কলকাতা টিভি ওয়েব ডেস্ক: ১৩৬ বছরের বৃদ্ধকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে নদীর ধারে, এক বিশাল অশ্বথ্ব গাছের তলায় শোয়ানো হয়েছে, হরিনাম করতে এসেছেন এক বিখ্যাত গায়ক, সঙ্গে অন্যান্য বাদ্যকরেরা, আত্মীয় স্বজনেরাও হাজির, হাজির গ্রামের আবাল বৃদ্ধ বনিতারা। বৃদ্ধ হয়তো আর বাঁচবেন না, কিন্তু রেখে গেছেন তাঁর পেল্লায় পুরনো ঘর, তাঁরা নানান কীর্তি মানুষের মুখে মুখে ফেরে, তাঁর আদর্শ, সবাইকে নিয়ে চলার ক্ষমতা, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ না করার সিদ্ধান্ত মানুষ জানে, বলে। কিন্তু আজ তিনি শয্যাশায়ী, কবিরাজ হাল ছেড়ে দিয়ে অন্তর্জলি যাত্রার নিদান হেঁকেছে। কিন্তু এক অ্যালোপাথি ডাক্তার এখনও হাল ছাড়েনি, সে ওষুধ, সিরাপ, খাইয়েই চলেছে, সূঁচ ও ফোটাচ্ছে ঘনঘন। একদল উৎসাহী মানুষ সেদিকেও নজর রেখেছে, যদি বুড়ো উঠে বসে, যদি বুড়ো আবার দাওয়ায় গিয়ে বসে। সে সব মানুষের বুড়োর জন্য নয়, ঐ মৃত্যু পথযাত্রী মানুষটার জন্য নয়, তাঁর আদর্শ, তাঁর দেখানো পথেই যাতে গ্রাম চলে, সমাজ চলে, সেই জন্য। এরকম হয়, যে অসুখেই মারা যাক না কেন, তার বেশি খাওয়া দাওয়া, তার শরীরের ওপর নজর না দেওয়া ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে মৃত্যু আসলেও মানুষ চায় তিনি বেঁচে থাকুন, সেই মানুষটার কীর্তির জন্য, আদর্শের জন্য।
আজ একইভাবে দেশের গ্রান্ড ওল্ড পার্টি ভারতের জাতীয় কংগ্রেস অন্তর্জলি যাত্রায়, তার নাভিশ্বাস উঠেছে, কিছু মানুষ, বেশ কিছু মানুষ চায় সে বেঁচে থাকুক, তার ধর্মনিরপেক্ষতা গণতান্ত্রিক আদর্শ নিয়ে বেঁচে থাকুক, কিন্তু সে সম্ভবত আর বাঁচতেই চায় না। দেশ জুড়ে সেই সমস্ত মানুষজন যাঁরা দেশের সংবিধানে বিশ্বাস রাখেন, দেশের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামো, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাতে বিশ্বাস রাখেন, তাঁরা চান কংগ্রেস থাকুক, বিভিন্ন আঞ্চলিক দল আর কংগ্রেসের যৌথমঞ্চ আর এস এস – বিজপি কে রুখে দিক। এবং তা সম্ভব, হিসেব তাই বলছে, আঞ্চলিক দলের সামনে টিঁকতে পারছেনা বিজেপি, সর্বত্র হারছে, সে বাংলায় তৃণমূলের কাছে, পঞ্জাবে আপ এর কাছে, তেলেঙ্গানায়টি আর এস এর কাছে, অন্ধ্রপ্রদেশে ওয়াই এস আর কংগ্রেসের কাছে, ঝাড়খন্ডে ঝাড়খন্ড পার্টির কাছে, বিহার এ আর জে ডির কাছে।
কিন্তু যখনই লড়াই কংগ্রেস আর বিজেপির, মুখোমুখি লড়াই, তখনই কংগ্রেস হারছে, হেরেই চলেছে, ২০১৪ নয়, ইন ফ্যাক্ট ২০১২ থেকেই হেরে চলেছে কংগ্রেস। ২০১২ তে গোয়ার নির্বাচন, কংগ্রেসের শাসন শেষ, বিজেপির মনোহর পারিক্কর মুখ্যমন্ত্রী হলেন, তারপর থেকে এখনও বিজেপিই ক্ষমতায়। পঞ্জাব বিজেপি আকালি দল আগের থেকেও বেশি ভোট আর আসন নিয়ে ফিরে এল ক্ষমতায়। উত্তরাখন্ড কোনওরকমে জিতল কংগ্রেস কিন্তু বিরাট ভুল করলো, ক্ষত্রিয় হরিশ রাওত এর জায়গায় ব্রাহ্মণ বিজয় বহুগুনা কে মুখ্যমন্ত্রী করা হল, তারপর থেকে লাগাতার হেরেছে কংগ্রেস।
