রাজ্য বিধানসভার বৈঠকে ঠিক হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ দিবস পালন করা হবে পয়লা বৈশাখ। তার সঙ্গে এটাও ঠিক হয়েছে যে রাজ্যের জন্য বাছা হবে বা রচনা করা হবে রাজ্য সঙ্গীত। মুরলীধর লেনে গরম তেলে চুনো মাছ ছাড়লে যেরকম হয় তেমন আওয়াজ, বিরোধী দলনেতার মুখেও তাই। ওদিকে ওই বিজেপি দলেরই এক নবনির্বাচিত রাজ্যসভা সদস্য শপথগ্রহণের পরেই জানিয়েছেন, বাংলাকে ভাগ করা হবে, প্রায় গোটা উত্তরবঙ্গ নিয়ে ওঁর গ্রেটার কোচবিহারের রাজা হওয়ার খোয়াব আজ নয়, অনেক দিনের। তো থাক সে কথা, আপাতত আসা যাক বঙ্গ দিবস আর রাজ্য সঙ্গীত নিয়ে। বঙ্গ দিবস নিয়ে বিতর্ক এই ক’দিন আগেই। রাজ্যপাল হঠাৎ রাজভবনে বঙ্গ দিবস পালন করার আয়োজন করলেন। গোটা রাজ্যের মানুষ জানল না, সেখানে উপস্থিত থাকলেন না বাংলার শিল্পী, কলাকুশলী, লেখক, চিত্রকার, আমজনতা। সবে বাংলায় হাতেখড়ি দিয়ে বর্ণ পরিচয়ের প্রথম ভাগটিও শেষ না করে গলাবন্ধ কোট আর কালো চশমা চোখে রাজ্যপাল বঙ্গ দিবস পালন করলেন। অন্তত অঞ্জন দত্তকেও ডাকলে পারতেন, তাও ডাকেননি। সেদিনটা ছিল বাংলা ইতিহাসের এক কলঙ্কিত দিন, যেদিন আমাদের বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করার আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, উনি সেই কাটা ঘায়ে নুন ছেটানোর জন্য তা উদযাপন করার সিদ্ধান্ত নিলেন, বা বলা ভাল তাঁকে দিয়ে এই কাজ করানো হল। সেদিনই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন আমাদের বঙ্গ দিবস চাই। সেটাই বিষয় আজকে, পশ্চিমবঙ্গ দিবস চাই, চাই রাজ্য সঙ্গীত।
সূত্র বলছে, বৈঠকে বহু দিন নিয়ে নাড়াঘাঁটার পড়ে ছিল দুটো দিন, নবান্ন আর পয়লা বৈশাখ। শেষমেশ নবান্ন বাদ গেল দুটো কারণে। প্রথম হল নবান্নের কোনও নির্দিষ্ট দিন নেই, আলাদা আলাদা গ্রামে আলাদা আলাদা দিনে নবান্ন পালন করা হয়, আর নবান্নের সঙ্গে মিশে আছে একটু হলেও এক হিন্দু অনুষঙ্গ, তাই শেষমেশ পয়লা বৈশাখই হতে চলেছে পশ্চিমবঙ্গ দিবস। হাতেখড়ির দ্বিতীয় বর্ষে যদি তখনও রাজভবনেই থাকেন মাননীয় আনন্দ বোস, তাহলে তাঁকেও ওই উৎসবে শামিল হওয়ার নেমন্তন্ন যাবে বইকী। এবার আসুন রাজ্য সঙ্গীত নিয়ে, যা নিয়ে বিজেপি এবং বিরোধী দলনেতা বিরাট ক্ষুব্ধ। এ আবার হয় নাকি, বাংলার নিজের লোগো হয়েছে, মুখ্যমন্ত্রী বক্তৃতার শেষে জয় বাংলা বলা চালু করেছেন দেখে মায় শুভাপ্রসন্ন সমেত অনেকেই জয় বাংলা বলছেন, এবার বাংলার রাজ্য সঙ্গীত? এ তো বিচ্ছিন্নতাবাদ। এই সব নাদানদের কিছু বলার আগে বলি, এতদিন এটা হয়নি কেন? এতদিন কোনও রাজনৈতিক দল, কোনও সরকার এটা ভাবেননি কেন? সারা দেশে বহু রাজ্যের রাজ্য সঙ্গীত আছে।
আরও পড়ুন: Aajke | বিজেপি নতুন করে বাংলাকে দু’ টুকরো করার চেষ্টা চালাচ্ছে
