আবার মাঠে নেমেছেন অন্নদাতারা৷ গতকাল খুব স্পষ্ট ভাষায় কৃষক নেতারা বললেন, উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনে বিজেপিকে সাজা দিতে হবে, ভোট কা চোট, মানে খুব পরিষ্কার৷ যাকে খুশি ভোট দিন৷ বিজেপিকে দেবেন না৷ কারা ছিলেন সেই প্রেস কনফারেন্সে? ছিলেন রাকেশ টিকায়েত, ছিলেন দর্শন পাল সিং, যোগেন্দ্র যাদব, অবশ্যই ছিলেন মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরো সদস্য হান্নান মোল্লা, দলের কেন্দ্রীয় কমিটি সদস্য অশোক ধাওলে, দুজনেই সংযুক্ত কিসান মোর্চার অন্যতম নেতা, পোস্টার হাতে নিয়ে দাঁড়ালেন তাঁরা, তাতে স্পষ্ট লেখা বিজেপিকে সাজা দিতে হবে, তাহলে কাকে ভোট দেবে জনতা?
তাঁরা বললেন, যাকে খুশি৷ কৃষকরা নির্বোধ নয়৷ তারা এক বছর ধরে আন্দোলন চালিয়েছে৷ শীতে, গরমে রাস্তায় বসে থেকেছে৷ লাঠির ঘা খেয়েছে, জলকামান, টিয়ার গ্যাসের মুখে দাঁড়িয়েছে৷ বাধ্য করেছে এই সরকারকে আইন ফিরিয়ে নিতে৷ কিন্তু এত আন্দোলনের পরে এখনও সরকার মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস, ফসলের ন্যুনতম সহায়ক মূল্যের গ্যারন্টি দেয়নি৷ এখনও আখ চাষিদের ১০০ কোটি টাকা বকেয়া৷ এখনও বিদ্যুৎ বিল নিয়ে তাদের সিদ্ধান্ত জানায়নি৷ এখনও ধান বা গমের অবশেষ জ্বালানো নিয়ে যে পরিবেশ বিল, তা সংশোধন করেনি৷ এখনও তাদের ওপরে হাজারো মামলা ঝুলছে, তা ফেরত নেওয়া হয়নি৷ বরং ঘরে সমন আসছে, এখনও কৃষকদের গাড়ির তলায় পিষে মারা বিজেপির গুন্ডা আশিস মিশ্রার পিতাশ্রী, অজয় মিশ্রা টেনি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের আলো করে বসে আছে৷ তাকে বরখাস্ত করা হয়নি।
এই প্রত্যেকটা প্রশ্ন কৃষকরা করবে বিজেপি প্রার্থীদের৷ তারা দরজায় ভোট চাইতে এলেই দাঁড়াতে হবে এই প্রশ্ন গুলোর সামনে, তাদের কাছে জবাব নেই, তাই তাদের সাজা দিতে হবে, কাকে ভোট দেবে কৃষকরা? যাকে খুশি, বার বার কৃষক নেতারা বলেছেন, আমরা কাউকে ভোট দিতে বলব না৷ সেটা আমাদের কাজ নয়৷ আমরা কেবল বলছি, বিজেপিকে এই নির্বাচনে সাজা দাও৷ মানে পরিষ্কার নো ভোট টু বিজেপি।
তবে এসব বলার বহু আগেই, কৃষকরা বুঝে গিয়েছেন তাদের কী করিতে হইবে? গ্রামে গ্রামে স্লোগান খেলা হোবে, খদেড়া হোবে। গ্রামে গ্রামে বিজেপি নেতা, প্রচারকদের ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না৷ যদিও ক্ষমতায় এখনও ৪০৩ আসনের, ৩১২ বিধায়ক নিয়ে জিতে আসা, আদিত্যনাথ যোগী সরকার। এই নো ভোট টু বিজেপি এক ছোঁয়াচে রোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ বিজেপি সেটা বুঝতে পেরেছে বলেই, বার বার রাষ্ট্রীয় লোকদলের জয়ন্ত চৌধুরিকে পাশে চাইছে৷ ক্রমশ ক্রমশ লড়াইটা ধর্মের ভিত্তিতে মেরুকরণ হোক সেটা চাইছে, জিন্না আর প্যাটেলের মূর্খ উদাহরণ তুলে আনছে৷ ৮০ আর ২০র কথা বলছে, রামমন্দিরের কথা বলছে, ঔরঙ্গজেব আর শিবাজির কথা বলছে৷ সরকারি দপ্তর ভরে যাবে মুসলমানে, এই প্রচার চালাচ্ছে।
