তখন সবে নবজাগরণের শুরু। ডিরোজিও আর তাঁর ছাত্রেরা কালাপাহাড়ের মতো যাবতীয় প্রচলিত নিয়ম-কানুন, সমাজের অনুশাসন ভাঙার কাজে মেতে উঠেছেন। মাইকেল ধর্মত্যাগ করে ইংরিজিতে কবিতা লেখার চেষ্টা করছেন। তখন আজ থেকে ২০৩ বছর আগে জন্ম নেওয়া এক মানুষ না সরাসরি ধর্মকে অবজ্ঞা করছেন, না ধর্মীয় উন্মাদনায় মেতে আছেন। তাঁর সারাদিন কাটে পড়াশুনো নিয়ে, শিক্ষা নিয়ে, নতুন বই রচনা নিয়ে আর বাংলা ভাষা নিয়ে। সেইরকম এক সময়ে তাঁর সংস্কৃত কলেজের ছেলে ছোকরারা নাকি মুসলমান খানসামার হাতে মুর্গ মুসল্লম খাচ্ছে আয়েস করে। খবর তিনিও পেয়েছিলেন। কিন্তু এত তুচ্ছ বিষয় নিয়ে তাঁর মাথা ঘামানোর সময় নেই। কিন্তু এ খবর তো গেছে সমাজ প্রধানদের কাছে। তাঁরা এক নীতিনিষ্ঠ হিন্দু ধর্মের পণ্ডিতকে এনেছেন, সেদিন তিনিই ছাত্রদের বলবেন ধর্মের অনুশাসনের কথা, ধর্মের সেই অনুশাসনের পিছনে যুক্তির কথা। এসেছেন শশধর তর্কচূড়ামণি, বিদ্যাসগরকে তো একবার আসতেই হত। তিনি এলেন এবং অনায়াসেই বললেন বক্তৃতা করতে এসেছেন, করুন। লোকজন আপনার কথা শোনেন, শুনবেন, ভালো বলবেন। কিন্তু আমার কলেজের যে ছাত্ররা মুরগি খায়, তারা আপনার বক্তৃতা শুনে মুরগি খাওয়া ছেড়ে দেবে, এরকমটা কিন্তু হবে না, হয়নিও। কিন্তু এক ব্রাহ্মণ সন্তান সেই কঠিন সমাজ শাসনের সামনে দাঁড়িয়ে একথা বলতে পেরেছিলেন যে খাদ্যাভ্যাস এক ব্যক্তিগত ব্যাপার, ধর্মের কঠিন ব্যাখ্যা দিয়ে তাকে সামলানো যায় না, সামলানোর দরকারও নেই। আজ তাঁর জন্মের ২০৩ বছর পরেও আমরা যখন এই খাদ্যাভ্যাস নিয়ে মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলতেও রাজি, তখন ভাবতে অবাক লাগে, সেই সময়ে এই আধুনিকতার পাঠ তিনি কোথা থেকে পেয়েছিলেন? বিষয় আজকে সেটাই, ২০৩ বছর আগের এক আধুনিক মানুষ, বিদ্যাসাগর।
আজ বিদ্যাসাগরের জন্মদিন। স্রেফ এই একটা মানুষ ছিলেন বলেই আমাদের ভাষা, বাংলা ভাষা খুব তাড়াতাড়ি এক আধুনিক ভাষা হয়ে ওঠে। চর্যাপদের সময়কার বাংলার থেকে গোপাল অতি সুবোধ বালকের রূপান্তর এই মানুষটার হাত ধরে। সংস্কৃত টোল আর ব্রাহ্মণ্য হেজিমনি, দাদাগিরির উল্টোদিকে শিক্ষাকে সবার আঙিনায় নিয়ে যাওয়ার প্রথম চেষ্টাও এঁরই হাত ধরে। আজকেও যাঁরা কম করে ৫৫-৬০ এর কোঠায়, তাঁরাও এই মানুষটার বর্ণপরিচয় থেকেই প্রথম পাঠ নিয়েছিলেন। গোলাপি রংয়ের সেই একই বইয়ের দুটো খণ্ড বছরের পর বছর একই থেকে গেছে। এই বই আমাদের অ আ ক খ শিখিয়েছে, এই বই আমাদের প্রথম ন্যায় শাস্ত্রের পাঠ দিয়েছে। চুরি করা কদাচ উচিত নয়, না বলিয়া পরের দ্রব্য লইলে চুরি করা হয়। চুরি করা বড় দোষ। যে চুরি করে, তাহাকে চোর বলে। চোরকে কেহ বিশ্বাস করে না। চুরি করিয়া ধরা পড়িলে, চোরের দুৰ্গতির সীমা থাকে না। বালকগণের উচিত, কখনও চুরি না করা।
আরও পড়ুন: Aajke | একদা সম্পদ দিলু ঘোষ এখন বিজেপির বোঝা
