কলকাতা: রোজকার ব্যস্ত জীবনে শরীরের যত্ন নিতেই হিমশিম খেতে হয়, সেখানে মনের যত্ন নেওয়া সাধারণ মানুষের কাছে বিলাসিতার মতো। অথচ বাইপোলার ডিজ-অর্ডারের (Bipolar Disorder) মতো মানসিক অসুস্থতা একটা মানুষের জীবন নষ্ট করে ফেলতে পারে। ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে খুব কম মানুষই এই রোগ নিয়ে ওয়াকিবহাল। তবে আশার কথা, ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর বাইপোলার ডিজ-অর্ডার (ISBD) এবং ইন্টারন্যাশনাল বাইপোলার ফাউন্ডেশন (IBPF)-এর উদ্যোগে ৩০ মার্চ পালিত হয় বাইপোলার ডিজ-অর্ডার সচেতনতা দিবস (Bipolar Disorder Awareness Day)। এ নিয়ে কলকাতা টিভি ডিজিটালকে মূল্যবান তথ্য দিলেন নামী নিউরো-সাইকিয়াট্রিস্ট ডাঃ দেবাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়।
তিনি জানান, পৃথিবীর অন্যতম সেরা চিত্রকর ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের (Vincent Van Gogh) জন্মদিন ৩০ মার্চ। তিনি নিজে এই রোগে আক্রান্ত ছিলেন। তাঁর বেশ কিছু বিখ্যাত ছবিতে মানুষের বাইপোলার ডিজ-অর্ডারের বিভিন্ন আঙ্গিক ফুটে উঠেছে। তাঁর জন্মদিনকেই বাইপোলার সচেতনতা দিবস হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে।
বাইপোলার ডিজ-অর্ডার ঠিক কী?
বাইপোলার ডিজ-অর্ডার এমন এক মানসিক অসুস্থতা যাতে মানুষের মুড বা মনের পরিস্থিতি, এনার্জি এবং কাজ করার ক্ষমতা অত্যন্ত ওপর-নীচ করে। আমাদের সবারই মন কখনও ভালো কখনও খারাপ থাকে। কিন্তু এই ভালো লাগা বা খারাপ লাগা যদি অনেকটা সময় ধরে অত্যন্ত বেশি রকমের হয়ে যায় তখন তা বাইপোলার ডিজ-অর্ডার। এর মধ্যে যখন বেশ কিছু দিন বা সপ্তাহ ধরে মন যদি অস্বাভাবিক খুশি থাকে, সেই অবস্থাকে বলা হয় ম্যানিক (Manic) বা হাইপোম্যানিক (Hypomanic)। এর উল্টো অবস্থা অর্থাৎ অস্বাভাবিক অবসাদে থাকা অবস্থাকে বলা ডিপ্রেসিভ। বাইপোলারে আক্রান্ত ব্যক্তির মুড এই দুই অবস্থার মধ্যে ওঠানামা করতে থাকে। মুড ওঠানামা মানেই কিন্তু বাইপোলার নয়। মানুষ মাত্রেই মেজাজের তারতম্য হয় কিন্তু তা একটা মাপের মধ্যে। বাইপোলারে আক্রান্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই তারতম্য অস্বাভাবিক বেশি।
কেউ বাইপোলারে আক্রান্ত হয়েছে কী করে বুঝব?
একজন স্বাভাবিক রয়েছে, হঠাৎ করে দেখা গেল, একটা এপিসোড ধরে তার মধ্যে প্রচুর এনার্জি চলে এসেছে, খুব খুশি দেখাচ্ছে, বড় বড় বিষয় নিয়ে প্রচুর কথা বলছে যার সঙ্গে বাস্তবতার যোগাযোগ নেই, এত কথা বলছে যে তাকে থামানো যাচ্ছে না, প্রচুর কেনাকাটা করছে। এরকম যদি এক সপ্তাহের বেশি চলে তাহলে তাকে ম্যানিক ফেজ বলা হয়। আবার খুব মনখারাপ, কিচ্ছু করতে ইচ্ছে করছে না, জীবনের প্রতি কোনও আশা নেই, ঘুমোচ্ছে না, খাচ্ছে না, ওজন কমে যাচ্ছে সেটা হল অবসাদের এপিসোড। এই লক্ষণগুলো যখন বার বার ফিরে আসে তখন বোঝা যায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বাইপোলার ডিজ-অর্ডারে আক্রান্ত হয়েছেন।
আরও পড়ুন: Talk on Facts | Sleeping Problem | ঘুমের সমস্যায় ভুগছেন? জেনে নিন জরুরি তথ্য
এই রোগ হওয়ার কারণ কী?
একদম সঠিক কারণ জানা যায় না। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, আক্রান্ত ব্যক্তির পরিবারে আগে কেউ এই রোগের শিকার হয়েছিলেন। বাবা-মা না হলেও হয়তো তিন পুরুষের মধ্যে কেউ বাইপোলারে আক্রান্ত ছিলেন। এছাড়াও সামাজিক ফ্যাক্টর গুরুত্বপূর্ণ। ঘুমের অভাব, স্ট্রেস, ড্রাগ, মদ, গাঁজা ইত্যাদি মুড এপিসোড ট্রিগার করতে পারে। আমাদের ঘুম, মুড, এনার্জি ইত্যাদি মস্তিষ্কের যে অঞ্চল থেকে নিয়ন্ত্রিত হয়, সেই জায়গার কিছু সার্কিটে সিগনালিংয়ে সমস্যা হলে কিংবা নিউরো ট্রান্সমিটারে গোলযোগে বাইপোলার ডিজ-অর্ডার হতে পারে। বাইপোলারের সঙ্গে অ্যাংজাইটি (Anxiety), পার্সোনালিটি ডিজ-অর্ডার (Personality Disorder), কমবয়সীদের মধ্যে অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপার-কাইনেটিক ডিজ-অর্ডার (ADHD) দেখা যায়। পরিবারে এই রোগের ইতিহাস থাকলে সুস্থ কোনও ব্যক্তির নেশা করা থেকেও এই রোগের জন্ম নিতে পারে।
কতটা গুরুতর এই রোগ?
