আমাদের প্রধানমন্ত্রী মাঝে মধ্যেই নতুন কিছু করতে চান, বলা ভাল এই সব নতুন কীর্তির মধ্যেই তিনি অমর হয়ে থাকতে চান, তাঁর ভক্তরা সেই কারণেই মাঝে মধ্যেই বলেন, এর আগে এমন প্রধানমন্ত্রী হয় নি, কঙ্গনা রানাওয়তের মত কিছু ভক্ত তো এটাও বলেছেন যে, দেশের আসল স্বাধীনতা তো এল ২০১৪ তে, নরেন্দ্র মোদী যে বছর প্রধানমন্ত্রী হলেন। কাজেই মোদিজীও সেই মোতাবেক, তাঁর কীর্তি নিয়েই অমর হতে চান।
মাঝে মধ্যেই তাঁর এসব কীর্তি আমরা দেখি, শুনি, হাড়ে হাড়ে উপলব্ধিও করি। হঠাৎ মিত্রোঁওও, নোটবন্দী হয়ে গ্যালো। ফলাফল সব্বাই জানি। কিন্তু ওনার মনে হয়েছিল, এই নোটবন্দী করেই দেশের সব কালো টাকা বেরিয়ে পড়বে, সেই সব কালো টাকা মানুষের জন্য খরচ হবে, হ্যাঁ, এটা তাঁর সত্যিই মনে হয়েছিল। একথা আলাদা যে পৃথিবীর কোনও শিক্ষিত অর্থনীতিবিদ তেনার এই কীর্তির সমর্থনে ছিলেন না, বরং তাঁরা শুরু থেকেই বলেছেন, সর্বনাশ হয়ে যাবে, হয়েছেও। এরপর জি এস টি, তারপর আচমকা লকডাউন, দেশের যাবতীয় সম্পত্তি বেচে দেওয়া, ৩৭০ ধারা তুলে দেওয়া, এসবই আমরা জানি।
আসলে তাঁর আগে দেশের নেতারা, শিক্ষিত মানুষজন, সংবিধান সভার পন্ডিতেরা যে অনেক আলোচনা, অনেক বিতর্কের পর কিছু স্থির করেছেন, তা উনি মানেন না। বরং বার বার বলার চেষ্টা করেন যে এর আগে সব ভুল হয়েছিল, সব। উনি এখন সেই সব ভুল শুধরানোর কাজে হাত দিয়েছেন। তাই নিত্য নতুন চিন্তা নিয়ে তিনি আসছেন, সে সব সিদ্ধান্ত দেশের, মানুষের, অর্থনীতির ক্ষতি করছে, চুড়ান্ত বিপর্যয় ডেকে আনছে। কিন্তু মোদিজী তো মোদিজী, দেশকে ডোবানোর অক্লান্ত চেষ্টা তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন, অনেকটা, অনেকটা সফলতাও পেয়েছেন। তাঁর এই নিত্য নতুন তত্ব নিয়ে দেশ জেরবার, উনি নন।
তেনার একটা তত্ত্ব হল, এক দেশ, এক নির্বাচন। মানে একসঙ্গে দেশের প্রত্যেক বিধানসভা, লোকসভার নির্বাচন। তাঁর মনে হয়েছে, সংবিধান প্রণেতারা এই বিষয়টা ঠিক করে বোঝেন নি, বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন সময়ে নির্বাচন হতে থাকে, নির্বাচনে পয়সা খরচ হয়, কাজ আটকে থাকে, তাই সারা দেশে একসঙ্গে