তারপরে সেই ভুবন আর তার মাসির গল্প, এখনও এক আধুনিকতম গল্প। মাসির কাছে মানুষ ভুবন ছোটবেলায় অন্য ছাত্রের বই চুরি করেছিল, মাসি কিছু বলেনি। ক্রমে ভুবন এক পাকা চোর হয়ে উঠল, তারপর যথারীতি একদিন ধরাও পড়ল, রাজার বিচারে তার ফাঁসি হবে, ফাঁসির আগের দিন সে মাসির সঙ্গে কথা বলতে চাইল। মাসিকে কানে কানে কিছু বলবে বলে কাছে ডেকে এনে এক কামড়ে মাসির কানটা কেটে নিল। তারপর ভুবন বলেছিল, ছোটবেলায় প্রথম চুরির সময়েই যদি তুমি আমাকে মানা করতে, তাহলে এই দিনটা দেখতে হত না। এরকম আধুনিক ছোট গল্প আর ক’টা পড়েছেন? এবং তার বাংলা, তার বক্তব্যের গভীরতা, হ্যাঁ, ২০৩ বছর আগে জন্ম নেওয়া ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের লেখা। এখানেই থামলে হত, কিন্তু এখানেই তো তিনি থামেননি। কেবল শিক্ষাই যখন এক উচ্চবর্ণের কুক্ষিগত ব্যাপার তখন এ মানুষ নামলেন নারী শিক্ষার ব্রত নিয়ে, ভাবা যায়? নারীরা তখন অন্তঃপুরবাসিনী, অসূর্যস্পর্শা, সেই তখন তিনি প্রথম হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় তৈরি করলেন। তিনিই ছিলেন তার সম্পাদক, দেশের প্রথম বালিকা বিদ্যালয়, আজ তার নাম বেথুন স্কুল। ৫৭-৫৮-এর মধ্যে হাওড়া, হুগলি, বর্ধমান নদিয়া, মেদিনীপুর মিলিয়ে ৩৫টা বালিকা বিদ্যালয় চালু করেন। সেখানে হাজার দেড়েকের মত বালিকারা পড়াশুনো শুরু করে। ইতিহাস বলছে, ১৮৬৪-র মধ্যে সেই স্কুলের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২৮৮। হ্যাঁ, একজন মানুষ, তাঁর সমস্ত ইচ্ছে আর চিন্তা চেতনা নিয়ে শিক্ষার সর্বজনীন আকার দেওয়ার চেষ্টা করে গেছেন। এরই সঙ্গে বিধবা বিবাহ চালু করা। এমন নয় যে তিনি হিন্দু রীতিনীতি মানি না, বিধবা বিবাহ চালু করতে হবে এমনটা বলেছিলেন। বরং উলটো, পুঁথি পুরাণ ঘেঁটে দেখিয়েছিলেন বিধবা বিবাহ নিয়ে কোনও নিষেধ হিন্দু শাস্ত্রে নেই। আজও উত্তর ভারতে বিধবা বিয়ে করবে বললে হয়তো পিটিয়ে মারা হবে। আমাদের বাংলায় লুকিয়ে চুরিয়ে কিছু অনুশাসন থাকলেও, প্রকাশ্যে একথা কেউ বলবেন না কারণ আমাদের এই বাংলায় বিদ্যাসাগর জন্মেছিলেন। আমাদের দর্শকদের আমরা প্রশ্ন করেছিলাম, বিদ্যাসাগর যিনি আধুনিক বাংলা ভাষার জন্ম দিলেন, যিনি এই বাংলায় নারী শিক্ষার জন্য প্রথম স্কুলটা তৈরি করলেন, যিনি বিধবা বিবাহ চালু করার জন্য সমাজের উচ্চবর্ণের সমাজপতিদের সঙ্গে লড়ে গেলেন, তাঁকে কি আমরা মনে রেখেছি? শুনুন মানুষজন কী উত্তর দিয়েছেন।
বিদ্যাসাগর নিজের সময়ের থেকে অনেক অনেক এগিয়ে থাকা এক যুগপুরুষ। বাঙালি প্রতিটা মানুষের আজকের যে সংস্কৃতি নিয়ে এত গর্ব, যে আধুনিকতা বোধ নিয়ে এত অহঙ্কার, তার সবটাই ওই সময় থেকে পাওয়া। যে সময়ে বাংলায় এক প্রান্তিক অঞ্চলের দরিদ্র ব্রাহ্মণের ছেলে শিক্ষার দুনিয়াতে নিঃশব্দ বিপ্লব আনছিলেন। যিনি নিজে রাস্তার গ্যাসবাতির আলোয় পড়াশুনো করেছেন, তিনি এক জ্ঞানের আলো জ্বেলে দিয়ে গেছেন গোটা বাঙালি জাতির অন্তরে। আজ তাঁর জন্মদিন, অন্তত আজ আমাদের তাঁর কথা মনে করা উচিত তাই প্রাত্যহিক রাজনীতির কচকচানির বাইরে এসে আজ আমাদের ঈশ্বরকে প্রণাম জানাই।