজ প্রশাসনও মেনে নেন নি। তাই তদন্ত শুরু হল।
পূর্ব রণাঙ্গনে মিত্র শক্তির দায়িত্বে থাকা ম্যাক আর্থার তদন্তের নির্দেশ দিলেন, তদন্ত রিপোর্ট জমা পড়ল ৩০ সেপ্টেম্বার। রিপোর্টে জানানো হল, হ্যাঁ চন্দ্র বোস এক বিমান দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। এটা ছিল প্রথম তদন্ত কমিটি, এবং তার রিপোর্ট। ভারতের ব্রিটিশ প্রশাসন খুশি হলেন না, ভারতের ইংরেজ সরকার সুপারিনটেন্ডান্ট অফ পুলিশ টি এস ফেনি কে তার টিম সহ পাঠাল ব্যাঙ্কক, সায়গন, তাইপেই, তারা ৫ অক্টোবর, ৭ অক্টোবর, ১০ এবং ১২ অক্টোবর চারটে রিপোর্ট পাঠালো। তাতে বলা হল, হ্যাঁ নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু এক বিমান দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। ডিসেম্বার ৩১, ১৯৪৫ এ ব্রিটিশ কম্বাইন সার্ভিসেস কর্নেল হাবিবুর রাহমান কে জিজ্ঞাসাবাদ করে রিপোর্ট দেন যে নিতাজী বিমান দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। ১৯৪৬ এ লেফটান্যান্ট কর্নেল জন ফিগেশ টোকিওতে গেলেন, ঐ বিমান দুর্ঘটনায় যারা বেঁচে ছিলেন, লেঃ কর্নেল শিরো নোনোগাকি, লে কর্নেল তাদেও সাকাই কে জিজ্ঞাসাবাদ করেন, সেই ডাক্তার যিনি নেতাজীর চিকিৎসা করেছিলন, তোয়সি সুরিতাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করার পরে রিপোর্ট দেন যে নেতাজী মারা গছেন দুর্ঘটনাতেই, আগের তাইহকু, পরে যার নাম হয় তাইপেই বিমানবন্দরের কাছে মিলিটারি হাসপাতালে, নানম ওয়ার্ড এ, ১৮ আগস্ট ১৯৪৫ সন্ধে সাতটা থেকে আটটার মধ্যে। ফিগেস এ তদন্ত রিপোর্ট জমা পড়ে জুলাই ১৯৪৬ এ। ঐ একই সময়ে ব্রিটিশ সরকারের আরেক এজেন্সির তরফে ক্যাপ্টেন আলফ্রেড টার্নার এক তদন্ত শুরু করেন, সামরিক হাসপাতালের দায়িত্বে থাকা ডঃ ইয়োসিমিকে জেরা করেন, আরও কিছু প্রত্যক্ষদর্শী নার্স ইত্যাদিদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে তিনি অক্টোবরে তাঁর রিপোর্ট দেন, তাতেও বলা হয়, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু ১৮ তারিখের বিমান দুর্ঘটনাতেই মারা গেছেন। আমেরিকার সি আই এর বহু তথ্যে এই চারটে তদন্তের কথা আছে, সেখানেও এই দুর্ঘটনায় নেতাজীর মৃত্যু কথাও আছে। কিন্তু এই সমস্ত তদন্তের রিপোর্ট মানুষের কাছে আসে নি, প্রকাশিত হয় নি, কাজেই দেশের মধ্যে, সাধারণ ভারতবাসীর মধ্যে বিভিন্ন কথা বার্তা চলতে থাকে, জন্ম নিতে থাকে নানান কন্সপিরেসি থিওরি।