আর এসব কথা নিচের সারির কর্মীদের মুখে নয়, অমিত শাহ, যোগী, মোদির মুখে শোনা যাচ্ছে, কারণ? নো ভোট টু বিজেপি শুনেই যোগী-শাহ-মোদির স্মৃতিতে আসছে বাংলার নির্বাচনের কথা, সেদিনও প্রথমে তারা পাত্তাও দেয়নি৷ নাম গোত্রহীন লাল টুকরো পোস্টারে ছেয়েছিল বাংলা৷ শমীক ভট্টাচার্য বলেছিলেন, ওসবে মানুষ পাত্তাও দেবে না৷ কিছুদিন পরেই তারা বুঝেছিল, মানুষও বুঝেছিল, এক বিরাট সংখ্যক মানুষ বিজেপিকে ভোট দেয়নি৷ আজ সেই স্মৃতি তাদের শিরায় উপশিরায় ভয় ডেকে আনছে৷ কাল তাদের সেই বিপদ চরমে উঠল, কৃষক নেতারা সরাসরিই বলছেন, ভোট কাকে দেবেন, সে আপনাদের ব্যাপার, কিন্তু বিজেপিকে সাজা দিতেই হবে৷ তাঁরা ৯ তারিখ পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ থেকে তাঁদের প্রচার শুরু করবেন, মানে আবার কৃষক আন্দোলনের হিরোরা, হান্নান মোল্লা, অশোক ধাওলে, যোগিন্দর সিং উগ্রাহা, যোগেন্দ্র যাদব, টিকায়েতরা তাদের কর্মীদের পাশে, রাজ্যের মানুষের পাশে দাঁড়াবেন, এই তো চাই।
আচ্ছা এর মানে কি অখিলেশ প্রসাদ যাদব ধোয়া তুলসি পাতা? বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগ আছে, তাঁর ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা লুঠ চালিয়েছেন, কর্মী সমর্থকদের মধ্যে লুম্পেন গুন্ডা আছে, আছে তো। মুল্লায়ম সিং অটলবিহারী সরকারের আমলে, বিজেপির সঙ্গে অলিখিত বোঝাপড়া করেছেন, তারও আগে ৯৫’ জুন মাসে বি এস পির সঙ্গে জোট ভাঙার পরে বিজেপির পরোক্ষ সমর্থনে সরকার চালিয়েছেন, এসব ইতিহাস তো জানাই৷ কিন্তু কৃষক নেতারা বুঝেছেন, তার চেয়ে অনেক খারাপ আরএসএস – বিজেপি, তাই তাঁরা বলছেন বিজেপিকে সাজা দিতে হবে, কেবল ভোট দেবেন নাই নয়, বিজেপিকে সাজা দাও।
এবং মেরুকরণ, হ্যাঁ বাংলার মতনই ওখানেও মাঠে বি এস পি, কংগ্রেস থাকলেও, লড়াই আপাতত সমাজবাদী জোট আর বিজেপির মধ্যেই এসে দাঁড়িয়েছে, যে সমাজবাদী দলের নেতা অখিলেশ যাদব, তাঁর কথাই দলে শেষ কথা, তিনিই দলের একছত্র অধিপতি, তিনিই টিকিট দেবার, প্রার্থী নির্বাচনে শেষ কথা বলছেন। সেই জোটে বামেরা কোথায়? তারা নেই, তারা আলাদা প্রার্থী দিয়েছেন, যথারীতি সবকটা আসনে জামানত জব্দ হবে, হবেই, তাও দিয়েছেন, স্বাভাবিক, তাঁরা নির্বাচনকে তাঁদের আদর্শের প্রচারের জন্য কাজে লাগাবেন, তাঁদের নেতারা যখন কৃষক নেতাদের নিয়ে আসবেন, তাঁরা বলবেন না যে একই সঙ্গে বিজেপি, বিএসপি আর সমাজবাদী দলকে হারাও, বলবেন বিজেপিকে সাজা দাও, অন্য যাকে খুশি ভোট দাও, সেই প্রচারকে তাঁরাও কাজে লাগানোর চেষ্টা করবেন, এটাও স্বাভাবিক। এবং এইখানে এসেই প্রশ্ন, তাহলে বাংলায় কী হয়েছিল?
