Placeholder canvas

Placeholder canvas
Homeচতুর্থ স্তম্ভFourth Pillar: বিশ্বগুরু, গল্পের গরু গাছে উঠে পড়েছে

Fourth Pillar: বিশ্বগুরু, গল্পের গরু গাছে উঠে পড়েছে

Follow Us :

কাড়া-নাকাড়া বাজছে চতুর্দিকে। ঢাক, ঢোল, সেতার, বীণা, হারমোনিয়াম, তবলার সে এক জবরজস্ত কোরাস শোনা যাচ্ছে চতুর্দিকে। তার সঙ্গে জয়ধ্বনি, ভারত এবার বিশ্বগুরু। যা শোনা যাচ্ছে তাকে ছোট্ট করে বলে নিই। ১) ভারত এখন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ ১৯টা দেশের নেতৃত্বে এসেছে। ২) নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদি এখন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ ১৯টা দেশের নেতৃত্ব দেবেন। ৩) ভারত এখন মোদিজির স্বপ্নের বিশ্বগুরু। ৪) জো বাইডেন, দুনিয়ার সবথেকে ক্ষমতাশালী নেতা, মোদিজিকে দেখতে পেয়ে সবাইকে ছেড়ে এগিয়ে এলেন, করমর্দন করলেন। ৫) বালির প্রবাসী ভারতীয়রা উচ্ছ্বসিত, এমন প্রধানমন্ত্রী তাঁরা আগে দেখেননি, ভিডিও বার্তা দিলেন তাঁরা। তাহলে? ২০১৪তেই মোদিজি বলেছিলেন, ভারত আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে, তাঁর স্বপ্ন ভারত বিশ্বগুরু হবে। বালিতে জি টোয়েন্টি বৈঠকে সেটাই প্রমাণ হল। গোদি মিডিয়া আর আইটি সেল-এর উচ্ছ্বাস আর থামে না। ৪৭-এর পর থেকে নাকি এই প্রথম ভারতবর্ষ বিশ্বের শিখরে, উন্নয়নশীল দেশ নয়, বিকশিত দেশ, ডেভেলপড কান্ট্রিজ ইউকে, আমেরিকা, রাশিয়া চায়না সমেত ১৯টা দেশের নেতৃত্ব দিচ্ছে। হ্যাঁ, প্রচার হচ্ছে এটাই। সেই প্রচারে নতুন যোগ হল মোদিজির মন কি বাত, সেখানে তিনি খোলসা করে জানালেন, জি টোয়েন্টিভুক্ত দেশগুলো আজ ভারতবর্ষের হাতেই ভবিষ্যতের দায়িত্ব দিয়েছে, তিনি কোট আনকোট বললেন, “আপনারা কল্পনা করতে পারছেন, আজ থেকে ঠিক তিন দিন পরে, অর্থাৎ পয়লা ডিসেম্বর থেকে এত বড় গোষ্ঠীর, এবং এত সামর্থবান গোষ্ঠীর সভাপতিত্ব করতে যাচ্ছে ভারত।” তিনি অবলীলাক্রমে এই কথাই বললেন। আসুন এই প্রচারের পেছনের সত্যিটা জানার চেষ্টা করি, মানে গল্পের গরুকে গাছ থেকে নামানোর চেষ্টা আর কী। 
প্রথমে দেখে নেওয়া যাক এই জি টোয়েন্টি বস্তুটা কী? খায় না মাথায় দেয়? ৯৬-৯৭-৯৮ নাগাদ সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অর্থনৈতিক ধস নামছিল, শেয়ার মার্কেট থেকে জিডিপি সবই নিম্নগামী, তখন বিশ্বের অর্থনীতিবিদরা বলেছিলেন, এক বিশ্ব অর্থনীতির পরিপ্রেক্ষিতে এই পতন কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, গ্লোবাল ইকনমি একজায়গায় পড়তেই থাকবে, অন্য জায়গাতে তার প্রভাব পড়বে না, এমনটা নয়। কাজেই মূলত এই গ্লোবাল অর্থনীতিকে সামলাতে বিভিন্ন দেশের অর্থমন্ত্রীদের নিয়ে শুরু হল জি টোয়েন্টি