আবার একটা বহুতল ভেঙে পড়ল, এখনও পর্যন্ত মারা গেছেন ৯ জন, জানি না এই তালিকা আরও দীর্ঘ হবে কি না। কীভাবে এই বহুতল ভাঙল এই প্রশ্ন না করে বরং প্রশ্নটা হওয়া উচিত এতদিন টিকে ছিল কী করে? ওরকম এক সংকীর্ণ জায়গাতে কীভাবে গড়ে উঠেছে ছ’তলার বাড়ি? মেয়র যুগপৎ দুঃখিত এবং বিস্মিত। কী করে হল এই বাড়ি? বলেছেন তিনি। এখন মেয়রই যদি না জানেন, তাহলে আর কে জানবে? মুর্শিদাবাদের ডিভিশনাল মেডিক্যাল অফিসারের তো জানার কথা নয়। এবং কোনও আলাদিনের প্রদীপ ঘষেই এই বাড়ি তৈরি হয়নি, ছ’তলা বাড়ি তৈরি হতে সময় লেগেছে, কেউ দেখেননি? কেউ না? স্থানীয় কাউন্সিলর, ক্ষমতাসীন দলের নেতারা, মেয়র পারিষদ? কেউ দেখেননি? না দেখতে চাননি? সে প্রশ্ন তো উঠবেই। মুখ্যমন্ত্রী ছুটে গেছেন, আহতদের চিকিৎসার হাল হকিকত জেনেছেন, মৃতদের ক্ষতিপূরণের ঘোষণা করেছেন। রাজ্যপালও গেছেন, খুব একটা কথা বলেননি, কিন্তু তাঁর তরফেও ক্ষতিপূরণের ঘোষণা হয়েছে। মিডিয়া বহুদিন পরে শহরের মধ্যে ইস্যু পেয়েছে, সাতসকালে ৫-৬ খানা লাশ, কাজেই সেখানেও তৎপরতা ছিল, রাতের দিকে সেই তৎপরতা আদতে নির্বাচনী খেউড় হয়ে উঠল। বিজেপির সজল ঘোস, তিনি তো পুরপিতাও, ঘটনাস্থলে গেলেন এবং তাড়া খেলেন, বাজে উদাহরণ হয়ে রইল। এই একই ঘটনা তো কেবল বাংলাতেই ঘটে, তা তো নয়, অন্য জায়গাতেও ঘটে। ভোর রাতেই তো আগ্রাতে কাপড় পট্টিতে বিরাট আগুন লেগেছে, বড় রকমের আগুন, ক্ষয়ক্ষতিও বড়, সেখানে অখিলেশ যাদব গিয়ে তাড়া খেলে সেটা কি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে মানানসই হবে? দিল্লিতে বহুতল ভেঙেছে, মনে আছে মুম্বইয়ে বহুতল ভাঙার ছবি, বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দেবেন্দ্র ফড়নবিশের আবেদন, এটা দুর্ঘটনা, রাজনীতি করবেন না। মনে তো আছেই বাম আমলে মাঝরাতে কুন্দলিয়ার তৈরি বিশাল আবাসন ধসে পড়া। এসব তো হয়েই থাকে। কেন হয় সেটাই প্রশ্ন। সেটাই বিষয় আজকে, বহুতল ভেঙে পড়ল, গাফিলতি কার? পিছনের আসল কারণটা কী?
এসব ঘটনা দুর্ঘটনার পরের দিনই খবরের কাগজে কিছু নাম পাওয়া যায়, জানা যায় তাদের কেউ মাছ বিক্রি করতেন, কেউ ট্রেকার চালাতেন, কেউ খালাসি ছিলেন, কেউ বা কেবলই পাড়ার মাস্তান। কিন্তু এরাই শাসকদলের ছত্রছায়াতে ঢুকে পড়েছিল ক’ বছর আগে, তারপর মেটিওরিক রাইজ, উল্কার মতো সোঁ করে আকাশে উঠে পড়া। এসব নামগুলো আগে জানা যায় না। এক সন্দেশখালি না হলে আমরা এই জেনেই মরতাম যে শাহজাহান তাজমহল তৈরি করেছিলেন এবং তার সঙ্গে পিঠে খেতেও ভালোবাসতেন।
আরও পড়ুন: বিজেপির নেতৃত্বে এনডিএ দেশে ৪১১, আর বাংলায় বিজেপি ২৫টা আসন পাবে?
