Placeholder canvas

Placeholder canvas
Homeচতুর্থ স্তম্ভFourth Pillar: মেরেছ কলসির কানা, তাই এবার আয়কর হানা 

Fourth Pillar: মেরেছ কলসির কানা, তাই এবার আয়কর হানা 

Follow Us :

ব্রিটিশ ভূখণ্ডে যাদের ঘরে টেলিভিশন আছে, যারা রেডিও শোনে তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে এই সময়ে প্রায় ১৫৪ পাউন্ড নিয়ে এক তহবিল জমা হয়। সেই তহবিল চালায় ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনের ৭৫ শতাংশ খরচ, বাকি ২৫ শতাংশ আসে বিজ্ঞাপন ইত্যাদি থেকে। এ ডিক্রি রাজার, মানে রয়্যাল প্রোক্লেমেশন। কিন্তু প্রতিদিনের খবরে, অনুষ্ঠানে কোনও দখলান্দাজি করা যাবে না, এ ব্যবস্থাও রয়েছে। আগে ট্রাস্টিরা চালাত, এপ্রিল ২০১৭ থেকে বোর্ড অফ গভর্নর্স, এনারা মোটের ওপর বিবিসির খরচ, বিভিন্ন পরিকল্পনা, আইনি বিষয়, খবরের বিশ্লেষণ ইত্যাদি দেখেন। এর পরে রয়েছে এক এগজিকিউটিভ কমিটি, যাঁরা প্রতিদিনের কাজকর্ম দেখেন। সরকারের কোনওরকম দখলদারি এখানে নেই। মজার কথা হল ওই বোর্ড অফ গভর্নর্স-এ আপাতত একজন বঙ্গসন্তান আছেন, সুমিত বন্দ্যোপাধ্যায়। দিল্লিতে পড়াশুনো করেছেন, আর ওই এগজিকিউটিভ কমিটিতে আছেন একজন ভারতীয় গৌতম রঙ্গরাজন। 

গতকাল আইটি রেড, যাকে নরম করে সার্ভে ইত্যাদি বলার চেষ্টা হচ্ছে, তা নিয়ে ওনাদের কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়া না গেলেও বলাই যায় যে দুজনেই বিব্রত। গোটা দুনিয়ার উদার গণতান্ত্রিক মানুষ ক্ষুব্ধ, আমাদের দেশের বিরোধী দল প্রতিবাদে সোচ্চার, সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন এই হুমকি, ভয় দেখানোর বিরোধিতা করেছে। এবং প্রধানমন্ত্রী যথারীতি মৌনিবাবা হয়ে বসে থাকলেও বিজেপি চুপ করে নেই, রীতিমতো সাংবাদিক বৈঠক ডেকে বিবিসি যে এক চরম দেশবিরোধী সংগঠন তা জানিয়েছে। যদিও বলেনি যে দেশবিরোধী সংগঠনকে সামলানোর জন্য ইনকাম ট্যাক্সকে কাজে লাগানোটা কী ধরনের স্ট্র্যাটেজি? কেন এই ইনকাম ট্যাক্স হানা তা বুঝবে সবাই। বোঝানোর জন্যই তো হানা, পাশে না থাকলে আজ ইনকাম ট্যাক্স, তারপর ইডি, তারপর সিবিআই, তারপর জেল এবং বিনা জামানতে পচে মরা। না সরকার, মানে মোদি সরকার কিন্তু কোনও জরুরি অবস্থা জারি করেনি। কিন্তু এ তো প্রথম নয়, প্রায় সমস্ত হিন্দি ইংরিজি টেলিভিশন চ্যানেলে জয়ধ্বজা তোলার পরেও ডিজিটাল নিউজ মিডিয়া সামলানো যাচ্ছিল না। যাচ্ছিল না বলেই নিউজ ক্লিক, বা নিউজ লন্ড্রির দফতরে হানা দেওয়া হয়েছে, দৈনিক ভাস্কর আর ভারত সমাচার-এর দফতরে রেড হয়েছে। বিনোদ দুয়ার নামে দেশদ্রোহিতার মামলা আনা হয়েছে, দ্য ওয়্যারের দফতরে হানা দেওয়া হয়েছে। 