সম্মেলন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন তখন ছিল না, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, ইউকে, আমেরিকা, চীন, রাশিয়া, আর্জেন্টিনা, সৌদি আরব, ইন্দোনেশিয়া ইত্যাদি দেশকে নিয়ে জি টোয়েন্টি চলা শুরু করলো ১৯৯৯তে। এর বহু পরে ২০০৮-এ আমেরিকার ওয়াশিংটনে জি টোয়েন্টিভুক্ত দেশগুলোর রাষ্ট্রপ্রধানদের নিয়ে বৈঠক শুরু হল। ২০০৯-এ দু’বার বৈঠক হল, লন্ডন আর রাশিয়ার পিটসবার্গে। কানাডার টরন্টো আর সাউথ কোরিয়ার সিওলে ২০১০-এ, ২০১১ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত বছরে একবার বৈঠক হয়েছে ফ্রান্সে, ২০১৬তে চীন, ২০১৭তে জার্মানি, ২০১৮তে আর্জেন্টিনা, ২০১৯-এ জাপান, ২০২০তে কোভিডের জন্য ভার্চুয়াল বৈঠক, হোস্ট কান্ট্রি সৌদি আরব, ২০২১-এ রোম, ইটালিতে, ২০২২-এ হল ইন্দোনেশিয়ার বালিতে। ২০২৩-এ বৈঠক বসবে ভারতবর্ষে, মানে হোস্ট কান্ট্রি ইন্ডিয়া। এরমধ্যে যদি সরকার পড়ে যায়, কোনও কারণে নরেন্দ্র মোদির জায়গায় অন্য কেউ প্রধানমন্ত্রী হন, তাহলে তিনিই বৈঠকের সভাপতিত্ব করবেন। না, নেতৃত্ব নয়, হোস্ট কান্ট্রি, আয়োজক দেশ বৈঠকের আয়োজন করবে, আয়োজক দেশের রাষ্ট্রপ্রধান বৈঠকে সভাপতিত্ব করবে এইমাত্র। আচ্ছা এটাও কি কম কথা? বিরাট ব্যাপার, এতগুলো উন্নত দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা আসবেন, তাদের সঙ্গে বিভিন্ন ডেলিগেশন আসবে, বাণিজ্য শিল্প অর্থনীতি নিয়ে কথা হবে, সেও কি কম কথা? বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তিধর দেশগুলোর সঙ্গে লেনদেন বাড়ানোর কথা হবে, প্রযুক্তির আদান প্রদানের সুযোগ থাকবে, সেও কি কম কথা? কিন্তু না, বিজেপি আইটি সেল হাস্যকরভাবে নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদিকে পৃথিবীর ২০টা বৃহত্তম দেশ ও অঞ্চলের নেতা হিসেবে প্রজেক্ট করার চেষ্টা করছে, একটা ভিডিও এই দাবির সমর্থনে ভাইরাল হয়ে গিয়েছে। জি টোয়েন্টি সামিটের মঞ্চ, সেখানে বাইডেন পেছন থেকে এগিয়ে আসছেন মোদিজির দিকে, হ্যান্ডশেক করছেন, কাট। (https://youtu.be/tGJIQ5htYHQ) মানে ভিডিও ওখানেই শেষ। দেখুন ভিডিওটা। এবার ভিডিওটা যেখানে কাটা হয়েছিল, তার পরের অংশটা দেখুন, ডায়াসে জো বাইডেন তাঁর বসার জন্য নির্দিষ্ট জায়গায় আসছিলেন, মধ্যে মোদিজির সঙ্গে হ্যান্ডশেকও করলেন, তারপর বাকিদের সঙ্গে। এবং গোদি মিডিয়া, তাদের নিউজ ক্যাপশন, মোদি সে হাত মিলানে কে লিয়ে বাইডেন বেচৈন, জো বাইডেন ওয়াকস আপ টু মোদি টু গ্রিট হিম। কী হাস্যকরভাবে এইসব ভিডিও টুইট করা হচ্ছে, আমাদের দেশে ভক্তদের উজ্জীবিত করার জন্য, কিন্তু সে টুইট তো সারা বিশ্বে বাকিদের নজরে পড়ছে, এই নির্লজ্জ প্রচারের কি কোনও দরকার ছিল? বিশ্বের নেতারা মঞ্চে যাবেন, একে