আপনি সাংবাদিক? নরেন্দ্র মোদি কি আম চুষে খান না চেটে খান? এরকম প্রশ্ন না করে বেকারত্ব বা মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন করছেন? যে প্রধানমন্ত্রী আজ পর্যন্ত অনুগত শিরদাঁড়াহীন সাংবাদিক বা ভাঁড়েদের ছাড়া কারও মুখোমুখিই বসেননি, তিনি জবাব দেবেন কেন? আপনি দেশের সরকারের সর্বত্র গেরুয়াকরণ নিয়ে চিন্তায় আছেন, মানুষকে সেই কথা জানাতে চাইছেন, লিখছেন? আপনি দেশের সংবিধান নিয়েই চিন্তিত যে সংবিধানকে আমূল বদলানোর কথা বলছেন নকড়া ছকড়া নেতা নন, উচ্চিংড়ের মতো কিছু ভক্ত নন, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই এখন সর্বসমক্ষে কেবল বলছেন না, দাবি করছেন যে পাল্টে দেওয়া হবে সংবিধানকে। আপনি লিখছেন যে সংবিধানের বেসিকস, সংবিধানের মূল ভিত্তিকে বদলে দেওয়ার কোনও সুযোগ নেই, যে মূলভিত্তির উপর নির্ভর করে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামীরা দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়েছিলেন, স্বাধীনতা এনেছিলেন, সেই ভিত্তিভূমিকে পরিবর্তন করা যায় না, আপনি এটা মানুষকে বোঝাতে চাইছেন? বোঝাতে চাইছেন যে সেই স্বাধীনতা সংগ্রামের দিনগুলোতে যারা গদ্দারি করেছিল, যারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, যারা মুচলেকা দিয়ে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছিল, তারা আজ সংবিধান বদলাতে চায়? আপনি বলতে চাইছেন বৈচিত্র্যের মধ্যে এক ঐক্য নিয়ে তৈরি হয়েছে আমাদের দেশ, এক ভাষা, এক ধর্ম এক নেতার মত ফ্যাসিস্ট স্লোগানের ভিত্তিতে নয়। তাহলে আজ নয় কাল আপনি জেলে থাকবেন। আজ যদি বাইরে থাকেন তাহলে জেনে রাখুন আপনার প্রতিটি লেখা স্ক্যান হচ্ছে, আপনার প্রতিটা বক্তব্যের ফাইল তৈরি হচ্ছে, আপনাকে জেলে পোরা হবে।
এবার আপনি মনে করতেই পারেন, আপনি বুক ঠুকে চ্যালেঞ্জ জানাতেই পারেন যে আপনাকে জেলে পোরা হোক, সত্যি কথা বলার জন্য, এই মুহূর্তে দেশের মানুষের কাছে জরুরি কথাগুলো বলার জন্য আপনাকে জেলে পোরা হোক, সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গি জাতীয়তাবাদের যে আবহ তৈরি হয়েছে তার বিরুদ্ধে বলার জন্যে আপনাকে জেলে পোরা হোক, আপনি স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন বলে আপনাকে জেলে পোরা হোক। আপনার প্রতিবাদকে থামিয়ে দেওয়ার জন্য যে ফ্যাসিস্ট সরকার আসলে আপনার বশ্যতা চায় তার বদলে জেলে পোরা হোক আপনাকে। তাহলে বলব আপনি এখনও এই মোদি-শাহের ছকটাই বোঝেননি, আপনাকে এই লেখার জন্য জেলে পোরা হবে না। আপনি এক প্রতিবাদী মানুষ হিসেবে জেলে যাবেন না। আপনার মোবাইল ফোনের কোনও একটা ফাইলে পাওয়া যাবে কোটি কোটি টাকার গোপন লেনদেন, বা কোনও এক নীরব মোদি বা মেহুল চোকসির হিসেবের খাতাতে পাওয়া যাবে আপনার নাম, আপনাকে চুরির দায়ে, কোটি কোটি টাকা তছরুপের দায়ে জেলে পোরা হবে। কোনও এক ফোরটোয়েন্টি জেল খাটা আসামির বয়ানের ভিত্তিতে আপনাকে চুরির দায়ে জেলে পোরা হবে, আপনি সমাজে একজন চোর বলে পরিচিত হবেন, এটাই ছক। তারপর জনে জনে বোঝান যে আপনি চোর নন আপনি প্রতিবাদী।