উত্তরপ্রদেশ গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়ান পাওয়ার পলিটিক্স, সেখানে ১১% ভোট পেল কংগ্রেস। গুজরাট আবার বিরাটভাবে বিজেপির। ১১৫ বিজেপি, ৬১ কংগ্রেস। একমাত্র হিমাচল প্রদেশ মুখ রক্ষা করলো, সেটাও ৫ বছর পরেই চলে গ্যালো বিজেপির হাতে। এরপরে ২০১৪ তে সর্বসাকুল্যে ৫৪৩ এ ৪৪ টা আসন আর ১৯.৩% ভোট পেয়েছিল। এরপর আসাম চলে গেছে, কর্ণাটক চলে গেছে, হিমাচল প্রদেশ চলে গেছে, হরিয়ানা চলে গেছে, মণিপুর চলে গেছে, মধ্যপ্রদেশ চলে গেছে, বাংলায় শূণ্য। ২০১৯ এর নির্বাচন এ ৫২ টা আসন, ভোট ১৯.৫। একটু বেড়েছে? তাহলে বলি ২০১৪ তে জয়ের ব্যবধান ছিল ১৩.৬%, ২০১৯ তা নেমে দাঁড়ালো ৮.৬%। মানে জয়ের ব্যবধান উল্লেখযোগ্য ভাবে কমেছে। ১৯২ টা আসনে বিজেপি কংগ্রেস মুখোমুখি ছিল, ১৭৬ টা তে বিজেপি জিতেছে, মাত্র ১৬ টা তে কংগ্রেস জিতেছে। ২০০৯ এ ৩০৫ টা আসন এমন ছিল যেখানে হয় কংগ্রেস জিতেছে নাহলে বিরোধী কেউ, মানে হয় কংগ্রেস ফার্স্ট, নাহলে রানার আপ। ২০১৯ এ? মাত্র ২৬২ টা আসনে কংগ্রেস জিতেছে ৫২ টায়, ২০২ আসনে রানার আপ। এ তো গ্যালো আসনের কথা, এবার সংগঠনের কথায় আসা যাক। কংগ্রেসের দর্শন এক বস্তু, আর ৭২/৭৩ সাল থেকে কংগ্রেসের সংগঠন আরেক বস্তু, সেই ইন্দিরা গান্ধীর সময় থেকেই কংগ্রেস আর ওয়ার্কিং কমিটি নির্ভর নয়, কংগ্রেস হাই কমান্ড নির্ভর। আর ক্ষমতায় থাকলে কেউ প্রশ্ন করে না কতটা গণতান্ত্রিক ভাবে চলছে দল, কতটা সবার মতামত শুনছে দল। কখনোই করে না, কোনও দলে কোনওদিনও করে নি, আজ ও না।
বিজেপির কার সাহস আছে, এই প্রশ্ন করার বা বলার যে দল গণতান্ত্রিক রীতি নীতি মেনে চলছে না? কে করবে এই প্রশ্ন? সেদিনও ইন্দিরা গান্ধীকে কেউ প্রশ্ন করে নি, কেন কাশ্মীরের সবে উঠে আসা এক নেতা কে যিনি ৭৩ সালে ব্লক কংগ্রেস সভাপতি ছিলেন, তাঁকে ১৯৮০ তে কেন সর্বভারতীয় যুব কংগ্রেসের সভাপতি করা হল, প্রবীণ কংগ্রেসী নেতারা সেদিনের তরুণ গুলাম নবি আজাদের এই উথ্বানে ক্ষুব্ধ ছিলেন তো নিশ্চই, কিন্তু কোনও কথা বলেন নি, কারণ ইন্দিরা গান্ধী নিজের কবজির জোরে, ক্যারিস্মার জোরে ক্ষমতায় এসেছেন। অথচ তার ক বছর আগে ১৯৭৭ এ কংগ্রেসের হারের পরে সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় থেকে প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সী ইন্দিরা গান্ধীকে স্বৈরতান্ত্রিক বলেছেন, দেবরাজ আর্স দল ছেড়ে