বাংলা গানের 'ধূমকেতু' সুমন চট্টোপাধ্যায় অধুনা কবির সুমন। যেমন হঠাৎ আকাশ আলো করে এসেছিলেন, তেমনই কালো করে 'গানের লড়াই' থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। এক ধ্বংসাত্মক প্রতিভার নাম সুমন। ন্যাকা ন্যাকা বাংলা প্রেমের গানের গোলাপ ইত্বর ছড়ানো মেহফিলে বাবু-বিবির বুঁদ হয়ে থাকার বিলাস কাটিয়ে দিয়েছিলেন এক ঝটকায়। হেমন্ত-সন্ধ্যা-মান্না-শ্যামল-মানবেন্দ্রর যুগে এমন এক ঝড় তুলেছিলেন যাতে পুরনো বটবৃক্ষরাও নড়ে উঠেছিলেন। গৌরীপ্রসন্ন, শ্যামল গুপ্ত, সুধীন দাশগুপ্ত, নচিকেতা ঘোষ, সলিল চৌধুরী, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো বাঘা কৃতীদের সাগরে সুনামি তোলা সুমন বৃহস্পতিবার ৭৫ বছরে পা দিলেন। তাঁর জন্য রইল অসংখ্য শুভেচ্ছা-অভিনন্দন।
স্বাধীনতার আগে থেকেই বাংলা গানে ছিল প্রধানত প্রেমের সুর। কিছু গান অবশ্য দেশাত্মবোধকও ছিল। তারপর বাংলা গানে লাগল গণসঙ্গীতের নতুন ঢেউ। হেমাঙ্গ-দেবব্রত-সলিলের যুগ। বাংলা জুড়ে তখন সমাজ পরিবর্তনের সুর। কাস্তেটা শান দেওয়ার সেই সময়েও বাংলা গানের সংস্কৃতি মধ্যবিত্তের মনে কোনও পরিবর্তনের দোলা জাগাতে পারেনি। বাংলা চলচ্চিত্র ও বাংলা গান তখনও প্রেমের নেশায় চোখ ভাসাচ্ছিল। এভাবে পথ চলতে চলতে বাঙালি যখন 'এই পথ যদি না শেষ হয়ের' পথে নিজের লড়ঝড়ে ট্রেনটাকে রেললাইনে তুলে ঘুমিয়ে পড়েছিল, তখনই উড়িয়ে ধ্বজা অভ্রভেদী রথে তিনি এলেন। একটানে ছিঁড়ে ফেললেন অতীতের সব ন্যাকামি, চারপাশের পৃথিবী থেকে মুখ ঢেকে প্রেমের নামে ভণ্ডামি। জীবনের কর্কশ, উদ্দেশ্যহীন বেঁচে থাকা, প্রাণহীন বাস্তব, শরীরী কাম, অদম্য লড়াই সব উঠে এল তাঁর কলমে।
তাঁর গানের তালিকা তুলে ধরতে চাই না। জেবন বেত্তান্ত লিখতেই বসিনি। আমার কানে সুমন কেমন, সেটাই বোধই তুলে ধরতে চাই। সুমনের শুরু কলকাতা রেডিওতে রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে। তিনি যদি জীবনে কোনওদিন কোনও গান না লিখতেন এবং না গাইতেন, তাতেও কিস্যু যায় আসত না। তাঁর কণ্ঠের রবীন্দ্রসঙ্গীতই সুমনকে আরও ১০০ বছর বাঁচিয়ে রাখতে পারে। দেবব্রত বিশ্বাসের পর রবীন্দ্রসঙ্গীতের ওই কণ্ঠ, ওই ঘরানা, ভাবমাধুর্য, শব্দের প্রতিক্ষেপণ সবই যেন অব্যর্থ নিশানা ভেদ করে মস্তিষ্কের উপশিরায় ধাক্কা দেয়। সুমনের রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনলে চোখ বুজে ভাবা যেতে পারে খোদ রবি ঠাকুর বসে শুনছেন তাঁর গান।