আরও পড়ুন: দেশের একমাত্র বিজেপি মুসলমান প্রার্থীকে নিজের রোড শোতে রাখলেনই না মোদিজি
এই খেলার আরও এক কদর্য হতাশাজনক রূপ আছে, তা হল দেশের সরকার বিরোধী রাজনোতিক দলগুলো, যারা ঐক্যবদ্ধভাবে এই প্রতিবাদে শামিল হতে পারত, যারা সব্বাই মিলেই বলতে পারত যে ওই মানুষগুলোকে আসলে তাদের প্রতিবাদকে থামিয়ে দেওয়ার জন্য ভুয়ো অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে, তাহলে অনেক মানুষ বুঝত। বহু রাজনৈতিক দল সিদ্দিকি কাপ্পনকে হাথরস থেকে কেন ধরা হল বলে গলা ফাটাচ্ছেন, তাদের পাশে দাঁড়িয়েই আরেক দল বিরোধী রাজনীতির মানুষ তখন নির্বাক, কারণ তাদের কাছে সিদ্দিকি কাপ্পন ইসলামিক টেররিস্টদের মদতদাতা। যখন নিউজ ক্লিকের মালিক সম্পাদক জেলে তখন যে বাম বিপ্লবী দলেরা সেমিনারে গলা তুলে বলছেন এ অন্যায়, এ ষড়যন্ত্র, তারাই চুপ করে আছেন কলকাতা টিভির মালিক সম্পাদক কৌস্তুভ রায়ের গ্রেফতারিতে, যে কৌস্তুভ রায় অন্তত এই বাংলার বামেদের গাড়ি পোস্টার ব্যানার প্রচারের টাকা জুগিয়েছেন, এই সেই দিন পর্যন্ত, আজ যখন তিনি প্রকাশ্যেই বলেন যে আরএসএস–বিজেপির বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মমতা বা তৃণমূল দলকেও সমর্থন করা উচিত, তখন সুজন চক্কোত্তি, বিমান বসুরা পুরনো কথা ভুলে, তাঁর গ্রেফতারি নিয়ে কোনও কথাই বলেন না, আর বলবেনই বা কেন? কারণ তাঁরা দিল্লিতে কেজরিওয়ালের গ্রেফতারের বিরোধিতা করছেন বা ঝাড়খণ্ডে হেমন সোরেনের গ্রেফতারের প্রতিবাদ করছে, সেই তাঁরাই তো এ রাজ্যে মমতা, অভিষেকের জেল চাইছেন, তাঁদের সহযোগী জোট পার্টনার ৩৬৫ ধারা প্রয়োগ করে নির্বাচিত সরকারকে ফেলে দিতে বলছেন। আর এই স্ববিরোধিতা মোদিজির কাছে অস্ত্র, জনসভায় জনসভায় খ্যাক খ্যাক করে হাসছেন আর বলছেন, ওহ লোগ তো আপস মে লড় রহে হ্যায়, কেরল মে কুস্তি, বঙ্গাল মে দোস্তি। রাহুল গান্ধী কো হরানে কে লিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি হি কাফি হ্যায়। তাই তো, কেরালার ওয়েনাডে মুখোমুখি সিপিআই রাজ্য সম্পাদকের স্ত্রী অ্যানি রাজা। কেবল বামেদের নয়, এই স্ববিরোধিতা সর্বত্র, ইন্ডিয়া জোটের প্রায় প্রতিটা দল এই স্ববিরোধিতায় ভুগছে আর সেই ফাঁকে বেহুলা লখিন্দরের বাসরঘরে ছিদ্র দিয়ে ঢুকে পড়ছে কালনাগিনী। কলকাতা টিভির সম্পাদক কবীর সুমনের গান গাইছিলেন,
রাই জাগো রাই জাগো শুক সারি বলে,
তোমার ঘুমের সুযোগ নিয়ে বাড়ল কারা দলে।
রাই জাগো রাই জাগো বলে দেশের পাখি,
শ্যাম শামসুল ভাইয়ে ভাইয়ে দাঙ্গা হবে নাকি?
রাই জাগো রাই জাগো পাখিরা দেয় ডাক,
ধর্ম জিগির তুলছে যারা তারা নিপাত যাক।
রাই জেগো না রাই জেগো না বলছে পদ্ম ফুল,
সজাগ থাকার যুক্তিগুলো কাদের চক্ষুশূল !
