মাথার উপরে বসে থাকা নেতা যদি টোয়েন্টি ফোর ইন্টু সেভেন মিথ্যেই বলেন, মিথ্যের গজদন্ত মিনারেই যে সরকারের বসবাস, সেই সরকারের দু’ নম্বর মাথাটি খামোখা সত্যি বলবে কেন? সত্যি কথা বলাটা এক অভ্যাস, সকালে ওঠার মতো, বই পড়ার মতো, হঠাৎ সত্যবাদী হওয়া যায় না। তো আমাদের অমিত শাহ সেই দলেই পড়েন। ভোট এলেই বিভিন্ন দলের নেতারা মানুষের সামনে মিথ্যেই বলবে, এ তো জানা কথা, গায়ে মাথায় সাবান মাখিয়ে দেবে, আমি তোমাদেরই লোক বলে জড়িয়ে ধরবে, আর প্রতিশ্রুতির পর প্রতিশ্রুতি। কিন্তু সেখানেও অমিত শাহ ইউনিক, তাঁর মিথ্যেগুলো অন্য মাত্রার। ক’দিন আগে বললেন, বামপন্থীরা মানুষের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়, ওদের ভোট দেবেন না। গডসের হাতে কে তুলে দিয়েছিল ইতালিয়ান বেরেত্তা পিস্তল? বামপন্থীরা? কালবুর্গি, দাভোলকর থেকে গৌরি লঙ্কেশের হত্যাকারীদের হাতের অস্ত্র কে জুগিয়েছিল? কারা সেই উন্মত্ত জনতার হাতে পেট্রল, ছুরি আর তলোয়ার জুগিয়েছিল গুজরাত দাঙ্গার সময়? যে অস্ত্র দিয়ে চোখের পলকে ভেঙে ফেলা হল এক ঐতিহাসিক সৌধ, সেই অস্ত্র কারা জুগিয়েছিল? হঠাৎ বেড়াল বলে মাছ ছোঁব না, মাছ খাব না কাশী যাব? আমরা বিশ্বাস করে নেব? যারা জ্যান্ত মানুষ পুড়িয়ে মারে তাদের মুখে অহিংসার বাওয়াল শুনব? সেই অমিত শাহ বাংলায় আপাতত ডেলি প্যাসেঞ্জারের ভূমিকায়। কেবল পরিবর্তন হল এবারে আর ওই পাত পেড়ে খেতে বসার নৌটঙ্কিটা করছেন না, আবার মাছ মাংসের প্রসঙ্গ চলে আসবে, আগের বার যাঁদের বাড়িতে পাত পেড়ে খেয়ে গেছেন তাঁদের দু’ চার জন অন্য সুরে গাইছেন। তাই এবারে ওই নৌটঙ্কির আয়োজন নেই। তিনি মিছিল শুরু করছেন শ্যামাপ্রসাদের মূর্তি থেকে, মালা পরানোর কথা ভুলেছেন, আর শেষ করেছেন রবি ঠাকুরের মূর্তির পাশে, সেখানেও একটা পেন্নাম ঠোকেননি, চোলায় চোলায় বাজবি জোয়ের ভেড়ি, বেলুরঘাট তো আমরা জানি। কিন্তু এবার সেই মিথ্যের ঢাক আরও জোরে বাজছে, সেটাই বিষয় আজকে অমিত শাহের ভোট প্রচার মানে মিথ্যের ফুলঝুরি।
বেশ কিছুদিন আগে থেকেই এই মিথ্যাচার শুরু হয়েছে, নাগরিকত্ব বিল আনার পর থেকেই বাংলার মতুয়া সমাজের কাছে এক অলীক কল্পনার নাগরিকত্বের গাজর তুলে ধরা হয়েছিল। এই মতুয়া সমাজের এক অংশ বহু আগেই বাংলাদেশ থেকে এখানে এসেছেন, বসবাস শুরু করেছেন, ঘরবাড়ি করেছেন, ছেলেমেয়েরা চাকরি বাকরি শুরু করেছে, তারাও আজ তৃতীয় কি চতুর্থ প্রজন্মের মুখ দেখেছে। তাঁরা ভোটার, ভোট দিয়েছেন, সিপিএম, তৃণমূল আমলে কেবল নয় তারও আগে কংগ্রেসি আমলেও।
আরও পড়ুন: Aajke | ২৫৭৫৩ চাকরি বাতিল, উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে?
