কুস্তিগিরদের ‘চোখের জল’ আগামী বছর হরিয়ানা বিধানসভা ও লোকসভা ভোটে বিজেপির পক্ষে বৃশ্চিক দংশনের জ্বালা ধরাতে চলেছে। যৌন হেনস্তার অভিযোগকে ঘিরে প্রতিবাদের আগুন হরিয়ানার ‘হরাভরা’ গেরুয়া ময়দানে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ার পথে। বিজেপি এখন গুরুত্ব না দিলেও হাড়েহাড়ে যার মূল্য চোকাতে হতে পারে হরিয়ানি রাজনীতিতে। হরিয়ানা বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতাই দলের আনুগত্য মেনে কুস্তিগিরদের বিষয়ে মুখে কুলুপ এঁটে থাকলেও কয়েকজন সরব হতে শুরু করেছেন। এই সংখ্যাটা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেলে পদ্ম ফুলের পাপড়ি খসে পড়তে পারে। কারণ, রাজ্য রাজনীতিতে এই কাজে বাতাস দিতে শুরু করেছে বিরোধী দল কংগ্রেস।
শুধু হরিয়ানা কেন, মহারাষ্ট্রেও বিজেপিতে কলকে না পাওয়া সাংসদ প্রীতম মুণ্ডে এবং তাঁর দিদি পঙ্কজ মুণ্ডে দলের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গোপীনাথ মুণ্ডের এমপি-কন্যা প্রীতম বলেছেন, কুস্তিগিরদের অভিযোগ অবিলম্বে খতিয়ে দেখা উচিত। দলের সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজের বক্তব্য, এই বিজেপি তাঁর দল নয়। এর প্রত্যক্ষ কারণ হল, সাক্ষী মালিক, বিনেশ ফোগট এবং বজরং পুনিয়ার মতো আন্তর্জাতিক পদকপ্রাপ্ত কুস্তিগিররা এই ইস্যুতে দেশের সবস্তরের মানুষের সমর্থন পাচ্ছেন। তিনজনেই হরিয়ানার বাসিন্দা।
সাক্ষীর বাড়ি রোহতকের মোখরা গ্রামে। বিনেশ ফোগট এবং পুনিয়ার বাড়ি ঝাজ্জরের চরকি দাদরি এবং খুদান গ্রামে। এই কারণেই দেশওয়ালি কুস্তিগিরদের দুঃখ-যন্ত্রণা রাজ্যের রাজনীতির হাতিয়ার হয়ে উঠতে চলেছে। বিরোধী দলগুলি বিশেষত কংগ্রেস এই সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া হতে দিতে নারাজ। কুস্তিগিরদের ক্ষোভকে বিজেপি-বিরোধীরা লোকসভা ভোট এবং আগামী বছর অক্টোবর মাস নাগাদ হতে চলা বিধানসভা নির্বাচনে হাতে গরম ইস্যু করতে কোমর বেঁধেছে।
হরিয়ানার প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস কুস্তিগিরদের দিকে সমর্থনের হাত বাড়িয়ে রেখেছে। সঙ্গে সঙ্গে জাতপাতের তাস ফেলতে শুরু করেছে। উল্লেখ্য, হরিয়ানায় জাঠদের উপর কংগ্রেসের ভালো প্রভাব রয়েছে এবং আন্দোলনকারী অধিকাংশ কুস্তিগিরই জাঠ সম্প্রদায়ের। এছাড়াও চৌতালা পরিবারের লোকদল এবং জননায়ক জনতা পার্টিও কৃষক আন্দোলনের সময়ে সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। এবার কুস্তিগিরদের মঞ্চে হরিয়ানার কৃষক আন্দোলনের নেতারা শামিল হওয়ায় সর্বতোভাবে জাঠরা বিজেপির বিরুদ্ধে চলে যেতে পারে। যার ফায়দা তোলার জন্য মুখিয়ে রয়েছে কংগ্রেস।