রাই জাগো রাই জাগো ঘরে ঢুকছে কেউটে সাপ,
তোমার ঘুমের সুযোগ নিল রাম, রুটি, ইনসাফ।
শুনছে কে? এবার তিনিই আদালতকে জানালেন সেই কথা। সাফ বললেন নির্বাচন চলছে, সেখানে তাঁর ভূমিকা থাকাটা জরুরি, তিনি এর আগে এমনকী মুখ্যমন্ত্রীরও সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, এই সাধারণ নির্বাচনে একজন সাংবাদিক সম্পাদক হিসেবে তাঁকে তাঁর কাজ করতে দেওয়া হোক। মজার কথা হচ্ছে বিচারক সেই কথাগুলো উড়িয়ে দেননি, তিনিও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ট্রায়াল চালু করার কথা বলেছেন। তিনি যে কথাগুলো বলেছেন, সেই কথাগুলো অন্যান্য বহু মামলার বিখ্যাত উকিল কপিল সিব্বল, মনু সিংভিরাও বলছেন। কৌস্তুভ রায় বলেছেন প্রি ট্রায়াল কনভিকশনের কথা, একজনকে ধরা হল একটা অভিযোগে, সেই বিষয় আদালতে আসার আগেই সেই মানুষটার ৬/৮/১০ মাস কি ৪/৫/৬ বছর কেটে গেল জেলে। এই তো ক’দিন আগে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জি এন সাইবাবা জামিন পেলেন, বহু মামলা থেকেও মুক্তি পেলেন, কিন্তু এই জামিনের আগেই তাঁর ৫ বছর জেল খাটা হয়ে গেছে। ওদিকে সোমা সেন, পাঁচ বছর পরে জামিন পেলেন, কেন? কারণ তাঁর বিরুদ্ধে প্রাইমা ফেসি এভিডেন্স, সাধারণ সাক্ষ্য প্রমাণও নেই। সিদ্দিকি কাপ্পন একজন সাংবাদিক, তিন বছর পরে জামিন পেলেন, জামিনের কথা শুনে তাঁর স্ত্রী বলেছিলেন, বাড়ি ফিরুক, না আঁচালে বিশ্বাস নেই। কারণ এর আগে তিনি জামিন পেয়েছিলেন, জেল থেকে বের হওয়ার মুখে তাঁকে আবার গ্রেফতার করা হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে প্রচার চলছে, ভারতের জমির উপর যারা আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে সেই চীনের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন নিউজ ক্লিকের মালিক, একবারও তো আদানিকে ধরা হচ্ছে না যার পাকিস্তানে রমরম ব্যবসা চলছে? আর ধরা হবেই বা কেন? পাকিস্তান বা চীনের সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ এমন কোনও আইন তো জারি হয়নি।
কিন্তু দুরাত্মার ছলের অভাব হয় না, তুই নয় তো তোর বাপ চোর বলে জেলে পুরে দিচ্ছে। এবং আকারে প্রকারে অরবিন্দ কেজরিওয়াল বা আমাদের কলকাতা টিভির সম্পাদক কৌস্তুভ রায়ের মামলার চরিত্র প্রায় এক। বছর আড়াই আগে একজনকে ধরা হয়েছিল দিল্লি লিকার মামলাতে, বছর তিনেক আগে একজনকে আদালত যাবজ্জীবন জেলের সাজা দিয়েছিল কলকাতায়। তিহাড় জেলের সেই অভিযুক্তের বয়ানের ভিত্তিতেই অরবিন্দ কেজরিওয়াল এখনও জেলে, আর আলিপুর জেলের সেই সাজাপ্রাপ্ত ফোরটোয়েন্টির অভিযোগের ভিত্তিতে আমাদের সম্পাদক এখন জেলে। মোদিজি ভাষণ দিয়ে বেড়াচ্ছেন, বরং বলা ভালো চতুর্দিকে মিথ্যে বলে বেড়াচ্ছেন, তীব্র বিষ ছড়িয়ে বেড়াচ্ছেন, এবং তাঁকে ঠান্ডা রাখার জন্য টন টন এসি লাগানো হচ্ছে মঞ্চে, সাহেব যেন ঘেমে না যান, উনি নাকি চা বিক্রি করতেন, উনি নাকি ফকির। এদিকে এই অসহ্য গরমে জেলে বন্দি নির্দোষ মানুষ কষ্ট পাচ্ছেন, বিচার শুরুই হচ্ছে না, জেলের যাবতীয় কষ্ট সহ্য করছেন। এবার বিচারক অন্তত সেটা শুনলেন, বললেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিচার প্রক্রিয়া শেষ করব, জামিন দেওয়া যায় মনে করলে তা দেওয়াও হবে। আমরা জানি বিচার ব্যবস্থাতেও ঘুন লেগেছে, কিন্তু তারপরেও ইদানিং কিছু রায় দেখে আমাদের মনে হয়েছে সব শেষ হয়ে যায়নি, ফকিরের চুরি তো সামনে আনল এই আদালতই। তাই আমরা আমাদের সম্পাদকের মুক্তি চাইছি না, জামিনও চাইছি না, চাইছি জাস্টিস, জাস্টিস ফর অল সিটিজেন, জাস্টিস ফর ফোর্থ পিলার অফ দ্য স্টেট, জাস্টিস ফর কলকাতা টিভি, জাস্টিস ফর কৌস্তুভ রায়।