বিধানসভা লোকসভা নির্বাচন করলে দারুণ এক ব্যাপার হবে, তিনি এই কথা বেশ কয়েকবার বলেছেন, তাঁর কথায় উদ্বুদ্ধ বিজেপির মেজো, সেজো, ছোট নেতারাও এইকথা বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন ফোরামে বলছেন, মোদিজীর নতুন তত্ত্ব এক দেশ, এক নির্বাচন, আবার অমর হবার চেষ্টা, দেশের মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা যে দেখুন, এর আগে কেউই এরকমভাবে ভাবেন নি, এরফলে দেশের লক্ষ কোটি টাকা খরচ কমবে, ব্যস, বিকাশের গঙ্গা বয়ে যাবে। আসুন তেনার এই তত্ত্ব নিয়ে কটা কথা বলা যাক, বা বিষয়টা একটু তলিয়ে দেখা যাক।
মোদিজীর নতুন তত্ত্ব এক দেশ, এক নির্বাচন
প্রথম সমস্যা হল, কবে থেকে এটা লাগু হবে? যখনই হোকনা কেন, তখনই এমন কিছু রাজ্য তো থাকবেই, যাদের নির্বাচন মাস ছয়, কি সাত কি বছরখানেক আগে শেষ হয়েছে, ধরুন এই ডিসেম্বরেই যদি এক দেশ, এক নির্বাচন হয়, তাহলে, এই যে পাঁচটা রাজ্যে নির্বাচন হয়ে গ্যালো, সেগুলো কী হবে? সেই সরকারগুলো কি ভেঙে দেওয়া হবে? সেখানেও আবার নতুন করে নির্বাচন হবে? যে সরকারের বয়স দুই কি তিন, ধরুন এই বাংলার সরকার, সেটাও কি ভেঙে দেওয়া হবে? এর উত্তর কিন্তু এন্টায়ার সায়েন্স পড়া মোদিজীর কাছে নেই, থাকা সম্ভবও নয়।
এবার আসুন দ্বিতীয় সমস্যার দিকে একটু নজর দেওয়া যাক, ধরুন যতদিনেরই সরকার হোক, ৬ মাস, ৯ মাস কি দু বছর, তাদের ভেঙে দেওয়া হল, নতুন করে একসঙ্গে লোকসভা, প্রত্যেক বিধানসভার নির্বাচন হল, কিন্তু একটা বা দুটো বিধানসভায় কেউই পূর্ণ বহুমত, সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলনা, হাং অ্যাসেমব্লি হল, তখন কী হবে? ধরুন কোনও একটা বা দুটো বিধানসভা ৬ মাস, কি একবছর চলার পর যে কোনও কারণে ভেঙে গ্যালো, তখন কী হবে? সেখানে আর নির্বাচন হবে না? বাকি চারবছর সেখানে রাজ্যপালের শাসন থাকবে? তারপর ধরুন কেন্দ্রের সরকার, সেখানে মিলিজুলি সরকার হল, তারপর সরকার চালানো গ্যালো না, লোকসভা ভেঙে দিয়ে বাকি চারবছর কি সেখানে রাষ্ট্রপতির শাসন চলবে? না কি লোকসভার নির্বাচন হবে, এবং আবার সমস্ত বিধানসভা ভেঙে দিয়ে, নতুন করে একদেশ এক নির্বাচন হবে?