উল্লেখ্য, হরিয়ানার বাসিন্দাদের ৩০ শতাংশ জাঠ। স্বাভাবিকভাবেই রাজ্যে জাঠদেরই আধিপত্য বেশি। ৯০ আসনবিশিষ্ট বিধানসভার ৪০টি আসনেরই ভাগ্যবিধাতা জাঠ ভোট। সে কারণে এই রাজ্যে জাঠদের আত্মাভিমানে আঘাত লাগলে ফল মারাত্মক হতে পারে। এমনিতেই গত নির্বাচনে মনোহরলাল খট্টরকে মুখ্যমন্ত্রী করে বিজেপি জাঠদের চটিয়ে রেখেছে। কারণ ৫৫ বছরের মধ্যে ৩৩ বছরই হরিয়ানায় জাঠ মুখ্যমন্ত্রীরা রাজ করেছেন।
কুস্তিগিরদের আন্দোলন মঞ্চ থেকে নগদ লাভ তুলতে ইতিমধ্যেই দফায় দফায় রাজ্যের নেতারা সহানুভূতি প্রদর্শন করে এসেছেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন বিরোধী দলনেতা ভূপিন্দর সিং হুডা, দীপেন্দ্র হুডা, শৈলজা কুমারী, লোকদল নেতা অভয় চৌতালা, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওমপ্রকাশ চৌতালা, রাজ্যের দায়িত্বপ্রাপ্ত আপ নেতা সুশীল গুপ্তা এবং প্রাক্তন এমপি অশোক তানওয়ার। যাঁদের বেশিরভাগই জাঠ সম্প্রদায়ের। সংসদের নতুন ভবন উদ্বোধনের দিন কুস্তিগিরদের উপর পুলিশি অত্যাচারের পর থেকে জাঠ ক্ষোভ আরও বেড়েছে। এই অবস্থায় রাজ্য বিজেপির অভ্যন্তরেও ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাস কমে আসছে।
রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অনিল ভিজ এবং প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বীরেন্দ্র সিংয়ের মতো কয়েকজন বিজেপি নেতা এবং শরিক জেজেপি-র কয়েকজন নেতাও প্রতিবাদী কুস্তিগিরদের সমর্থন জানিয়েছেন। জেজেপি নেতা তথা রাজ্যের উপমুখ্যমন্ত্রী দুষ্মন্ত চৌতালা কঠিন পদক্ষেপের দাবি তুলেছেন।
বিজেপির গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো কালসাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে কৃষক আন্দোলন। কৃষকদের লাগাতার আন্দোলনের মুখে কৃষি আইন প্রত্যাহারের পর থেকে বিজেপির শরিক জেজেপি-র উপর চাপ বাড়ছে গেরুয়া শিবির ত্যাগের জন্য। কারণ লোকদল ভেঙে তৈরি হওয়া এই দলেরও মূল শক্তি জাঠ ভোট। সুতরাং, দেশ ও দশের দাবি মেনে কুস্তি ফেডারেশনের সভাপতি ব্রিজভূষণ শরণ সিংকে নিয়ে বিজেপি যত তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নিতে পারবে, ততই লোকসভা ভোটে জাঠদের মন জয়ের কাজ ত্বরান্বিত হবে। না হলে কুস্তির প্যাঁচে পপাত ধরণীতল হতে হবে বিজেপিকে। বিছের হুলের বিষ মাথায় উঠে গেলে তখন ওঝাও ফেল মেরে যাবে। তাই আপাতত ব্রিজভূষণকে আইনের দরজায় দাঁড় করিয়ে জাঠ ক্ষোভ প্রশমন করাই পদ্ম শিবিরের পক্ষে মঙ্গল। তা না হলে, আগামী বছর গেরুয়া ধুলো উড়িয়ে হরিয়ানায় ফের সবুজ বিপ্লব হওয়া অসম্ভব কিছু নয়।