১৯৭১ সাল। ক্লাস সিক্সে পড়ি। তখন কী আর বুঝতাম, যুদ্ধ কাকে বলে? তবু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ওই বয়সেও বুকের মধ্যে আলোড়ন তুলেছিল। রেডিওতে শুনতাম একটি গান। কার লেখা, কে গেয়েছিলেন, আজও জানি না। গানের দুচার লাইন এখনও মনে আছে। মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি। একটি ফুলের জন্য আমরা অস্ত্র ধরি। বাংলার ঘরে ঘরে রেডিওতে তখন বাজত এই গানটা। খুব জনপ্রিয় ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কথিকার অনুষ্ঠান চরমপত্র। সম্ভবত প্রতিদিন সকাল আটটায় সম্প্রচারিত হত সেই কথিকা। বাঙাল ভাষায় সেটি পড়া হত। পরে জেনেছিলাম, সাংবাদিক এম আর আখতার মুকুল সেটি করতেন।
আজও মনে পড়ে, কোনও কোনও কথিকার কিছু কিছু পংক্তি। যেমন, ইয়াহিয়া তোলে হিক্কা, ডিগবাজি খায় টিক্কা, বাংলার বিচ্ছুগুলান জ্বালাইয়া মারে। শুনে খুব মজা পেতাম। পাকিস্তানি সেনা বাহিনীর ইয়াহিয়া খান, টিক্কা খানের কথা খুব কাগজে বেরোত। প্রচুর মানুষ মেরেছিলেন তাঁরা। রোজই চরমপত্রে তাঁদের নিয়ে নানা ধরনের ব্যাঙ্গাত্মক কথা বলা হত। আর ছিল বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানের ভাষণ সম্প্রচার। ‘তোমরা আমারে দাবায় রাখতে পারবা না’ শুনে ওই বয়সেও কেমন গা গরম হয়ে উঠত।
ওই সময়েই শুনি ব্ল্যাক আউটের কথা। আমাদের মফসসলের বাড়িতে তখন বিদ্যুৎ ছিল না। তবু প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় কিছুক্ষনের জন্য হলেও হ্যারিকেনের আলো নিভিয়ে রাখতে হত। গোটা পাড়া অন্ধকার হয়ে যেত। মাঝে মাঝেই প্লেনের শব্দ শোনা যেত। আর বাড়ির বড়রা বলতেন, চৌকির নীচে লুকিয়ে পড়। আলো নিভিয়ে দে। আলো দেখলে নাকি পাকিস্তানি বিমান থেকে হামলা করা হবে।
আরও পড়ুন- স্বাধীনতা সংগ্রামী অশ্বিনীকুমার দত্তের ৯৮ তম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলী
১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর। স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয় দিবস। তার আগে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ। পরে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলেন। ১৬ ডিসেম্বর ভারতের জিওসি জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে পাকিস্থানের সেনা প্রধান নিয়াজি আত্মসমর্পণ করলেন। গড়ে উঠল স্বাধীন বাংলাদেশ। এর কিছুদিন পরেই আমাদের রহড়া রামকৃষ্ণ মিশনের স্কুলের মাঠে হেলিকপ্টারের আনাগোনা বেশ কিছুদিন ধরে।
মাস্টারমশাইরা জানালেন, জগজিৎ সিং অরোরা আসবেন স্কুলে। বাংলাদেশের জন্য সাহায্য তুলে দেওয়া হবে অরোরার হাতে। মিশন স্কুলে ছাত্রদের বলা হল, যে যা পারবে, টাকা পয়সা নিয়ে এস। পরিষ্কার মনে আছে, বাড়ি থেকে পাঁচ টাকা নিয়ে গিয়েছিলাম। তখন পাঁচ টাকারও কত দাম ছিল। আমরা অধিকাংশই ছাত্র এরকম তিন টাকা, পাঁচ টাকা দিয়েছিলাম। আমাদের এক সহপাঠী পঁচিশ টাকা দিয়েছিল। আমরা বলাবলি করতাম, ও কত বড়লোক।
যাই হোক, অরোরা আসবেন বলে কয়েকদিন ধরে মাঠে হেলিকপ্টার নামার মহড়া চলত। আমরা দৌড়ে চলে যেতাম মহড়া দেখতে। তখন এখনকার মত নিরাপত্তার এত বাড়াবাড়ি ছিল না।
যেদিন অরোরা এলেন, তার দুদিন আগে থেকেই স্কুলে পড়াশোনা লাটে। দারুণ উত্তেজনা স্কুলে, স্যারদের মধ্যে চূড়ান্ত ব্যস্ততা। প্রয়াত স্বামী নিত্যানন্দ মহারাজ সম্ভবত তখন রহড়া মিশনের সচিব ছিলেন। তিনিই অরোরাকে নিয়ে এসেছিলেন। নির্ধারিত দিনে স্কুলের মাঠ ভিড়ে ভেঙে পড়ল। আমরা ছাত্ররা সকাল থেকে ইউনিফর্ম পরে হাজির। অবশেষে দুপুরে নামল জেনারেলের হেলিকপ্টার। স্বামীজি অভ্যর্থনা জানালেন। শুরু হল অনুষ্ঠান। স্লোগান উঠল, জয় হিন্দ, জয় ভারত, জয় বাংলাদেশ। অরোরার হাতে স্বামীজি চেক তুলে দিলেন। অরোরা ভাষণ দিলেন। কিছুই বুঝিনি সেদিন। তবু উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছিলাম আমরা।