কলকাতা টিভিতে আয়কর হানা। আয়কর দফতরের অতিসক্রিয়তা ১৬ থেকে ১৯ অগাস্ট। টানা ৮০ ঘণ্টা তল্লাশি। তল্লাশির নামে সাংবাদিক ও অসাংবাদিক কর্মীদের সাংবিধানিক অধিকার খর্বের অভিযোগ। পাশাপাশি আধাসামরিক বাহিনীকে সঙ্গে এনে হুমকি ও হেনস্তা। এই অভিযোগ নিয়েই কলকাতা হাইকোর্টে ৬টি মামলা দায়ের। মামলার সওয়াল পর্বে বিচারপতি নিজামুদ্দিনের এজলাসে দীর্ঘ শুনানি। শুনানিতে অংশ নেন আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, অরুণাভ ঘোষ, বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য, সপ্তাংশু বসু ও ফিরোজ এডুলজি। যদিও আবেদনকারীর আইনজীবীদের সওয়ালের বিরোধিতা করেন আয়কর দফতরের কৌঁসুলি বিপুল কুণ্ডুলিয়া।
এদিন সওয়াল পর্বের শেষে আয়কর দফতরকে আগামী ২৯ সেপ্টেম্বরের মধ্যে এই সংক্রান্ত সব তথ্য-নথি আদালতে পেশ করার নির্দেশ দেন বিচারপতি নিজামুদ্দিন। সোমবার মামলার শুনানি চলাকালীন আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন: আয়কর তল্লাশির নামে সাংবাদিক এবং অ-সাংবাদিক কর্মীদের হেনস্তা করা হয়। আটকে রাখা হয় টানা প্রায় ৮০ ঘণ্টা। কেটে দেওয়া সিসিটিভি সংযোগ। কেড়ে নেওয়া হয় সাংবাদিক মোবাইল ফোন, পিসিআর দখলে নিয়ে নেয় আধা-সামরিক বাহিনী। আয়কর আইনে আধা-সামরিক বাহিনী নিয়ে প্রথমেই তল্লাশি বাধ্যতামূলক নয়। প্রথমে তারা তল্লাশি চালাবে। যদি প্রতিরোধ হয়, স্থানীয় পুলিশের সাহায্য নেবে। যদি স্থানীয় পুলিশ সহযোগিতা না করে, তখন আধাসামরিক বাহিনীর সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে কোনও নিয়মই মানা হয়নি। এছাড়াও, আয়কর আইনে আছে, তল্লাশির আগে নোটিশ দিতে হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে, সার্চ ওয়ারেন্টে নাম না থাকা সাংবাদিক, অসাংবাদিক কর্মীদের নোটিশ না দিয়েই তাদের ব্যক্তিগত লকার, কম্পিউটারে তল্লাশি চালায় তারা। এমনকি মহিলা কর্মীদের ব্যাগ ও মোবাইল সার্চ করে তারা। সার্চিংয়ের সময় কোনও আয়কর দফতরের মহিলা আধিকারিক উপস্থিত ছিলেন না। রাজ্যের বর্তমান পরিস্থিতিতে এটা পরিষ্কার, সিবিআই, ইডি ছাড়া যে কোনও কেন্দ্রীয় সংস্থার বিরুদ্ধে কথা বললেই তাদের প্রতিহিংসার মুখে পড়তে হচ্ছে। তার থেকে বাদ যাচ্ছেন না আইনজীবীরাও।
আইনজীবী অরুণাভ ঘোষ: মিডিয়ার উপর পরিকল্পিতভাবে হামলা চালানো হয়েছে। নির্দিষ্ট আইনের বাইরে গিয়ে তল্লাশির নামে হেনস্থা করা হয়েছে সাংবাদিকদের। মহিলা সাংবাদিকদের হেনস্থা করার কোনও এক্তিয়ার আয়কর দফতরের নেই। সংবাদমাধ্যমের কন্ঠ রুদ্ধ করার চেষ্টা চালাচ্ছে কেন্দ্র।
আইনজীবী সপ্তাংশু বসু: এক মহিলা সাংবাদিকের বাড়িতে আধাসামরিক বাহিনী পাঁচিল টপকে ঢুকেছে। সুচন্দ্রিমা পাল নামে ওই সাংবাদিক তাঁর শিশু সন্তানকে নিয়ে বালিগঞ্জের বাড়িতে একাই থাকেন। তাঁর বাড়িতে প্রথমে কোনও মহিলা আধিকারিক ছাড়াই তল্লাশি চলে। টানা ৪০ ঘণ্টা তল্লাশি চালানোর পর মহিলা আধিকারিকের দেখা মেলে। তাঁর বাড়িতে সিসিটিভিও বন্ধ রাখা হয়। তাঁর শিশু সন্তানকে স্কুলে যেতেও বাধা দেওয়া হয়। ফলে, শিশু সন্তান সেদিন পরীক্ষা দিতে যেতে পারেনি।
বিচারপতি নিজামুদ্দিন: বলেন কী? একজন মহিলা তাঁর শিশু সন্তানকে নিয়ে একা থাকেন, তাঁর বাড়িতে আধাসামরিক বাহিনী পাঁচিল টপকে ঢুকছে! তল্লাশিতে কী কী পাওয়া গেল?