আজ্ঞে হ্যাঁ, কাঁথির খোকাবাবু না জানলেও গুজরাত, ওঁর প্রভুর রাজ্যেও আলাদা রাজ্য সঙ্গীত আছে, জয় জয় গরভি গুজরাত, সেখানে স্কুলে, রাজ্যের বিভিন্ন সরকারি অনুষ্ঠানে এই গান গাওয়া হয়। কেবল গুজরাতে নয়, অসমের রাজ্য সঙ্গীত তো আলাদা দেশের কথা বলে, ওমুর আপনার দেশ, ও মুর সিকনি দেশ, ও মায় এনডেয়ারিং কান্ট্রি, ও মাই স্পেকলেস কান্ট্রি। অন্ধ্রপ্রদেশের আছে, বিহারের আছে, ছত্তিশগড়ের আছে, উত্তরপ্রদেশের আছে, এমনকী আজ যে মণিপুর জ্বলছে সেই মণিপুরেরও আছে— স না লৈবাক মণিপুর মণিপুর, কো লই নাংগি মণিপুর মণিপুর, এক সোনার দেশ মণিপুর। তালিকাতে আরও আছে, আছে মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, ওড়িশা, তামিলনাড়ু, উত্তরাখণ্ড, পুদুচ্চেরিরও রাজ্য সঙ্গীত আছে। আজ নয় সেই কবে থেকে আছে। নাগাল্যান্ডের মানুষজনের আবার ন্যাশনাল ফ্ল্যাগ আর সং আছে, তারা সেগুলোর স্বীকৃতিও চায়, এ নিয়ে কথাও চলছে। আমাদের রাজ্যে ছিল না, কেউ ভাবেনি, আজ সেই কথা এসেছে, ভাবনাচিন্তা চলছে, বিজেপির তাতেও আপত্তি। আসলে এই রাজ্যের লোগো, রাজ্যের আলাদা রাজ্য সঙ্গীত, রাজ্যের আলাদা দিবস এগুলো আমাদের ফেডেরাল স্ট্রাকচারের সঙ্গে মানানসই। আমেরিকাতে প্রত্যেক রাজ্যের আলাদা পতাকা আছে, আলাদা কিছু আইনও আছে, আলাদা রীতিনীতি আছে। সোভিয়েত রাশিয়া থাকাকালীন প্রত্যেক রাজ্যের আলাদা পতাকা ছিল, আলাদা আইনও ছিল। এক মহাদেশীয় চেহারার দেশে যেখানে এতগুলো এক্কেবারে আলাদা ভাষা, আলাদা উৎসব, আলাদা রীতিনীতি, আলাদা খাবার, আলাদা পোশাক সেখানে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো বজায় রাখার জন্য এটাই তো স্বাভাবিক। কেন কেউ এতদিন এদিকে নজর দেননি, সেটাই বড় প্রশ্ন। যাই হোক, বেটার লেট দ্যান নেভার, শেষমেশ আমরা একটা আলাদা দিন আর একটা রাজ্য সঙ্গীত পেতে চলেছি। আমরা আমাদের দর্শকদের কাছে প্রশ্ন রেখেছিলাম, দেশের বড় বড় রাজ্যগুলোর মধ্যে ইউপি বিহার এমপি ওড়িশা, তামিলনাড়ু সমেত ১৩টা রাজ্যের রাজ্য সঙ্গীত আছে, পশ্চিমবঙ্গের ছিল না। রাজ্যের জাতীয় দিবস আর রাজ্য সঙ্গীত ঠিক করার জন্য সরকার সর্বদল বৈঠক ডেকেছে, বিরোধী দলগুলোর এই প্রস্তাবে সম্মত হওয়া উচিত না কি বিরোধিতা করা উচিত? শুনুন, তাঁরা কী বলছেন।
সারা দেশের প্রতিটা ভাষাভাষী মানুষ তাঁদের ভাষা নিয়ে, গান, কবিতা নিয়ে গর্বিত, তাঁদের সংস্কৃতি নিয়ে গর্বিত। তাঁরা তাঁদের ভাষার সাহিত্য, গান, সিনেমাকে নিয়ে বাঁচতে চান। তাঁরা রাজ্যের মানুষজনকে সেই আইডেনটিটি দিতে চান, সেই ভাষার পরিচয়, সেই সংস্কৃতির পরিচয় দিতে চান। আমাদের রাজ্যে সব্বাই স্বাগত, সব্বাই থাকুন কিন্তু আমাদের বাংলাকে অপমান করে নয়, বাঙালির পরিচয়কে নিয়েই বাঙালি বাঁচবে। তাই আমাদের লোগো হয়েছে, আমাদের বঙ্গ দিবস ঘোষণা হোক, আমাদের রাজ্য সঙ্গীত হোক। জয় বাংলা।