মুম্বাই এর ফ্রি প্রেস জার্নালের সংবাদদাতা হারীন শাহ, নিজেই এক তদন্তে নেমে পড়েন, চলে যান তাইপেই, কথা বলেন ডাক্তার এবং নার্সদের সঙ্গে, তারপর বই লেখেন ভার্ডিক্ট ফ্রম ফরমোসা, গ্যালান্ট এন্ড অফ নেতাজী, তাতে ঐ বিমান দুর্ঘটনা, তারপরে হাসপাতাল, চিকিৎসার বিবরণ আছে, শেষমেষ বলা আছে নেতাজীর মৃত্যু এবং দাহ প্রক্রিয়ার কথা। এরপর আই এন এর সদস্যদের নিয়ে তৈরি ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেনডেন্স লিগ নিজেরা এক তদন্ত শুরু করে, ১৯৫৩ তে সেই তদন্তের রিপোর্ট বের হয়, তাঁতে ওরা জানান যে ঐ দুর্ঘটনাতেই নেতাজীর মৃত্যু হয়েছিল, কিন্তু ঐ দুর্ঘটনা ছিল আসলে এক ষড়যন্ত্র, মানে প্লেন ভেঙে পড়া, নেতাজী মৃত্যু নিয়ে তাঁরাও কোনও প্রশ্ন তোলেন নি। ১৯৫৬ র জানুয়ারি মাসে জাপান সরকার তাদের তদন্ত রিপোর্ট পাঠিয় দেন ভারত সরকারর কাছে, সেই রিপোর্টে দুর্ঘটনার বিবরণ, নেতাজীর চিকিৎসা এবং মৃত্যুর কথা পরিস্কার করেই বলা আছে, বিভিন্ন সামরিক, বেসামরিক আধিকারিক, ডাক্তার নার্সের বিবৃতি এই তদন্ত রিপোর্টে আছে। কিন্তু এই রিপোর্টও গোপনেই দেওয়া হয়। এই রিপোর্টে রেনকোজি মন্দিরে রাখা চিতাভস্ম, আই এন এর সম্পদ, সবকিছুর বিবরণ আছে। এবার ১৯৫৬ তে ভারত সরকার আই এন এর মেজর জেনারেল শানওয়াজ খানের নেতৃত্বে এক তদন্ত কমিটি তৈরি করেন, তাতে ছিলেন নেতাজীর অগ্রজ সুরেশ বসু, এস এন মৈত্র আই সি এস। কমিটি তদন্ত চালায়, বহু জায়গায় যায়, জেরা করে, সাক্ষ নেয় এবং এক ড্রাফট রিপোর্ট তৈরি করে, সেখানে ঐ দুর্ঘটনায় নেতাজীর মৃত্যু হয়ছে বলে জানানো হয়, এবং তাতে কমিটির তিনজনেই সই করেন, মহাফেজখানায় সেই ড্রাফট রিপোর্টও রাখা আছে, কিন্তু তারপরে ফাইনাল রিপোর্ট দেবার আগেই সুরেশ বসু সই করতে অস্বীকার করেন, দু মাস পরে তিনি এক রিপোর্ট দেন, যাতে বলা হয়, নেতাজী মারা যান নি।
ব্যস, এই ছিল প্রথম ঘৃতাহুতি, এরপর থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন লোকজন নানান কন্সপিরেসি থিওরি ইয়ে হাজির হতে থাকেন, কোথাও শৌলমারির সাধু, কোথাও গুমনামি বাবাদের দল উদয় হতে থাকে। শাহনওয়াজ কমিসনের দুজনের রিপোর্টে বিমান দুর্ঘটয়ার কথাই বলা হয়, রেনকোজি মন্দিরের চিতাভস্ম গান্ধিজীর, সেটাও বলা হয়। এরপর তাইওয়ান সরকারের তদন্তের রিপোর্ট আসে ১৯৫৬ তেই, সেখাএও ঐ একই দুর্ঘটনা এবং নেতাজীরমৃত্যুর কথাই লেখা আছে। এরপর ১৯৭০ এ তৈরি অয় খোসলা কমিশন, জাস্টিস জি ডি খোসলার এক সদস্যের কমিশন ১৯৭৪ এ রিপোর্ট পেশ করে, রিপোর্টেও ঐ একই কথার পুনরাবৃত্তি করা হয়। কিন্তু নেতাজী তো নেতাজীই, তাঁকে নিয়ে রহস্য, কৌতুহল, মিথ আর মিথ্যে গালগল্প বেচে দু পয়সা আসে, কাজেই বহু মানুষই সেই কাজেই নামলেন, এবার স্বাধীন ভারতবর্ষে মৃত নেতাজী সুভাষ তাদের পেটের ভাত জোগানো শুরু করল, ইউ টিউব, বই, সিনেমা সব মিলিয়ে রমরমা ব্যবসা,