আরও পড়ুন: Fourth Pillar: গো হাগ ডে, নির্দেশ এবং নির্দেশ ফেরত  

দ্য ওয়্যারের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক সিদ্ধার্থ বরদারাজনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল দফতর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অক্সফ্যামের রিপোর্টে দেশের বৈষম্যের চেহারা বেরিয়ে এসেছে, অক্সফ্যামের দফতরে তালা পড়েছে, আমাদের কলকাতা টিভির দফতরে তো আপাতত ইনকাম ট্যাক্স, ইডি অফিসারদের জন্য আমরা একটা ঘর ছেড়ে রেখেছি। প্রায়ই আসছেন তো, বসবেন কোথায়? ওনারা তো হুকুমের গোলাম, তাই ওনাদের দোষ দিয়ে তো লাভ নেই, আদেশ দিচ্ছেন ছোটা মোটা ভাই, আর নরেন্দ্র ভাইয়ের সম্মতি আছে, ব্যস ফুরিয়ে গেল। বিরোধিতা করলে আইটি যাবে না তো কি ফ্লুরিজ-এর ব্ল্যাক ফরেস্ট প্যাস্ট্রি যাবে? বিবিসি ডকুমেন্টারি বানিয়েছে দ্য মোদি কোয়েশ্চেন্স, এখন ইনকাম ট্যাক্স কোয়েশ্চেন পেপার নিয়ে হাজির। সঙ্গে সঙ্গে, হাতে গরম ফলাফল, আমার চেহারা দেখিয়েছ? বেশ এবার ঠ্যালা সামলাও। 
গতকাল ভোর থেকে মুম্বই, দিল্লিতে বিবিসির দফতরে ঢুকেছে ইনকাম ট্যাক্স। কর্মচারীদের, সাংবাদিকদের, ক্যামেরাম্যানদের মোবাইল কেড়ে নেওয়া হয়েছে। যারা বাইরে ছিল তাদের ঘরে পাঠানো হয়েছে, যারা অফিসে এসেছিলেন, তাঁদের বের হতে দেওয়া হয়নি। এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, সার্ভে চলছে, রেড নয়। দুটোর তফাত কী? কেউ জানে না কেউ জানে না মন জানে। নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে ভারত যখন বিশ্বগুরু হয়ে ওঠার তাল ঠুকছে, তখন এরকম এক ভয় দেখানো, হুমকিকে বিশ্ব কীভাবে নেবে? ইতিমধ্যেই নিন্দার ঝড় বয়ে যাচ্ছে, আমেরিকা, ফ্রান্স, জার্মানি, খোদ ইংল্যান্ডের বিভিন্ন মহল থেকে প্রতিবাদ জানিয়ে চিঠি আসছে। যদিও সমর্থনে কেউ নেই, তবুও মোদিজি এই অস্ত্র প্রয়োগ করেই যাবেন, ভয় দেখানো ভিতু মানুষদের বড় অস্ত্র, তারা ভাবে ভয় দেখালেই মানুষ ভয় পাবে। ইতিহাস যে ঠিক অন্য কথা বলে, তা বোঝার সামর্থ্য মোদি-শাহের নেই। 

রাজছত্র ভেঙে পড়ে, রণডঙ্কা শব্দ নাহি তোলে,
জয়স্তম্ভ মূঢ়সম অর্থ তার ভোলে,
রক্তমাখা অস্ত্র হাতে যত রক্তআঁখি
শিশুপাঠ্য কাহিনীতে থাকে মুখ ঢাকি।  

এটাই যে ইতিহাস তা তাদের জানা নেই। এই বিবিসি কি আগে রক্তচক্ষু দেখেনি? কেউ ভয় দেখায়নি? কেউ হুমকি দেয়নি? ইন্দিরা গান্ধী বিবিসি সাংবাদিকদের দেশছাড়া করেছিলেন। মার্ক টুলিকে দেশে ঢুকতেই দেননি গোটা জরুরি অবস্থা জুড়ে। খবর হয়নি? খবর থেমে গেছে? ২০ মার্চ, রাত দুটোয় এই বিবিসি-র খবর জানিয়েছিল তানাশাহি খতম, এক অখ্যাত মাথায় সবুজ ফেট্টি বাঁধা সোশ্যালিস্ট রাজ নারায়ণের কাছে রায়বেরিলি কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ৫০ হাজারেরও বেশি ভোটে হেরে গেছে। তারও খানিক আগে জানিয়েছিল অমেঠিতে যুবরাজ, সঞ্জয় গান্ধী হেরেছেন। কেবল কি এদেশ নাকি? খোদ ব্রিটেনে মার্গারেট থ্যাচার আর বিবিসির সম্পর্ক ছিল সাপে নেউলে। ৯০-এ প্রধানমন্ত্রিত্ব পদ থেকে সরে আসার পর বলেছিলেন, “I have fought three elections against the BBC and don’t want to fight another against it.” তাঁকে নিয়ে বিবিসি এক ডকুমেন্টারি তৈরি করেছিল— ম্যাগিজ মিলিট্যান্ট টেন্ডেন্সিজ। সে এক হই হই রই রই ব্যাপার, কিন্তু সে ছবি বিবিসিতে দেখানো হয়েছিল, তখন প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে মার্গারেট থ্যাচার। ফকল্যান্ড যুদ্ধের সময় বিবিসির বহু প্রতিবেদন যুদ্ধে ব্রিটেনের ভূমিকার সমালোচনা করেছিল, ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বিবিসি যথেষ্ট দেশপ্রেমিক নয় এমন কথাও বলা হয়েছিল। বিবিসি কিন্তু পেছনে হাঁটেনি, মাথা নিচু করেনি। 

