Placeholder canvas

Placeholder canvas
HomeScrollচাঁদের দক্ষিণ মেরু, বিক্রম, প্রজ্ঞান ও কোয়েটার অবিশ্বাস্য গল্প

চাঁদের দক্ষিণ মেরু, বিক্রম, প্রজ্ঞান ও কোয়েটার অবিশ্বাস্য গল্প

Follow Us :

দিব্যেন্দু ঘোষ: ঘনঘোর ঘুম। খোলা আকাশের নীচে ওরা ঘুমিয়ে আছে। সন্তানসম প্রজ্ঞানের মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে বিক্রম। তার দুদিন পর সেও ঘুমিয়ে পড়েছে। তার আগে প্রায় একমাস ধরে তারা শুধুই ছুটেছে। আকাশ, বাতাস, নক্ষত্র, গ্রহ, উপগ্রহ, গ্রহাণু পেরিয়ে গন্তব্যের দিকে ছুটেছে। বড্ড কঠিন সে যাত্রা, ঘন অন্ধকারে নিজেকেই পথ দেখে নিতে হবে, মসৃণভবে নামতে হবে, কাজ করতে হবে, তুলে নিতে হবে বহু রহস্যের চাদর, দুনিয়াকে দেখিয়ে দিতে হবে নাম শুধুই বিক্রম নয়, কাজেও বীরবিক্রম। এবড়ো খেবড়ো মাটি, বড় বড় গর্ত আর একরাশ রহস্য। চোদ্দদিন ধরে সূর্যের আলো পড়ে তার পিঠে, তারপর টুক করে যখন ডুবে যায় সব আলো, আঁধার আরও জমাট হয়। দক্ষিণ মেরুতে সে ভয়ানক অন্ধকার, তাপমাত্রা মাইনাস দুশো থেকে তিনশো ডিগ্রিতেও নেমে যেতে পারে। তরল যে কোনও জিনিস জমে পাথর হয়ে যেতে পারে, জ্বালানি কঠিন হয়ে যাবে না তো! ইলেকট্রনিক সার্কিটগুলো ওই প্রবল ঠান্ডায় নষ্ট হয়ে যাবে না তো! প্রপালশন সিস্টেমটাই ভেঙে পড়বে না তো! উদ্বেগ নিয়েই ঘুমোতে যায় বিক্রম। এক চান্দ্ররাত শেষে জাগতে হবে, প্রজ্ঞানকেও জাগাতে হবে, বড় কঠিন কাজ। ঘুমের ভেতর স্বপ্ন দেখছে বিক্রম, সে জাগবে, প্রজ্ঞানকে আদর করে জাগাবে, কাজ করবে নিরলস, চাঁদের বুকে অক্সিজেন-হাইড্রোজেন খুঁজে পাবে, জলের অস্তিত্ব টের পাবে আর গোটা দুনিয়া জানবে এক অবিশ্বাস্য আবিষ্কারের কাহিনি। বিক্রম সারাভাই ঠিক স্বপ্ন দেখতেন, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হচ্ছে, আহ্লা্দে চোখে জল আসছে বিক্রমের।

হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল, সত্যিই কি ভাঙল? নাহ, একঝাঁক বিজ্ঞানী চেষ্টা করে চলেছেন, দিন নেই, রাত নেই, ঘুম নেই, চাঁদের মাটিতে শুয়ে থাকা বিক্রম-প্রজ্ঞানের ঘুম যে ভাঙাতেই হবে। ভারত পারবে, পারতেই হবে। তবে পদে পদে বাধা। চাঁদের দক্ষিণ মেরু, বড় ভয়ঙ্কর জায়গা। বড় ভয়ানক সব গর্ত, যেখানে প্রায়-স্থির সূর্যালোক তাদের ভেতরে পৌঁছয় না। এই ধরনের গর্তগুলি হল ঠান্ডা ফাঁদ যাতে হাইড্রোজেন, প্রাথমিক সৌরজগতের অন্যান্য উদ্বায়ী পদার্থের জীবাশ্ম রয়েছে। দক্ষিণ মেরু শ্যাকলটন ক্র্যাটারের ধারে অবস্থিত। অঞ্চলটি আলোকিত লাইবনিটজ মালভূমি দ্বারা ছায়াময়, ডানদিকে নোবিল ক্রেটার, বামে আংশিক ছায়াযুক্ত মালাপার্ট ক্রেটার এবং এর মালাপার্ট চূড়াটি হাওয়ার্থ ক্রেটারের রিমে আলোকিত। চাঁদের দক্ষিণ মেরু কোটি কোটি বছর আগে তার আসল অবস্থান থেকে ৫ ডিগ্রি সরে গেছে। দক্ষিণ মেরু অঞ্চলে অনেকগুলি গর্ত এবং অববাহিকা রয়েছে যেমন দক্ষিণ মেরু-আইটকেন অববাহিকা, যা চাঁদের অন্যতম মৌলিক বৈশিষ্ট্য এবং পর্বত, যেমন এপসিলন পিক, পৃথিবীর যে কোনও পাহাড় থেকে লম্বা। চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে এমন একটি অঞ্চল রয়েছে যেখানে ক্রেটার রিমগুলি প্রায় ধ্রুবক সৌর আলোকসজ্জার সংস্পর্শে আসে, তবুও গর্তগুলির অভ্যন্তর স্থায়ীভাবে সূর্যালোক থেকে ছায়াযুক্ত। সম্ভাব্য বরফ এবং অন্যান্য উদ্বায়ী বস্তুর অস্তিত্ব থাকতে পারে, তাই দক্ষিণ মেরু অঞ্চলের কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থান হল ঠান্ডা ফাঁদ, যেখানে জল এবং বরফ থাকতে পারে যা মূলত ধূমকেতু , উল্কাপিণ্ড এবং সৌর বায়ুর প্ররোচনায় লুকিয়েই আছে। এই ঠান্ডা ফাঁদে হাইড্রক্সিলও পাওয়া গেছে। এই দুটি যৌগের আবিষ্কার নিঃসন্দেহে যুগান্তকারী। চাঁদের তাপীয় আচরণের কারণে বরফ এই ফাঁদে থেকে যায় যা বিক্ষিপ্ত সূর্যালোকের মতো থার্মোফিজিক্যাল বৈশিষ্ট্য দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। চাঁদের এমন কিছু অঞ্চল রয়েছে যেখানে ভূত্বক চুম্বকীয় হয়। দক্ষিণ মেরুর আইটকেন বেসিন চৌম্বকীয় অসঙ্গতি হিসাবে পরিচিত। সব মিলিয়ে চাঁদের দক্ষিণ মেরু মানেই রহস্য, ঘন রহস্য। যে রহস্যের কিনারা করতেই আসরে বিক্রম, প্রজ্ঞান। কিরিটী কিংবা ব্যোমকেশ, ফেলুদা কিংবা কাকাবাবু, অমল সোম কিংবা শবরের স্টাইলের সঙ্গে ওদের কাজ সম্পূর্ণ আলাদা, সবটাই দুরন্ত প্রোগ্রামিং, অত্যাধুনিক প্রযুক্তির চমত্কার মিশেল। তবে ঘুম ভাঙতে হবে, ওরা ঘুমোচ্ছে, জেগে ওঠার অপেক্ষা।

বিক্রম-প্রজ্ঞানের ঘুম ভাঙার কথা বলতে মনে পড়ছে কোয়েটার কথা। ভয়ঙ্কর সে গল্প, সত্যি, একফোঁটা কল্পনা নয়, ঘোর বাস্তব। পাকিস্তানের যতগুলো বড় ও বিখ্যাত শহর রয়েছে, তার মধ্যে কোয়েটা অন্যতম৷ দেশটির দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত বালুচিস্তান প্রদেশের রাজধানী কোয়েটা। পাকিস্তান থেকে যত ফল রফতানি হয়, তার একটা বড় অংশ উৎপাদিত হয় কোয়েটায়। এর নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য অনেকে একে ‘খুদে প্যারিস’ বলেন।

