নয়াদিল্লি: ‘এবারে বিশ হাজার টাকা পণ এবং হাতে হাতে আদায়’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দেনাপাওনা’ গল্পের যুগ কি গিয়েছে? এককথায় উত্তর, না। তা সে গল্পের নিরুপমাই হোক কিংবা ভোপালের গুঞ্জন তিওয়ারি (নাম পরিবর্তিত)। তার উপর সে মেয়ের যদি দাঁত একটু উঁচু হয়। কপালে তিল থাকে। তাহলে মেয়ে ‘পার’ করতে দেওয়ালে কপাল ঠুকেও বাবা-মায়ের নিস্তার নেই। ২৭ বছরের অঙ্কে স্নাতকোত্তর মেয়ে ঘরে বসে অনলাইনে ছাত্র পড়ায়। তাতেও তাঁর বাবাকে ছেলের বাড়ির লোকের সামনে হাত জোড় করে বসে থাকতে হয় পণের উপর ‘ডিসকাউন্ট’ বা ছাড়ের ভরসায়।
মায়ের হাতে ভালো সাজগোজ করে, হাতের ট্রেতে চা-জলখাবার নিয়ে কাঁপাকাঁপা পায়ে কয়েক জোড়া চোখের দৃষ্টির ছুরির উপর দিয়ে বসার ঘরে ঢোকার আগে নিজের কানে শুনেছেন শব্দটা। ৫০-৬০ লক্ষ টাকা পণ নিয়ে দরাদরি চলার ফাঁকে পাত্রের বাবা গুঞ্জনের বাবাকে বলেছিলেন, মেয়ে সুন্দর হলে কিছুটা ডিসকাউন্ট করে দেব। কিন্তু, পণ দিয়ে কন্যাদায়গ্রস্ত বাবাকে নিষ্কৃতি দিতে নারাজ গুঞ্জন। সমাজের ঘাড়ে চেপে বসে থাকা অদৃশ্য ভূত তাড়াতে ওঝার দ্বারস্থ হয়েছেন ২৭ বছরের এই যুবতী।
আরও পড়ুন: Panchayat Election 2023 | DG | রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে, দাবি ডিজির
পুলিশের কাছে চিঠি লিখে আবেদন জানিয়েছেন, বিয়েবাড়িতে অভিযান চালানোর জন্য। বিবিসি দিল্লির সাংবাদিক গীতা পাণ্ডেকে ফোনে গুঞ্জন জানান, প্রতিটা বিয়েবাড়িতে ঢুকে যদি পুলিশ ছানবিন চালায়, তাহলে ভয়ে অন্তত রোজ পণপ্রথার বলি হতে হবে না শত শত ভারতীয় মেয়েকে। পাত্রপক্ষের সামনে সেজেগুজে বসাটা প্রায় অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছে গুঞ্জনের মতো মেয়েদের। তাঁর বাবা গত ৬ বছরে অন্তত ১০০-১৫০ পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। ২ ডজনের বেশি ছেলের বাড়ির সঙ্গে দেখা করেছেন। গুঞ্জন নিজেই ৬ বার মেয়েদেখার আসরে বসেছেন। কিন্তু, সবই ভেস্তে গিয়েছে পণের দাবির কারণে।
এদেশে পণপ্রথা নিষিদ্ধ হয়েছে ৬০ বছরেরও বেশি। তা সত্ত্বেও ১৯৫০ সাল থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত ৯০ শতাংশ বিয়েই হয়েছে পণ দেওয়া-নেওয়ার শর্তে। মেয়ের বাবা-মাকে পণ দেওয়ার জন্য ঘরবাড়ি, ঘটিবাটি বন্ধক দিতে হয়। জমি বেচতে হয়। তাতেও যখন কূল মেলে না, তখন মেয়ের ‘মরা মুখ’ দেখতে হয়। মেয়ের সুখের জন্য সর্বস্ব দিয়েও চিতার আগুনের শোকে দগ্ধ হতে হয়। জাতীয় ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭-২০২২ সাল পর্যন্ত ৩৫ হাজার ৪৯৩ জন অর্থাৎ দিনে ২০টি বধূমৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে দাবিমতো পণ আদায় না হওয়ায়।
সমাজকর্মীদের যুক্তি, এর পিছনে রয়েছে কন্যাভ্রূণ হত্যা। রাষ্ট্রসঙ্ঘের হিসেবে প্রতিবছর ৪ লক্ষ কন্যাভ্রূণ হত্যার ঘটনা ঘটে ভারতে। যার অন্যতম কারণ পণ। বাবা-মায়েরা পণ দেওয়ার ভয়ে কন্যাসন্তান জন্মাক তা চান না। নারী অধিকার কর্মী কবিতা শ্রীবাস্তব বিবিসিকে বলেছেন, পুলিশ পণপ্রথা ঠেকাতে পারবে না। কারণ এটা একটা অলিখিত আইন। সহজে নগদ প্রাপ্তির রাস্তা। বিনা শ্রমে ধনী হওয়ার উপায়। শুধু বিয়ের সময়ই নয়, বিয়ের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত অনেক ক্ষেত্রে সহ্য করতে হয়। আবার পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত হয় এই সংক্রমণ।
গুঞ্জন বলেন, আর পাঁচটা মেয়ের মতো আমিও বিয়ে করতে চাই। কিন্তু পণ না দিয়ে। আমাদের গ্রামের বাড়ির এলাকায় ২৫ বছরের অবিবাহিত মেয়েকে বুড়ি বলা হয়। বিয়ের বাজারে তাদের ‘রেট’ আরও বাড়তে থাকে। তাই তাঁর বাবাও ফেউয়ের মতো পাত্র খুঁজে বেড়াচ্ছেন। গুঞ্জনকে তাঁর বাবাই বলেছেন, ৬ বছর হল জামাই খুঁজছি। কিন্তু, পণ না দিয়ে বিয়ে দিতে গেলে ৬০ বছর কেটে গেলেও পাত্র পাব না।