অন্যের সঙ্গে হ্যান্ড শেক করবেন, কথা বলবেন, বক্তিগত সে সব মুহূর্ত ক্যামেরায় ধরা থাকবে, স্বাভাবিক। কিন্তু জো বাইডেন আমার দেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে হ্যান্ড শেক করলেন, এটা খবরের হেডলাইন? ইউকে, আমেরিকার সবথেকে বড় কাগজগুলো এই জি টোয়েন্টি সামিট চলাকালীন কী খবর করল? কোন বিষয় গুরুত্ব পেল? তাদের প্রথম পাতা কী বলছে? সামিটের মধ্যে সামিট নিয়ে তারা খবর করেছে, মানে এই সব বড় বড় সামিটে আসার পরে রাষ্ট্রনেতারা দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন, তাতে অনেক জরুরি আলোচনা হয়। তো এবার জি টোয়েন্টি সামিটে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা কোন কোন রাষ্ট্রনেতা করলেন? আমেরিকার রাষ্টপতি বৈঠক সারলেন চীনের রাষ্ট্রপ্রধান শি জিনপিংয়ের সঙ্গে, শি জিনপিং বৈঠক করলেন কানাডার জাস্টিন ট্রুডোর সঙ্গে, সেই বৈঠকের কিছু খবর প্রেসের কাছে লিক হয়ে যাওয়ায় রীতিমতো ক্ষোভ প্রকাশ করলেন শি জিনপিং। ভিডিও রেকর্ডিংয়ে দেখা গেল চীনের রাষ্ট্রপ্রধানের বিরক্তি, রীতিমতো ধমক দিলেন তিনি। এদিকে আমাদের মিনিস্ট্রি অফ এক্সটারনাল অ্যাফেয়ার্স থেকে জানানো হল, রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির বৈঠকের কথা। ক’দিনের মধ্যেই আমেরিকান পররাষ্ট্র দফতর, হোয়াইট হাউস থেকে জানিয়ে দেওয়া হল জো বাইডেন দ্বিপাক্ষিক নয় ত্রিপাক্ষিক মিটিংয়ে বসেছিলেন ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রপতি জোকো উইডোডো এবং নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সল্প সময়ের জন্য বৈঠকে বসেছিলেন। মূলত এই বৈঠক ছিল এবারের হোস্ট কান্ট্রির এবং আগামী সামিটের হোস্ট কান্ট্রির সঙ্গে সৌজন্য বৈঠক। আসলে এটা আমেরিকার রাষ্ট্রপতির সঙ্গে একান্তে বৈঠক হলেই তা এক বিরাট ব্যাপার বলে প্রচারের অঙ্গ। তারপর আরেকটা প্রচার হল, একটা ভিডিও ওই হোয়াটসঅ্যাপ ইউনভার্সিটি থেকে ভাইরাল করার চেষ্টা হল, বালির প্রবাসী ভারতীয়রা সেই ভিডিওতে বলছেন, এমন প্রধানমন্ত্রী এর আগে কখনও হয়নি, এত উন্নয়ন, এত বিকাশ, বিশ্বে এত মর্যাদা। সেই ভিডিওতেই তাঁরা নিজেরাই জানাচ্ছেন কেউ ৩, কেউ ৪ কি ৫ বছর আগে বালিতে গিয়ে বসবাস শুরু করেছেন। কী আশ্চর্য, দেশে এত উন্নয়ন, দেশে এত বিকাশ, বিশ্বে মোদিজির এত মর্যাদা, তো ওঁরা দেশ ছেড়ে বালিতে আছেন কেন? সে প্রশ্নের জবাব নেই, প্রধানমন্ত্রী গেলেন, প্রবাসী ভারতীয়রা জড়ো হয়ে মোদি মোদি বললেন, তাঁর সঙ্গে গান গাইলেন— চিঠঠি আই হ্যায়, আয়ি হ্যায়, চিঠঠি আয়ি হ্যায়। কেন? কেউ জানে না, হয়তো ওটাই তাঁদের জানা একমাত্র দেশপ্রেমের গান। (https://youtube.com/shorts/CXPecCu2i6g?feature=share) 