সালটা ২০১৬। কোয়েটার একটা গ্রামে একই পরিবারের দুই সদস্যের মধ্যে এক অদ্ভুত রোগের সন্ধান পাওয়া যায়। অবাক হয়ে যান পৃথিবীর বাঘা বাঘা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। রোগটির পেছনে যথাযথ কারণের অভাবে নানারকম গুজব ও ষড়যন্ত্র তত্ত্বেরও উদ্ভব হয়। একজন আবদুল রশিদ, আরেকজন শোয়েব আহমেদ। একজনের বয়স নয়, অন্যজন তেরো। পাকিস্তানের আর দশটি শিশুর মতোই তাদের দেখতে, অন্যদের মতোই কথা বলে, খায়, ঘুমোয়, খেলা করে। কিন্তু যে রোগ তাদের শরীরে বাসা বাঁধে, তা পাকিস্তান তো বটেই, গোটা পৃথিবীতেই আর সেই রোগের অন্য কোনও রোগী পাওয়া যায়নি। সারাদিন দুই ভাই খেলাধুলা করে বেড়াত, পড়াশোনা করত, ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করত। দিনে একেবারে স্বাভাবিক জীবনযাপন। তাদের বয়সী শিশুদের যে স্বাভাবিক চাঞ্চল্য থাকে, সেটিও তাদের মধ্যে ছিল। কিন্তু আসল সমস্যা শুরু হত সূর্য ডোবার সময় থেকে। সূর্যের আলো মিইয়ে যেতে শুরু করলে দুই ভাই দুর্বল হয়ে পড়তে শুরু করত। রাত হলে তাদের চলাফেরার কোনও শক্তি থাকত না৷ কথা বলার, খাওয়ার শক্তিও লোপ পেত।