আরও পড়ুন: Fourth Pillar: রাজ্যপাল নিয়োগ, বিতর্ক এবং মোদিজির ঘোলাটে অবস্থান 

আরও বড় ইতিহাস আছে বিবিসির। ১৯৮৫-তে ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট ডানকান ক্যাম্পবেল ৬টা ডকুমেন্টারির এক সিরিজে হাত দেন, সিরিজটার নাম ছিল সিক্রেট সোসাইটি। ৬টা ডকুমেন্টারিতে উনি দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন যে ব্রিটেনে আসলে কয়েকজনের তৈরি এক গোপন গোষ্ঠী আছে, যারা আসলে সবকিছু চালায়। নামেই গণতন্ত্র, আসলে এই সিক্রেট সোসাইটির লোকজনেরাই মানুষজন। তৈরির সময় থেকেই বিতর্ক চলতে থাকে, দেখানোর আগে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট উত্তাল, বহু আলোচনা, আদালত ইত্যাদির শেষে প্রথম ৫টা দেখানোর অনুমতি দিলেও শেষ মানে ৬ নম্বর ডকুমেন্টারি নিয়ে আপত্তি প্রবল হয়ে ওঠে। ওই সময় দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় ডকুমেন্টারির বিষয় ফাঁস হয়ে যায়, পুলিশ রেড চলে বিবিসির বিভিন্ন দফতরে। পুলিশ যায় ডানকান ক্যাম্পবেলের বাড়িতেও, বিবিসি কর্মচারীরা হরতাল ডেকে বসেন আর বিরোধী লেবার পার্টির লোকজন ডকুমেন্টারির কপি বিভিন্ন জায়গায় দেখানো শুরু করেন, ঠিক দ্য মোদি কোয়েশ্চেনের মতোই। বিবিসিকে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের আগেই ব্যান করেছে, চীনেও বিবিসি ব্যান। বিবিসি ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির নেতা হ্যারি পলিটের বক্তব্য সেন্সর করেছে, সেন্সর করেছে চূড়ান্ত দক্ষিণপন্থী হিসেবে চিহ্নিত অসওয়াল্ড মসলের বক্তব্যও। মোদ্দা কথা হচ্ছে নিজেদের মতো করে খবর করেছে, এই বিবিসিই বিরাট করে ভারতবর্ষে করোনা ভ্যাক্সিনেশনের প্রোগ্রাম দেখিয়েছে, তারাই আবার দ্য মোদি কোয়েসচেন তৈরি করেছে। তারা জানে এই আঘাত আসতে পারে, কিন্তু মোদিজি জানেন না যে এই ইনকাম ট্যাক্স, ইডি দিয়ে বিবিসিকে ম্যানেজ করা যাবে না। আসলে মোদিজি ভয় পেয়েছেন, ক্রমশ বাড়তে থাকা বিরোধিতার স্বর স্বৈরতন্ত্রের কাছে বিপদের ঘণ্টা হয়ে বাজে, এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। কিন্তু একে একে একটা নয়, বহু প্যান্ডোরার বাক্স খুলে দিচ্ছেন মোদিজি। না হিটলারের মতো একটা মেইন ক্যাম্ফ লেখার যোগ্যতা মোদিজির আছে, না ইন্দিরা গান্ধীর মতো বংশপরিচয়। যেসব নিয়েও হিটলার বা ইন্দিরার স্বৈরতন্ত্র উবে গেছে, মোদিজি সেখানে অত্যন্ত নিম্নমানের গ্রাম্য মোড়লের ভূমিকায় আছেন। তুমি বিরোধিতা করলেই আমি লোক পাঠাব, পুলিশ পাঠাব, এই জুজু দেখানোর খেলা কতদিন চলবে? একটা সময় ভয় ভাঙে, ভাঙবেও। আজ একজন প্রতিবাদ করছে কাল লক্ষ মানুষ প্রতিবাদ করবে, সভ্যতার ইতিহাস তো তাই বলে। শশী থারুর সম্প্রতি বলেছেন সরকার তো সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত কিশোর নয়, প্রতিটা বিষয়ে এরকম উদগ্র উত্তেজনা দেখানোর কারণটা কী? কারণ আরএসএস-এর ডিএনএ-তেই লুকিয়ে আছে। স্বাধীনতার পরে একটা একলা মানুষ ছিলেন গান্ধীজি, অন্তত সরকারের সমর্থক তো ছিলেন না, বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের বিরোধিতাই করছিলেন। গান্ধীর মতের এক্কেবারে বিরোধী আরএসএস হিন্দু মহাসভা তো অনায়াসেই গান্ধীজিকে যুক্তি দিয়ে, তথ্য দিয়ে আক্রমণ করতে পারত। তা না করে তারা গান্ধীকে হত্যা করল, ভিতু মানুষরা এটাই করে, তারা যুক্তি দেয় না, ভুল স্বীকার করে না, মানুষকে ভয় দেখায়, মানুষ খুন করে, আর সেসবের মধ্যে দিয়েই নিজেদের খোখলাপন, নিজেদের ফাঁকা অস্তিত্বের কথাই প্রকাশ করে, আজ মোদি-শাহ সেটাই করছেন।     

 

RELATED ARTICLES

Most Popular