যথেষ্ট গুরুতর এই রোগ। অনেকেই এই রোগটার বিষয়ে জানেন না তাই আরও বেশি করে সচেতনতার প্রয়োজন। এই রোগে যাঁরা আক্রান্ত হন তাঁদের মধ্যে ৬ শতাংশ আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেন। অন্তত ৩০ শতাংশ নিজের কোনও না কোনও ক্ষতি করেন, যেমন ট্যাবলেট খেয়ে ফেলা হোক কিংবা হাত কাটা। এটা হয় বিশেষত ডিপ্রেসিভ অবস্থার সময় অর্থাৎ লো ফেজের সময়। অনেকেই স্বাভাবিক মুড পরিবর্তন ভেবে বিষয়টিকে গুরুত্ব দেন না এবং চিকিৎসার সাহায্য নেন না। ২০১৫-১৬ সালে দেশে যে ন্যাশনাল মেন্টাল হেলথ সার্ভে হয়েছিল তাতেও দেখা যায়, আমাদের দেশের বহু বাইপোলারে আক্রান্ত মানুষ প্রয়োজন অনুযায়ী চিকিৎসা পাচ্ছেন না। অথচ একজনের সামাজিক জীবন, কর্মক্ষেত্র, সম্পর্কের উপর গুরুতর প্রভাব ফেলে এই রোগ। চাকরি ছেড়ে দেওয়া বা চলে যাওয়ার নিদর্শন কম নয়। সঠিক সময়ে চিকিৎসা না হলে এপিসোডগুলো আরও ঘন ঘন আসতে থাকে, সে সময় চিকিৎসায় আর কাজ নাও দিতে পারে। আর একটা সমস্যা হল, ডিপ্রেসনের সময় মানুষ বোঝে যে সে অসুস্থ কিন্তু ম্যানিজ ফেজে অর্থাৎ অস্বাভাবিক আনন্দিত অবস্থায় অনেকেই মানতে চান না তিনি অসুস্থ। এই সময় পরিবারকে দায়িত্ব নিয়ে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করা জরুরি।
আরও পড়ুন: Ramadan | রমজানে সুস্থ থাকতে ইফতার ও সেহরিতে যা খাবেন
বাইপোলার ডিজ-অর্ডার কি চিকিৎসায় সারে?
বাইপোলারের এত সমস্যার মধ্যেও সবথেকে ভালো বিষয় হল, চিকিৎসায় সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়া যায়। এই রোগের জন্য খুব ভালো ওষুধ রয়েছে। বাড়িতে বিদ্যুতের ভোল্টেজ ওপর-নীচ করলে যেমন ইনভার্টার কিংবা স্টেবিলাইজার মেশিন তাকে স্থিরতা দেয়, তেমনই কিছু ওষুধ রয়েছে যেগুলোকে ‘মুড স্টেবিলাইজার’ বলে। মুডের ওঠানামাকে স্টেবিলাইজ করে সেই ওষুধ। তবে ওষুধ চালিয়ে যেতে হবে। অনেকেই জিজ্ঞাসা করেন ওষুধ কতদিন খাওয়া উচিত। ডাঃ বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, বাইপোলারের এপিসোড একবার হলে অন্তত ৬ মাস ওষুধ খাওয়া উচিত। কিন্তু একটার বেশি এপিসোড হলে কিন্তু অনেকদিন ধরে ওষুধ খেতে হবে, কোনও কোনও ক্ষেত্রে সারাজীবন চালাতে হতে পারে, তাতে কোনও ক্ষতি নেই। ওষুধ নিয়মিত খেলে সুস্থ থাকা যাবে, বন্ধ করলেই সমস্যা ফিরে আসবে। এছাড়াও রয়েছে কাউন্সেলিংয়ের নানা পদ্ধতি।
বাইপোলার এপিসোড কীভাবে আটকানো যায়?
প্রথমেই মাথায় রাখতে হবে, রুটিন আর ঘুম ভীষণভাবে দরকার। ঘুম কম হলে বা অসময়ে ঘুম হলে অথবা ঘুম এবং জেগে থাকার সময়ের হিসেবে গরমিল হলে এই এপিসড বার বার আসার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। রাত্রে যথেষ্ট ঘুম দরকার এবং দিনে জেগে থাকা, এক্সারসাইজ করা, শরীর এবং লাইফস্টাইলের প্রতি নজর, ডায়েট কন্ট্রোল, যোগাসন করতে পারলে খুব ভালো, নিয়মিত কাউন্সেলিংয়ের মধ্যে থাকা, নিয়মিত নিজের সাইকিয়াট্রিস্টের সঙ্গে দেখা করা, এগুলো ভীষণভাবে দরকার। রোগটা সম্বন্ধে সচেতনতা বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। সুস্থ কোনও মানুষ যদি হঠাৎ খিটখিটে হয়ে পড়ে, চুপচাপ হয়ে পড়ে, বেশি কথা বলে তার মানে এগুলো শুরুর দিকের উপসর্গ। কিংবা কেউ যদি একবারও আত্মহত্যার কথা বলে ফেলে দেরি না করে চিকিৎসকের সাহায্য নিন।