শোয়েব ও আবদুলের বাড়ি কোয়েটা শহরের কাছেই মিয়ানকুন্ডি গ্রামে। কোয়েটা শহর থেকে এই গ্রামের দূরত্ব মাত্র পনেরো কিলোমিটার। ওদের বাবা মহম্মদ হাশিম একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে কর্মরত। হাশিমের মোট ছটি সন্তান। এর মধ্যে দুজন রোগে ভুগে জন্মের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মারা যায়। বর্তমানে তার জীবিত সন্তানের সংখ্যা চার। এর মধ্যে দুজন আবদুল ও শোয়েব। তাদের আরেক ভাইয়ের মধ্যেও কিছুটা অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়৷ তাদের একটি বোন রয়েছে, তার মধ্যে কোনও অস্বাভাবিকতা দেখা যায়নি। মহম্মদ হাশিম কিংবা তাঁর স্ত্রীর মধ্যেও কখনও কোনও অস্বাভাবিকতা দেখা যায়নি। অর্থাৎ পুরো পরিবারে মোট তিনজন এই সমস্যায় ভুগছিল। আবদুল, শোয়েব ও তাদের ভাই মহম্মদ ইলিয়াস। স্থানীয় হাসপাতাল কোনও দিশা দেখাতে পারেনি। সন্তানদের ভাল কোনও হাসপাতালে নিয়ে যে চিকিৎসা করাবেন, সেই সামর্থ্যও ছিল না সামান্য মাইনের চাকরি করা মহম্মদ হাশিমের পক্ষে। তিনি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করতেন, তাঁর সন্তানেরা সূর্য থেকে শক্তি পায়। এই কারণে যখন সূর্য ডুবে যায়, তখন তারা শরীরের সমস্ত শক্তি হারিয়ে ফেলে। তবে ডাক্তারেরা তাঁর এই বিশ্বাসের সঙ্গে একমত হতে পারেননি। কারণ, ঝড়ের সময়ে কিংবা অন্ধকার ঘরে দিনের বেলায় দুই ভাই স্বাভাবিকভাবেই চলাফেরা করত, খেত কিংবা কথা বলত। তবে ডাক্তাররা রোগ ধরতে পারেনি, ফলে কোনও চিকিত্সাও করা যায়নি। অনেকেই তাদের ডাকে ‘সোলার কিড’ নামে। ২০১৬ পর্যন্ত এভাবেই চলেছে। তবে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ব্যাপক আলোচনা শুরু হতেই নড়েচড়ে বসে পাকিস্তানের বিখ্যাত হাসপাতাল পাকিস্তান ইন্সটিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সেস। সেখানে ভর্তি করা হয় দুই ভাইকে। প্রখ্যাত চিকিত্সক জাভেদ ওমর দুই শিশুকে দেখার পর অবাক হয়ে যান। তিনি বলেন, ঠিক কোন কারণে শিশু দুটির মধ্যে এই ধরনের অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, তা নিয়ে কোনও ধারণা নেই তাঁর। এই কেসটা তাঁদের কাছে একটা চ্যালেঞ্জ। অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষার পর তিনি বলেছিলেন, তাঁর ধারণা নিউরোট্রান্সমিটারের সমস্যার কারণে হয়ত ওই দুই শিশুর এই অস্বাভাবিক সমস্যা হচ্ছে। ওই হাসপাতালের আটাশজন অভিজ্ঞ চিকিৎসককে নিয়ে একটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয় এই দুই ভাইয়ের চিকিৎসার জন্য। তাদের দেহ থেকে বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহ করে জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো তেরোটি নামকরা প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হয়েছিল পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য। এসব ছিল অত্যন্ত ব্যয়বহুল, যার ব্যয়ভার বহন করা মহম্মদ হাশিমের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই সরকার এই দুই ভাইয়ের চিকিৎসার দায়িত্ব নেয়। এই দুই ভাই যে গ্রামে থাকত, সেই গ্রামের বেশ কয়েকটি জায়গা থেকে বাতাস ও মাটির নমুনা সংগ্রহ করা হয় পরীক্ষা করার জন্য। ইসলামাবাদের সেই হাসপাতালে যখন দুই ভাইয়ের চিকিৎসা চলছিল, তখনও দিনের বেলায় তারা স্বাভাবিক আচরণ করত। দিনের বেলায় তারা হাসিখুশি থাকত। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর হাসপাতালের ক্যান্টিনে তারা একসঙ্গে চা খেতে যেত। আর দশজনের মতো তারাও স্বপ্নের জাল বুনত। বড় ভাই শোয়েব বলেছিল, বড় হয়ে একজন শিক্ষক হতে চায়। একই প্রশ্নের উত্তরে ছোট ভাই বলেছিল, সে ধর্মীয় বিষয়ে পাণ্ডিত্য অর্জন করতে চায়। পাকিস্তান ইন্সটিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সেসের চিকিৎসকদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে তারা ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে।

আবদুল, শোয়েবের শরীরের সঙ্গে সূর্যের কী সম্পর্ক সে রহস্য আজও ভেদ হয়নি, কিন্তু বিক্রম-প্রজ্ঞান সূর্য ছাড়া নিস্তেজ, নিথর। তবে গল্প এখানেই শেষ নয়। চন্দ্রযান তিনের অভিযান এখানেই শেষ নয়। কারণ, ১৫ বছর আগের চন্দ্রযান ১ এখনও প্রচুর তথ্য দিচ্ছে বিজ্ঞানীদের। চন্দ্রযান তিনকে কীভাবে চন্দ্রযান-২-এর অরবিটার সাহায্য করেছে তা সবারই জানা। ফলে, চাঁদ, সূর্য, ভারত, পাকিস্তানের গল্প এখনও শেষ হয়নি।

RELATED ARTICLES

Most Popular