নতুন দল বানিয়েছেন। সেদিন মনে হয়েছিল কংগ্রেসের ভবিষ্যৎ অন্ধকার, ইন্দিরা গান্ধী আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন না, অতএব সংগঠনে সঞ্জয় গান্ধীর দাদাগিরি, ইন্দিরা গান্ধীর স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ, গান্ধী পরিবারের হাতেই কেন থেকে যাবে কংগ্রেস? ইত্যাদি প্রশ্ন সেদিন উঠেছিল। বেশি দিনের জন্য নয়, ১৯৮০ তে ইন্দিরা ফিরে এলেন, তারপর তিনি মারা গেলেন, রাজীব এলেন, কোনও প্রশ্ন নেই, সামান্য নড়াচড়া করেছিলেন প্রণব বাবু, দল ছাড়তে হয়েছিল, তারপর তিনিই আবার হেলেদুলে কংগ্রেসে। চলছিল বেশ, এমন কি মধ্যের ভি পি সিং বা অটল বিহারীর সময়েও এসব প্রশ্ন আসে নি।
এল কখন? ২০১৪ তে নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পর, ২০১৯ এ তিনি আবার জিতে ফিরলেন, কংগ্রেসে আবার গণতন্ত্রের জন্য হুঙ্কার, কান্না, উথালি পাথালি, জি ২৩ ইত্যাদি ইত্যাদি। যে আদি কংগ্রেসীরা ইন্দিরা গান্ধীকে দু দিনের ছোঁড়াদের দলে আনার কথা বলছিলেন, দলে গণতন্ত্রহীনতার কথা বলছিলেন, তাঁরাই ইন্দিরা গান্ধীর ফেরত আসার পরে সুড়সুড় করে আবার দলে ফিরেছেন সে প্রিয়রঞ্জন বা প্রণব বা জগজীবন রাম বা সিদ্ধার্থশঙ্কর যেই হন না কেন। এটাই বাস্তব, আজ হাসি পায়, আর এস এস – ইজেপির দিকে তাকালে, হুবহু কংগ্রেসী কায়দা, কিন্তু কেউ গণতন্ত্রহীনতার প্রশ্ন তুলছে না, তুলবেও না। কিন্তু মোদী – শাহ হেরে গেলে দেখে নেবেন গণতন্ত্রহীনতার প্রশ্ন উঠবে, দুজনে মিলে দল চালানোর কথা উঠবে উঠবেই, এখন যে প্রশ্ন নীতিন গডকরিও তুলতে পারছেনান না, তখন সেই প্রশ্ন সৌমিত্র খান ও তুলবেন, এটাই মজা। তার মানে কি এই যে কংগ্রেসে সব ঠিকঠাক চলছে? না, সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দলের এম পি এম এল এ আর রাজ্য দখলের হিসেব দেখেই বলা যায়, তাদের হাল হকিকত। রাস্তায় নামবো, ফেসবুকে কাঁপিয়ে দেবো, কিন্তু হাতে এম এল এ নেই, এম পি নেই, তাহলে বুঝতে হবে সংগঠনেও ঘুণ ধরেছে।
গান্ধীরা, ইন্দিরা গান্ধীর সময় থেকেই প্যারালাল এন্ট্রিই নিয়ে থাকেন, সঞ্জয় গান্ধী জরুরি অবস্থার সময় ডিক্টেট করতেন, তিনি মারা গেলে রাজীব চলে আসেন, ইন্দিরা মারা যেতে কদিন আগেই রাজনীতিতে আসা রাজীব প্রধানমন্ত্রী। সোনিয়া গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হলেন না, কিন্তু কিং মেকার, পেছন থেকে তিনিই চালাচ্ছিলেন, অতএব ভাবী গান্ধীর প্রবেশ রাহুল গান্ধী। তরুণ রাহুল তাঁর টিম তৈরি করলেন, প্রাজ্ঞরা সোনিয়ার অনুগত কিন্তু ভুরু তে ভাঁজ। টিম রাহুল টগবগে, রাজীবের সহচর বা বন্ধুদের পুত্র বা কন্যা। রাজীব গান্ধীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা জীতেন্দ্র প্রসাদের ছেলে জীতিন প্রসাদ, রাজীব গান্ধীর বন্ধু, মন্ত্রীসভার মন্ত্রী মাধব রাও সিন্ধিয়ার ছেলে জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া, সি পি এন সিং, ইন্দিরা গান্ধীর মন্ত্রীসভার মন্ত্রী ছিলেন, তাঁর ছেলে আর পি এন সিং দুন স্কুলের ছাত্র, গুজরাটের তরুণ তুর্কি হার্দিক প্যাটেল, রায়বেরিলি সদর থেকে ৫ বার জিতে আসা বিধায়ক অখিলেশ কুমার সিং এর কন্যা আমেরিকা ডিউক ইউনিভার্সিটি ফেরত অদিতি সিং, তেহালকার কলামনিস্ট প্রিয়াঙ্কা চতুর্বেদী, তুখোড় বক্তা, উকিল জয়বির শেরগিল, রাজস্থানে কংগ্রেসের নেতা রাজীব গান্ধীর বন্ধু রাজের পায়লটের পুত্র শচীন পায়লট। এইসব মিলে এক দারুণ টিম, ঠিক এই মূহুর্তে যাঁদের মধ্যে শচীন পায়লট ছাড়া কেউ টিঁকে নেই কেউ বিজেপি তে, কেউ শিবসেনায়, কেউ বসেই গেছেন, মানে অন্য কারোর কথা ছেড়েই দিলাম, প্রবীন বনাম নবীনদের দ্বন্দের কথাও বাদ দিলে, টিম রাহুলই তো ভেঙে ছারখার, নিজের টিমই ধরে রাখতে পারছেন না, গত তিন বছর ধরে আমি সভাপতি হব না হব না করেই চলেছেন, এদিকে প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য সতরঞ্চি পাতা আছে।
আর প্রবীণদের তালিকা? সে তো শেষ হবার নয়, গুলাম নবি আজাদ, কপিল সিব্বল, রীতা বহুগুণা যোশি, সঞ্জয় ঝা, ২৭ বছর কংগ্রেস করেছেন, রাজীবের বন্ধু অমরিন্দর সিং, ঐ পঞ্জাবেরই বলরাম ঝাখরের ছেলে সুনিল ঝাখর, অশ্বিনী কুমার ৪৬ বছর কেবল কংগ্রেসই করেছেন, বিখ্যাত আইনজীবি, একসময় আইন মন্ত্রীও ছিলেন, কেরালার পি সি চাকো, উত্তরাখন্ডের মূখ্যমন্ত্রী বিজয় বহুগুণা, গোয়ার প্রবীণ নেতা লুইজিনহো ফেলেইরো, এরা সবাই দল ছেড়েছে, কেউ বিজেপিতে গেছে, কেউ বসে গেছে, এদের সবাই যে সাধুপুরুষ তা বলছি না, আবার সব্বাই ক্ষমতালোভী তাও নয়, কিন্তু একটা কথা সব্বাই বলেছেন, আর যেই হোক রাহুল গান্ধী দল চালাতে জানেন না, এ আগে রিপুন বোরা বা সুস্মিতা দেব কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে এসেছেন, তাঁরাও একই কথা বলেছেন।
তাহলে সমস্যা যে একটা আছে, তা তো পরিস্কার, এবং সবচেয়ে বড় কথা উল্টোদিকে ২৪ ইন্টু সাত এর পলিটিশিয়ান মোদি – শাহ। ছুটি নেই, ব্যক্তিগত কাজ নেই, কেবল রাজনীতি, নির্বাচনে হারা বা জেতা, দিন কয়েকের মধ্যেই আবার কাজ শুরু, এটাই আজকের বিজেপি, তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে হঠাৎ হঠাৎ রাহুল গান্ধী ভ্যানিস, কোথায় কেউ জানে না। রাহুল গান্ধীর ভবিষ্যৎ নিয়ে এক ছটাকও চিন্তা আমার নেই, কিন্তু কংগ্রেস নিয়ে আছে, তার আদর্শ নিয়ে আছে, এই সময়ে কংগ্রেসের দূর্বল হয়ে যাওয়া বিজেপি কে আরও একটু বেশি অক্সিজেন যোগাবে। সেটাই সমস্যা।