যেখানে যত ঘটনা ঘটেছে সে এ আমলে বা বাম আমলে, উঠে এসেছে এরকম কিছু মানুষের নাম, যারা সুযোগ বুঝে বাড়িয়েছে তাদের প্রতিপত্তি, বদলে দিয়েছে অবাধ ভোট লুঠের নিশ্চিদ্র ব্যবস্থা। অবৈধ রোজগারের হাজার একটা রাস্তা বার করেছে, বদলে দিয়েছে এক সংগঠিত বাহিনী, যা শাসকের কাজে আসে। এই খিদিরপুরের ক্ষেত্রে তেমন এক নাম হল মহম্মদ ওয়াসিম। একটু খোঁজ নিয়ে দেখুন, ইনি এলাকাতে শাসক ঘনিষ্ঠ হিসেবেই পুলিশ থেকে ছোট মেজ সেজ আর বড় নেতাদের কোলেপিঠেই বড় হয়েছেন। তিনি উধাও হবেন, কিছুদিন পরে ধরা পড়বেন, আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে আসবেন, তারপর চুপ করে বসে থাকবেন। আবার অন্য আরেকজনের জন্ম হবে। ওই এলাকার কাউন্সিলর শামস ইকবাল, তিনি পাঁচ কোটি টাকার অ্যাস্টন মার্টিন গাড়ি চড়ে পুরসভার বৈঠকে যোগ দিতে গিয়েছিলেন, উনিও কিছুই জানেন না, এখন দেবশিশু। মরে লাশ হয়ে যাওয়া লোকগুলো কবরে গিয়ে জানতে কি পারবে যে তাদের মৃত্যুর জন্য মাথা পিছু কত টাকা দেওয়া হল, অন্তত ঘোষণা হল। এবং আরেক কর্মতৎপরতা ছোট লাল বাড়িতে, একে বুলাও, তাকে বুলাও, এখন থেকে নাকি সকাল সাড়ে দশটার মধ্যে বিল্ডিং ডিপার্টমেন্টের ইনস্পেক্টরদের হাজির হতে হবে দফতরে, তারপর যেতে হবে এলাকায়, তারপর কোথাও বেআইনি কিছু দেখলেই তার ডিটেইলড খবর দিতে হবে উপরতলায়। এটা গতকালের জারি করা নির্দেশ। আমার খালি জানতে ইচ্ছে করে যে আগের নির্দেশটা কী ছিল? অফিসে না এসে প্রোমোটারদের দফতরে বসে আগাম ব্যবস্থা করে নেওয়া? গতকাল যা বলা হয়েছে ঠিক এটাই কি তাদের কাজ ছিল না? আমরিতে আগুন লাগল, মানুষ মারা গেল, ক’জনের জেল হয়েছে? ফাঁসি হয়েছে? কুন্দলিয়ার কী হয়েছে? ব্রিজ ভেঙে পড়েছে পোস্তায়, মানুষ মারা গেছেন, কী হয়েছে, বড়বাজারে আগুন লেগেছে, মঙ্গলাহাটে আগুন লেগেছে, কোথাও কিছু হয়নি। কিছু হয় না বলেই আবার সেই একই ঘটনা ঘটে, এবং ঘটনার পরে কিছু দেবশিশুদের দেখা যায়, যাঁরা আসেন অবাক হন, ক্রুদ্ধ হন, সবকটাকে জেলে পাঠাব বলে চলে যান। তারপর আবার ঘটনা ঘটের। বিংশ শতাব্দীতে মানুষের শোকের আয়ু বড়জোর এক বছর, বলেছিলেন নাজিম হিকমত, আর সেই বিংশর পরে আরও কত বছর কেটে গেছে, কাজেই এখন শোকের আয়ু মালা শুকানোর আগেই শেষ, তারও আগে চাপা পড়ে যায় তদন্ত ইত্যাদির হুমকি আর বাওয়াল। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, প্রতিবার বহুতল ভেঙে পড়ে, বাজারে হাসপাতালে আগুন লাগে, দুর্ঘটনা ঘটে, কিন্তু তার জন্য দায়ী মানুষজন কোনওদিনই শাস্তি পায় না। শাস্তি পায় না বলেই কি আরও বেশি করে বেআইনি বাড়ি তৈরি হতেই থাকে শহরজুড়ে? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ৯ জন মারা গেছেন গার্ডেনরিচ খিদিরপুরের এই ঘটনায়। এরথেকে একটা বিষয় তো পরিষ্কার যে কর্পোরেশনের চোরপরেশন নামটা এখনও তার পূর্ণ মহিমা নিয়েই রমরম করেই চলছে। যাবতীয় আইনের ফাঁকতাল গলে যে যখন ক্ষমতায় আছে তাদের সংরক্ষণ আর দেখরেখ ছাড়া এসব ঘটনা ঘটতে পারে না। এবারও ঘটেছে, আর সঙ্গে সঙ্গে একটা ফাটা রেকর্ডের মতো ৩৪ বছরের ঘটনার কথা উঠে আসছে, সেই ৩৪ বছরে বহু অন্যায়ের জন্যই তো তারা এখন শূন্য, আপনারাও কি সেই পথেই পা বাড়িয়ে?