বাংলায় কী হয়েছিল? বাংলায় নো ভোট টু বিজেপি আন্দোলন নিয়ে খিল্লি তো কেবল দলের গোপাল ভাঁড় নাট্যকার, সৌরভ পালোধি বা ছাত্র নেতা শতরূপ ঘোষই করেন নি, সেলিম সুজনও করেছিলেন, তখনও করেছেন, এখনও করে চলেছেন, নো ভোট টু বিজেপি নাকি ছিল আসলে তৃণমূলকে ভোট দেবার ডাক, তা নাকি ছিল পিকের কৌশল, তাহলে আজ হান্নান মোল্লা যে নো ভোট টু বিজেপির ডাক দিচ্ছেন, সেটা কী? একবারও ভেবে দেখবেন? অবশ্যই যদি বিবেচনা বোধ এখনও থেকে থাকে, কারণ এ বাংলার সেলিম সুজনকে দেখে আর যাই হোক বিবেচক তো বলা যায় না, শিশুসুলভ বিশৃঙ্খলায় বেড়ে ওঠা জনবিচ্ছিন্ন মানুষ মনে হয়, থাক ওনাদের কথা।
ইউপির দিকে তাকান, ওখানেও নো ভোট টু বিজেপিই কেবল নয়, বিজেপিকে সাজা দেবার প্রতিজ্ঞা নিয়ে, কৃষক আন্দোলনের এক নতুন ধাপ শুরু হল গতকাল, তাঁরা ইউপির গ্রামে গ্রামে যাবেন, লখিমপুরে যাবেন, কেবল পশ্চিমাঞ্চল নয়, পূর্বাঞ্চলেও যাবেন, বুন্দেলখন্ডে যাবেন, অবধেও যাবেন। ক্রমশ বাড়তে থাকা সমাজবাদী জোট, আরও বেশি অক্সিজেন পাবে, পাবেই। এটাই মানুষের জোট, রাজনৈতিক দল, তাদের নির্বাচনে ভূমিকা, তাদের পারফরমেন্স নিয়ে মানুষ সন্দিহান, একটা বড় অংশের মানুষ বীতশ্রদ্ধ, কিন্তু সেই মানুষই যখন দেখে রাস্তা জোড়া অন্নদাতাদের মিছিল, সামনে জলকামান, লাঠি আর টিয়ার গ্যাস, তারই মধ্যে দেখে মুখ্যমন্ত্রীর হেলিকপ্টার ফিরিয়ে দিচ্ছে সেই কৃষকরা, জেদ ধরে পড়ে থেকেছে যারা মাসের পর মাস ঐ ঠান্ডায়, ঐ গরমে, বর্ষায়, তখন সেই মানুষও সেই ডাকের পেছনে এসে দাঁড়ায়, পথে নামে, আসল শত্রুকে চেনে, হ্যাঁ লেসার ইভিল এর দিকে হাত বাড়ায়, বড় শত্রুকে হারায়।
পৃথিবীর ইতিহাস, দেশের ইতিহাস, বাংলার ইতিহাস সেই কথাই বলে। যে সরকার আমাদের সংবিধান কেড়ে নিতে চায়, যে সরকার আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস ভুলিয়ে দিতে চায়, যে সরকারে বসে আছে স্বাধীনতা সংগ্রামে বিশ্বাসঘাতকদের উত্তরসূরীরা, সেই সরকার যাক, এটাই আপাতত প্রধান লক্ষ্য, এটাই ফার্স্ট টাস্ক। এই সরকার চলে যাক, তারপরে এই ভাতের লড়াই, রোটি কপড়া মকানের লড়াই নতুন উদ্যমে শুরু করা যাবে, কে শেখালো? ভলিউম ভলিউম মার্ক্স আর লেনিন পড়া নেতারা নয়, ভ্যানগার্ডস অফ দ্য প্রলেতারিয়েতরা নয়, এ শিক্ষা দিল আমাদের অন্নদাতারা, দেশের কৃষকরা, সহি বিপ্লবী আর সহি বিপ্লবের পথ খুঁজতে বসা লোকজনদেরও বলি, কৃষকদের কথা শুনুন, তাদের সঙ্গে থাকুন, আসুন আমরাও তাদের সঙ্গেই বলি কেবল ভোটে হারানোই নয়, এই বিজেপিকে এবার সাজা দিতে হবে, চরম সাজা।