সকালে বাজারে দেখা অমলবাবুর সঙ্গে। তাঁর নাম কমল, বিমল হওয়াও বিচিত্র নয়। এঁদের বোলচাল মোটামুটি এক। তা সে বেলেঘাটা হোক, কিংবা বেলাকোবা।
তা অমলবাবু বললেন, ‘এই যে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা সরকার নিচ্ছে না, এটা কি ঠিক হল? স্কুলে এত ঘর! ফাঁকায় বসিয়ে কি পরীক্ষা নেওয়া যেত না? এর মধ্যে রাজনীতি আছে বুঝলেন মশাই, রাজনীতি আছে।’
আরও পড়ুন: টাকির বুকে এক টুকরো সুন্দরবন
রাজনীতিটা ঠিক কোথায়, আমি বুঝলাম না। মানে পরীক্ষা না-নিলে সরকারের কী লাভ, সেটা আমার মাথায় এল না। বললাম, ‘সরকার যে সবসময় মানুষের খারাপ করার চিন্তায় মশগুল থাকে, এমনও নয়। আমি যতদূর জানি, ডাক্তারের পরামর্শেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’ বাড়ির উঠোনে পুঁইশাক পুঁতেছিল একটি মেয়ে। বর্ষার জল পেয়ে পুঁইশাকের ডালপালা বেশ ডাগর হয়েছে। মেয়েটি হাঁক দিচ্ছিল, ‘পুঁইশাক পুঁইশাক। ইলিশের মাথা দিয়ে পুঁইশাক।’
আমার কথাটা অমলবাবুর ঠিক পছন্দ হল না। পুঁইশাকের চেয়েও গলা চড়িয়ে বললেন, ‘ছাড়ুন তো মশাই। সিদ্ধান্ত উনি (মুখ দেখে মনে হল মুখ্যমন্ত্রীর কথা বলছেন) নিজেই নেন। তার পর ডাক্তারের নামে চালান। ওসব আমার জানা আছে।’
অমলবাবুকে দেখে মনে হয় না তিনি দশের চিন্তায় কাতর। যেখানে নিজের স্বার্থ নেই, সেখানে উত্তেজিত হয়ে পড়া তাঁকে মানায় না। আমি বললাম, ‘আপনার সন্তান কি উচ্চ মাধ্যমিক পরক্ষার্থী?’ অমলবাবু বললেন, ‘আর বলবেন না, মেয়েটা মাধ্যমিকে নাইন্টি পার্সেন্ট নম্বর পেয়েছিল। সায়েন্স গ্রুপে তো মারকাটারি নম্বর। উচ্চ মাধ্যমিকেও তাই পেত। কিন্তু কী যে করল সরকার? ভাবুন তো, নাইন্টি পার্সেন্ট নম্বর পেয়েছিল মেয়ে।’
আরও পড়ুন: আমি রয়, তাই রয়্যাল বলতে পারেন, গান্ধীজিকে বলেন বিধান রায়
নাইন্টি পার্সেন্ট কথাটা দু’বার বললেন। আমি জানতাম না তাঁর মেয়ে কত নম্বর পেয়েছে। বিনা ভূমিকায় জেনে গেলাম। থলে হাতে বাজারের আরও কিছু লোক জেনে গেল। নগরে-প্রান্তরে আর কে কে জেনেছে, আমার জানা নেই।
তারপর অমলবাবু বললেন, ‘তা হলে অফিস যাচ্ছেন কী করে?’ আমি বললাম, ‘যা হোক করে যাচ্ছি। না-গেলে তো পেট চলে না।’ অমলবাবু কোথায় কাজ করেন আমি জানি না। তবে অচিরেই জেনে গেলাম তিনি কোনও ‘জরুরি’ পরিষেবায় যুক্ত, মানে যাঁরা স্পেশাল ট্রেনে উঠতে পারেন। চেহারাপত্র দেখে মনে হয় তাঁর অর্থবল মন্দ নয়। মানে বাজারের মাঝখানে দু’বার নাইন্টি পার্সেন্ট বলার মতো পয়সাকড়ি আছে। তা তিনি বললেন, ‘আর বলবেন না। নামেই স্পেশাল ট্রেন। সবাই উঠে পড়ছে। এদের কি সেন্স নেই। আরে এটা তো স্পেশাল ট্রেন। সবাই উঠতে পারে না। কী বলব মশাই, রোজ ভিড় ট্রেনে উঠে করোনা না হয়ে যায়?’
‘করোনা না হয়ে যায়’ বলার মধ্যে বেশ শ্লাঘা আছে। কেমন ‘শহিদ শহিদ’ ভাব। আমি জানলাম উনি জরুরি পেশায় যুক্ত। উনি কী জরুরি কাজ করেন, সেটা অবিশ্যি জিজ্ঞেস করিনি। কারণ কথা বাড়ালেই আরও না জানি কত কী শুনতে হবে। কিন্তু এত সহজে কি রেহাই মেলে? অমলবাবু বললেন, ‘কাল লাঞ্চ করেছি বিকেল চারটেয়। ডিনার করতে একটা বেজে যায়। ফুরসত নেই।’ আমি বুঝেছি, উনি খুব দরকারি লোক। কিন্তু আর কত শুনব? আমি বললাম, ‘বিকেল চারটেয় আমি মুড়ি খাই। আর রাত একটায় প্রথমবার হিসু করতে উঠি। সুগার তো, বেশি অনাচার সয় না।’ অমলবাবু বললেন, ‘আরে আমরাও তো সুগার। পরশু এক ডাক্তারকে অনলাইনে দেখালাম। আড়াই হাজার টাকা ভিজিট। আচ্ছা, আড়াই হাজার টাকা ভিজিট হয় কারও। ডাক্তারগুলি হয়েছে রক্তচোষা।’
আমার মনে হল, ডাক্তার রক্তচোষা নয়, উনি স্বেচ্ছায় রক্তদান করেছেন। রক্তদানের একটা অদৃশ্য সার্টিফিকেট ঝুলছে তাঁর গলায়।
জগতে যাই ঘটুক, অমলবাবুদের সার্টিফিকেট-বিলাস দিব্যি বহাল। ওঁরা কি বাজারে শুধু আনাজপাতি কিনতে যান, নিজের বিজ্ঞাপনও দিতে যান। ফ্যানের বালতিতে সিনেমার পোস্টার চুবিয়ে যেভাবে দেওয়ালে সাঁটা হতো, সেভাবে ফুটে উঠছে অমল, কমল, বিমলের ঘোষণা, আসিতেছে, আসিতেছে।
কী আসিতেছে?
ওই নাইন্টি পার্সেন্টের বজ্রনির্ঘোষ কিংবা ভিড়লাঞ্ছিত স্পেশাল ট্রেনে ওঠার আত্মজ্ঞাপন।
করোনা ফাঁকতালে কত কী শিখিয়ে যাচ্ছে!