আসলে এক গল্পের গরুকে গাছে তুলতেই হবে। সারা বিশ্ব বলেছে, সারা বিশ্ব দেখেছে নন অ্যালায়েনমেন্ট মুভমেন্ট, জোট নিরপেক্ষ দেশগুলোর সম্মেলন, সে সম্মেলনের মাথায় ছিলেন নেহরু, নাসের, টিটো। সেই জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন শুরুই করেছিলেন এই তিনজন। তো মোদিজিকে সেই উচ্চতায় নিয়ে যেতে হবে, তাই পরবর্তী জি টোয়েন্টি সম্মেলন ভারতে হবে এই ঘোষণার পর থেকেই হাস্যকরভাবে ১৯টা দেশ আর ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের নেতা হিসেবে মোদিজিকে প্রজেক্ট করা হচ্ছে, করছে ওই হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটির অমিত মালব্য, সম্বিত পাত্র এবং দেশের গোদি মিডিয়া। এই দাবি কতটা হাস্যকর? আসুন একটা ছোট্ট তথ্য দেখা যাক। ১৯টা দেশ আর ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এই জি টোয়েন্টির সদস্য, এদের অর্থনীতির ছবিটা কেমন? ভারতবর্ষ, যাকে বিশ্বগুরু, নরেন্দ্র মোদি, যাঁকে এই দেশ ও অঞ্চল, মানে পৃথিবীর ৭৫ শতাংশ অঞ্চলের নেতা হিসেবে প্রজেক্ট করা হচ্ছে, সেই ভারতবর্ষ, এই জি টোয়েন্টি দেশগুলোর মধ্যে কোথায়? আসুন এই দেশগুলোর পার ক্যাপিটা ইনকাম, মাথাপিছু আয়ের চেহারাটা দেখা যাক। শীর্ষে আছে আমেরিকা, ৭৫,১৮০ ইউএস ডলার। অস্ট্রেলিয়া ৬৬,৪০৮ ইউএস ডলার, কানাডায় মাথাপিছু আয় ৫৬,৭৯৪ ইউএস ডলার, জার্মানি ৪৮,৩৯৮, ইউকে ৪৭,৩১৮, ফ্রান্স ৪২,৩৩০, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ৩৭,২৭৬, জাপান ৩৪,৩৫৮, ইটালি ৩৩,৭৪০, সৌদি আরব ২৭,৯৪১, রাশিয়া ১৪,৬৬৫, আর্জেন্টিনা ১৩,৬২২, চীন ১২,৯৭০, মেক্সিকো ১০,৯৪৮, তুরস্ক ৯,৯৬১, ব্রাজিল ৮,৮৫৭, দক্ষিণ আফ্রিকা ৬,৭৩৯, ইন্দোনেশিয়া ৪,৬৯১ এবং শেষ দেশটি হল ভারতবর্ষ, যে দেশের মাথাপিছু বার্ষিক আয় ২৪৬৬ ইউএস ডলার। কিন্তু এই ভারতবর্ষে বিলিওনেয়ার ১৬৬ জন, গোটা বিশ্বে বিলিওনেয়ার-এর সংখ্যায় ভারতবর্ষ তিন নম্বরে, প্রথম আমেরিকা, দ্বিতীয় চীন, তৃতীয় ভারত আমার ভারতবর্ষ, যে দেশ জি টোয়েন্টি ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে মাথাপিছু আয়ের পরিসংখ্যানে সবথেকে নীচে। কিন্তু এক ভুয়ো প্রচারে দেশকে বিশ্বগুরু বানানো হচ্ছে, দেশের প্রধানমন্ত্রী আছেন জি টোয়েন্টির নেতৃত্বে, এরকম হাস্যকর প্রচার চলছে। দেশের মানুষ অর্থনৈতিক ভাবে এগোলে, তাদের চাকরি হলে, তাদের রোটি কপড়া মকানের ব্যবস্থা হলে, দেশের অর্থনীতি ভালো হলে দেশকে বিশ্ব সমীহ করবে, আর যদি সেখানেই দেশ পিছিয়ে থাকে, তাহলে গোটা বিশ্বের কাছে এই দেশ হয়ে থাকবে ১৮-২০ কোটি বিত্তবান আর মধ্যবিত্তদের এক বাজার, যেখানে সমীহ থাকে না, যেখানকার নিয়ম হল ফেলো কড়ি মাখো তেল।                                

 

RELATED ARTICLES

Most Popular