আসলে মোদিজীর জানাই নেই যে নভেম্বর ১৯৪৬ থেকে ২৫ জানুয়ারি ১৯৫০ অবদি, সংবিধান সভার ৩৮৯ জন শিক্ষিত, পন্ডিত মানুষজন মিলে নানান বিতর্ক আর আলোচনার পরে আমাদের সংবিধান তৈরি করেছিলেন, তাঁদের একজনও ঐ এন্টায়ার পলিটিক্যাল সায়েন্স পড়েন নি, কিন্তু সেই সভায় শিক্ষিত মানুষজনের অভাব ছিল না, তাঁরা দেশের নির্বাচন কিভাবে হবে, কখন হবে ইত্যাদি বিষয়ে বহু আলোচনার পরেই তাঁদের সিদ্ধান্ত লিপিবদ্ধ করেছেন, এবং অবশ্যই তার মানে এমনও নয় যে ,সেই সব সিদ্ধান্তের পরিবর্তন কোনওদিনও হবে না, কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত পাল্টানোর জন্য বহু আলোচনার প্রয়োজন আছে, এটা রাত আটটায় মিত্রোঁ বলে ঘোষণা দেবার মত বিষয় নয়,
এক দেশ, এক নির্বাচন আমাদের মত দেশে, যেখানে এক ফেডারেল সিস্টেম আছে, এতগুলো রাজ্য আছে, এত এত আঞ্চলিক দল আছে, এতগুলো রাজনৈতিক দল আছে, সেখানে কোনও দিনও সম্ভব নয়, হলে ভালো হত তো বটেই, কিন্তু হওয়াটা সম্ভব নয়, এটাই সত্যি। কিন্তু মোদিজী বলেই চলেছেন, এবং ওনার ভক্তদেরও মনে ধরেছে, হঠাৎ কোনওদিন উনি ঘোষণা করে দেবেন, কোটি কোটি টাকার শ্রাদ্ধ হবার পর বোঝা যাবে যে এটা সম্ভব নয়, মোদিজী তারপর এ নিয়ে আর একটা কথাও বলবেন না, যেমন নোটবন্দি নিয়ে এখন আর একটা কথাও বলেন না, তেমনই এ নিয়েও বলবেন না, মাঝখান থেকে উবে যাবে দেশের কোটি কোটি টাকা। উনি চাইছেন পাঁচ বছরে একবার, মাত্র একবারই নির্বাচন হোক, অথচ দেশের মানুষ চাইছেন, প্রতিমাসে কোথাও না কোথাও নির্বাচন হোক। আমিও তাই চাই, আমরাও তাই চাই। কেন?
যে কথা বলছিলাম যে আমরা চাই প্রতিমাসে কোথাও না কোথাও নির্বাচন হোক, তার প্রথম কারণ হল, আমাদের অভিজ্ঞতা বলছে, নির্বাচন চললে, বা নির্বাচন সামনে থাকলে পেট্রল ডিজেলের দাম বাড়ে না, জিনিষপত্রের দাম বাড়ে না। পাঁচ রাজ্যে ভোট ছিল, গত তিন সাড়ে তিন মাস ধরে পেট্রল ডিজেলে দাম বাড়ে নি, ভোট শেষ, মোদিজীর খেলা শুরু। গত সাত দিনে কেবল ডিজেলের দাম বেড়েছে ৪ টাকা ৯ পয়সা, ২১ মার্চ ডিজেলের দাম ছিল ৯০ টাকা ৮২ পয়সা, ২৮ মার্চ দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৪ টাকা ৯১ পয়সা, আর দিন পাঁচেকের মধ্যে বিরাট কোহলির সেঞ্চুরির রেকর্ড ভেঙে ১০০ টাকার বেশি দাম হবে ডিজেলের, যে ডিজেল গণপরিবহণে ব্যবহার হয়, যে ডিজেলের দাম বাড়লে প্রত্যেকটা কমোডিটির দাম বাড়ে, অতএব দিল থাম কর বৈঠিয়ে, সরষের তেল থেকে ডাল, চাল, ময়দা, আটা সবকিছুরই দাম বাড়বে। কেন? কারণ নির্বাচন শেষ।