হ্যাঁ, অনেকেই তাঁর তথাকথিত জীবনমুখি গান নিয়ে তরজা চালাতে পারেন। কিন্তু, আমার মতে, সাহিত্যমাত্রেই তো জীবনমুখি। জীবনের রস না থাকলে তা কী করে গান, কবিতা, উপন্যাস হয়ে উঠবে। সুমনের আগের পর্বেও তা ছিল, পরবর্তীতেও তা আছে। কিন্তু, তাঁর গানের বিশেষত্ব হচ্ছে সুমনের আগে এভাবে কেউ বাঙালির ভণ্ডামির মুখোশটি খুলে নাঙ্গা করে দেয়নি। তিনি বুঝিয়ে দিলেন, তৎকালীন বাংলা গানের ভগবানরা বৃদ্ধ হয়েছেন। পক্ককেশী বাঙালির ঘরে কলিং বেল বাজিয়ে জানিয়ে দিলেন, হাল ছেড়ো না বন্ধু, বরং কণ্ঠ ছাড়ো জোরে...। এক যুগসন্ধিক্ষণের কবি-গায়ক হিসেবে বাংলা গানে পর্বতারোহণ শুরু হল। গানের কথা ও সুরের এক গবেষণাগারের ভিত পুঁতে দিলেন। যেখানে মাথা সেঁদিয়ে দিলেন আরও অনেকে।
জীবনমুখি নয়, জীবনের গান ধরলেন সুমন। যাঁরা এতদিন ন্যাকাকাঁদুনির গান শুনে অভ্যস্থ হয়ে উঠেছিলেন, তাঁরা রে রে করে উঠলেন। এটা আবার গান নাকি! কিন্তু, তাঁর গান ধুতি পরা বাঙালিকে ইংলিশ প্যান্ট পরতে শিখিয়ে দিল। হারমোনিয়ামের প্যানপ্যানানি ছেড়ে গিটার ধরল বাঙালি। টাইপ রাইটার ছেড়ে কি বোর্ডে আঙুল রাখার মতো বদল এল কানে।
অনেকেই সুমনের ধর্মান্তরণ, রাজনীতিতে যোগ, বিভিন্ন সময় ঠোঁটকাটা মন্তব্য, শরীর-কামরসে আসক্তি নিয়ে নানা বিতর্ক তৈরি করেছেন। কিন্তু, বরাবরই সুমন এসবের ঊর্ধ্বে থেকে গিয়েছেন। কারণ, একটাই এসব ছোট ছোট বৃত্তে তাঁকে ধরা যায় না। তাঁর পেটকাটি-চাঁদিয়াল আকাশের খোলা বাতাসে পতপত করে উড়ে বেড়িয়েছে। আর সুমনের পা সাইকেল রিকশর প্যাডেলে পা রেখে এগিয়ে গিয়েছে চোখ ভরা স্বপ্ন ও বুক ভরা ইচ্ছেকে ভর করে।
তাই আজও মন খারাপ করা বিকেল এলেই মনে পড়ে তাঁর গান। সকলের অলক্ষ্যেই চোখের সামনে ফুটে ওঠে এক পাগল সাপলুডো খেলছে বিধাতার সঙ্গে। ঠিক যেমনভাবে কবির সুমন নিজেও খেলে গেলেন তাঁর প্রতিভার সঙ্গে। কদর করলেন না, খেয়াল করলেন না, পরোয়াও করলেন না, পাওয়া ও না-পাওয়ার হিসেবের খাতাটার। সে কারণে নিজেই বলে গিয়েছেন, যদি ভাবো কিনছ আমায় ভুল ভেবেছ.../আমাকে না আমার আপস কিনছো তুমি/ বল কে জিতল তবে জন্মভূমি, জন্মভূমি?
শেয়ার করুন