নাগরিকত্বের কোনও প্রশ্নই আসেনি, এঁদের প্রত্যেকের, হ্যাঁ দায়িত্ব নিয়ে বলছি এঁদের প্রত্যেকের ভোটার কার্ড আছে, আধার কার্ড আছে, অনেকের পাসপোর্ট আছে, এঁদের দু’ একজন উচ্চ মানের গঞ্জিকা সেবন করার জন্যই অস্ট্রেলিয়া যান। হঠাৎ তাঁদের বলা হল আপনাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। চাল, ডাল, অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা, চাকরি নয়, নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। যাঁরা এতদিন ধরে এদেশে আছেন, ভোটার কার্ড আছে, আধার কার্ড আছে, বাড়ি আছে, চাকরি আছে, তাঁরা নাগরিক নন। ওনাদের বলা হল, নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। নাগরিকত্ব বিল আনা হয়ে গেছে, কিন্তু সেই নাগরিকত্ব আর দেওয়া হয় না। এমপি বলছেন মুখ দেখাব কী করে ভাবছি না, চামড়া বাঁচাব কী করে? নির্বাচন ঘোষণার ক’দিন আগে বলা হল, লাগু হয়ে গেছে নাগরিকত্ব বিল। তো দেখা গেল সেই ফর্মে প্রথমেই জানাতে হবে আপনি বাংলাদেশি, মানে বিদেশি, তারপরে আপনাকে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে হবে। মতুয়া সমাজে প্রথমে তো ডঙ্কা বাজানো হল, তারপরে এই ফর্ম ইত্যাদি সামনে আসতেই একটা প্রশ্ন তো এল সবার মনে, যে শান্তনু ঠাকুর যিনি মতুয়া, তিনি কি এই ফর্ম মেনে আবেদন করবেন, কোন তূরীয় মেজাজে ছিলেন জানি না, বলে দিলেন হ্যাঁ, আমিও আবেদন করবো। বিকট হইচই শুরু হল, তার মানে এতদিন, পাঁচ পাঁচটা বছর একজন বিদেশি আমাদের সাংসদ ছেলেন, কী কাণ্ড। তারপর থেকে তিনি চুপ। সিএএ এখন ওনাদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে, একটা প্রশ্নের জবাব নেই তার উপরে আগের কিছু সিসিটিভি ফুটেজ বেরিয়ে এসে পুরনো চুরি ছ্যাঁচড়ামির ঘটনায় ভারি বিব্রত বিজেপি নেতৃত্ব। এদিকে অন্তত দু’খানা আসন জলে ভেসে যাবে, ওদিকে ৪০০ পারের ক্ল্যারিওন কল দেওয়া হয়ে গেছে। অতএব ছোটা মোটা ভাই অমিত শাহ মাঠে নামলেন, নতুন করে মিথ্যে বলতে। মতুয়ারা নাগরিক? অনেকে নয়? কীভাবে জানলেন? আছে, চেক করলেই ধরা পড়ে যাবে। কীভাবে চেক করবেন? এনআরসি করে? না, সিএএ দেওয়া হবে। কাদের? যাঁরা নাগরিক নন। কারা নাগরিক নন? চেক করে জানা যাবে। এনআরসি করা হবে? চেক করা হবে। মিথ্যের পর মিথ্যে বলেই চলেছেন। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে নাগরিকত্বের নামে বিজেপি যে অবিরাম মিথ্যে বলে যাচ্ছে, তা কি আজও পরিষ্কার নয়? মতুয়ারা যদি নাগরিক নাই হন, তাহলে শান্তনু ঠাকুর ভোটে লড়ছেন কীভাবে? একজন বিদেশি কি নির্বাচনে দাঁড়াতে পারে? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
এদিকে মাত্র গতকালই খবর এল, অসমের ওদালগুড়িতে বর্ডার পুলিশের সুপার ট্রাইবুনাল ৩৭ জনকে বিদেশি ঘোষণা করেছে। ২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত এই মামলাগুলো জমা হয়েছে, তৃতীয় ট্রাইবুনালের ধর্মেশ্বর সাইকিয়া আর রিনা হাজারিকা ৩৭ জনকে ১৯৭১ পরবর্তী বিদেশি বলে ঘোষণা করেছেন, যার মধ্যে ২৩ জন বাঙালি হিন্দু। সত্যিটা বেরিয়ে আসছে, চরম বাঙালি বিদ্বেষী এই মোদি–শাহের সরকার সিএএ-র নামে কোন অরাজকতা নামিয়ে আনতে চায় তাও পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। বাংলার মতুয়া সমাজের এই খবর জানা উচিত, মিথ্যেবাদী কারা, কারা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, তা জানা উচিত, তাঁদের কাছে এই খবর পৌঁছে দেওয়া উচিত।