কেবল ডিজেল পেট্রল, খাদ্যদ্রব্য? প্যারাসিটালমের দাম বাড়ছে, ওষুধপত্রের দাম বাড়ছে, এক আধ পয়সা নয় ১৬/১৯% করে দাম বাড়ছে, কোনও কোনও ওষুধের ক্ষেত্রে তার থেকেও বেশি। চাকরি নেই, বেকারত্ব বাড়ছে, মিডিয়াম স্মল স্কেল, মাঝারি ছোট ব্যবসা একের পর এক বন্ধ হচ্ছে, হতেই থাকবে, মধ্যবিত্তদের নাভিশ্বাস উঠছে, কেবল গত তিন বছরে সাড়ে ৯ কোটি মানুষ মধ্যবিত্ত থেকে গরীব হয়েছেন, গরীব আরও গরীব হচ্ছে এমন একটা সময়ে, যখন আমাদের দেশে বিলিওনিয়ার, ট্রিলিওনিয়ারদের সংখ্যা বাড়ছে, দেশ নয় মহাদেশ নয়, সারা পৃথিবীর মধ্যে ধনী মানুষদের তালিকায় ঝলমল করছে ভারতবর্ষের কিছু মানুষের নাম, তাদের বেশির ভাগ আবার গুজরাটের বাসিন্দা, এবং এসব তো কোনও লুকোনও তথ্য নয়, সব্বাই জানেন। অন্য তত্ত্বের কথা বাদই দিলাম, অন্তত একটা তত্ত্বে মোদিজী সফল, সফল তেনার এক্সপেরিমেন্ট, দেশের প্রত্যেক মানুষের বিকাশ তাঁর লক্ষ্য নয়, বরং উল্টোটা। তিনি চান, তিনি চাইছেন, দেশের কিছু মানুষ বড়লোক হন, কিছু মানুষের হাতে সব থাকুক, সেই সব মানুষদের ডিজেল পেট্রলের দাম বাড়া স্পর্শও করে না, তারা হিসেব করেও দেখেনা মাসকাবারি বাজারে কত পয়সা লাগছে, কতটা বাড়ল, ওই মূল্যবৃদ্ধিতে তাদের কিচ্ছু আসে যায় না, আর বাকি মানুষদের শেষ সম্বল চলে যাক, গত দু বছরে গোল্ড লোন বেড়েছে ২০% এর বেশি, কারা সোনা জমা নিয়ে টাকা ধার করছেন? আম্বানি? আদানি? ধার করছেন দেশের মধ্যবিত্তরা।
এবং অন্যদিকে তৈরি হচ্ছে হতদরিদ্র, হাঘরে এক সমাজ, যাদের সারা মাসের র্যা শন দিলেই, মাসে হাজার ৫ কি ৬ টাকা দিলেই মুখে হাসি ফোটে, যাদের মোদিজী লাভার্থী বলছেন, সেই লাভার্থির দল এইটুকু পেয়েই নিজেদের ঋণী মনে করছেন, মোদিজী কা নমক খায়া মনে করছেন, মোদিজী খুশ।
দেশের কোটি কোটিপতিরা খুশি কারণ কর্পোরেট ট্যাক্স কমছে, তাদের লাভ বাড়ছে, তাদের চুরি করার সুযোগ বাড়ছে, অন্যদিকে হাঘরে দরিদ্ররা মেনেই নিয়েছেন এই দারিদ্রকে, অতএব সারা মাসের র্যাসন আর কিছু টাকায় তাঁরাও খুশি, অন্তত এটা তো এল, অন্তত পেটে তো কিছু পড়বে। আর এই দুই এর মধ্যে থাকা মধ্যবিত্তরা শেষ সম্বল নিয়ে ব্যাংকের দরজায়, সোনা বিক্রি করছেন, অসুখের চিকিৎসা করতে, মাথার অপর ছাদের ব্যবস্থা করতে, ছেলের উচ্চ শিক্ষার জন্য, এবং তারপরেও প্রতিদিন বাড়তে থাকা মূল্যবৃদ্ধি তাদের অস্তিত্বের সংকট ডেকে আনছে, তারও ওপরে সেই মধ্যবিত্তরা দেখছে ঘরে বেকার ছেলেটা, তার আত্মজ, অসহায়, যে কোনওদিন ঝুলে পড়তে পারে ফ্যানের রডে গামছা বেঁধে, এত দুর্দিন দেশের মধ্যবিত্ত সমাজ কোনওদিনও দেখেনি, এই দুর্দিন কবে কাটবে, তাও সে জানে না।