আইনজীবী সপ্তাংশু বসু: চল্লিশ ঘণ্টা তল্লাশিতে তাঁর বাড়ি থেকে উদ্ধার হয় ১৯৫০ টাকা।
আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য: কলকাতা টিভির কর্ণধারের বাবা অজিত কুমার রায় প্রবীন নাগরিক। তাঁর শাশুড়িও ওই একই বাড়িতে থাকেন। তাঁরাও হেনস্তার হাত থেকে রেহাই পাননি। কোনও মহিলা আধিকারিক ছাড়াই তাঁদের বাড়িতে চলে তল্লাশি।
বিচারপতি নিজামুদ্দিন: এখানেও কি আধাসামরিক বাহিনী হাজির ছিল?
আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য: অবশ্যই। তল্লাশির নামে প্রবীন নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকারকে লঙ্ঘন করেছে আয়কর দফতর।
আইনজীবী ফিরোজ এডুলজি: আয়কর আইন অনুযায়ী তল্লাশির সময় ওই জায়গা সংলগ্ন বাসিন্দাদেরই সাক্ষী হিসেবে রাখতে হবে, কিন্তু এক্ষেত্রে তা হয়নি। তবে আমার আগের কৌঁসুলিদের সওয়ালকে সম্পূর্ণ সমর্থন করছি। আমার দাবি, আদালত সামগ্রিক তল্লাশির ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিক। কর্মরত অথবা অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এই ঘটনার তদন্ত করে আদালতে রিপোর্ট দিক। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত এসংক্রান্ত আয়কর দফতরের প্রক্রিয়ার উপরে স্থগিতাদেশ দিক আদালত। পাশাপাশি, কলকাতা পুলিশের অধীনে যে সমস্ত থানায় অভিযোগ দায়ের হয়েছে, তার রিপোর্ট তলব করুক হাইকোর্ট।
আয়কর দফতরের কৌঁসুলিকে বিচারপতি নিজামুদ্দিনের প্রশ্ন: কেন আপনারা স্থানীয় পুলিশের সাহায্য নিলেন না? প্রথমেই আধাসামরিক বাহিনীর প্রয়োজন হল কেন? সিসিটিভি বন্ধ করে দেওয়া হল কেন? যাঁদের বিরুদ্ধে সার্চ ওয়ারেন্ট নেই, কেন তাঁরা তল্লাশির সম্মুখীন হলেন? তাঁদের কি নোটিশ দেওয়া হয়েছিল? তল্লাশিতে মহিলা আধিকারিক রাখা হয়নি কেন?
এসবের কোনও সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেননি আয়কর দফতরের আইনজীবী। এরপরই বিচারপতির নির্দেশ, কোন তথ্যের ভিত্তিতে আধাসামরিক বাহিনী দিয়ে তল্লাশির প্রয়োজন হল, সেই তথ্য আদালতকে জানাতে হবে আয়কর দফতরকে। যাঁদের নাম সার্চ ওয়ারেন্টে ছিল না, তাঁদের তল্লাশি করা হল কেন? ২৯ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আয়কর দফতরকে তল্লাশি সংক্রান্ত সব তথ্য-নথি পেশ করতে হবে।