মোদিজির যে কোনও, যে কোনও বক্তৃতা শুনুন, কিছু না কিছু মণি মাণিক্য বের হবেই, অসাধারণ সেসব রত্নরাজি থেকে যাবে ইউ টিউবে, ডিজিটাল মিডিয়াতে, আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরেরা আজ থেকে বহু বহু বছর পরেও সেসব মণি মাণিক্য খুঁজে বার করবেন, কোথায় লাগে কপিল শর্মার কমেডি শো, তাঁরা ভেবে কুল পাবেন না, এমন এক প্রধানমন্ত্রীও ছিল, প্রতিটা বক্তৃতার কোনও না কোনও জায়গায় ছড়িয়েছেন, ছড়াচ্ছেন।
সমস্যা হল উনি কপিল শর্মা হলে তো কিছু বলার ছিল না, সমস্যা হল উনি ১৪০ কোটি মানুষের দেশে প্রধানমন্ত্রী, সংসদীয় গণতন্ত্রের বহু প্যাঁচ পয়জার আছে, তারই ফাঁকে, ওনার সৌভাগ্য, দেশের দুর্ভাগ্য যে দেশের প্রধানমন্ত্রীর সাধারণ জ্ঞানটুকুও নেই, আজ নয়, কোনও দিনও ছিল না। আজথেকে ৭ বছর আগে লোকসভার এক ভাষণ শুনছিলাম, সারবস্তু না থাক, মোদিজি চড়া নাটকীয় ভাষণ দেন, একথা সবার জানা, উনি সেদিন সেই নাটকীয় সুরেই যা বলছিলেন, সেটা শুনে নেওয়া যাক।
২০১৫, প্রসঙ্গ মনরেগা, মহাত্মা গান্ধী ন্যাশনাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি অ্যাক্ট, বক্তা সদ্য প্রধানমন্ত্রী হওয়া মোদিজি, তখনও দাড়ি বাড়েনি, কিন্তু নাটকীয়তা চুড়ান্ত, বডি ল্যাঙ্গোয়েজে ঝরে ঝরে পড়ছে কনফিডেন্স, মনে হচ্ছে এক ভবিষ্যৎবক্তা, যা বললেন তা হল, “মনরেগা নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে, কেউ কেউ বলছেন নতুন সরকার এই প্রকল্প তুলে দেবে কি না, এসব নিয়ে আপনারা বলুন, তাঁরা বলছেন আমার বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান কম আছে, থাকতেই পারে। কিন্তু একটা বিষয়ে নিশ্চিত থাকুন, আমার রাজনৈতিক বোধে কোথাও কোনও কমতি নেই, এটা তো সকলেই মানবেন। আমার রাজনৈতিক বোধ বুদ্ধি বলছে, মনরেগা কোনওদিন বন্ধ কোরওনা, আমি এরকম ভুল করতে পারি না, করবোও না, কারণ, মনরেগা আপনাদের ভুল ভ্রান্তির এক জলজ্যান্ত স্মারক, স্বাধীনতার ৬০ বছর পরেও আপনারা মানুষকে গর্ত খোঁড়ার জন্য পাঠাচ্ছেন, কটা পয়সা রোজগারের জন্য, এটা আপনাদের ব্যর্থতার স্মারক, আমি ঢাক ঢোল বাজিয়ে এই স্মারককে জ্যান্ত রাখবো। গোটা পৃথিবীকে জানাবো যে এই দেখুন, এই যে গর্ত খোঁড়া হচ্ছে, তা হল ঐ ৬০ বছরের চূড়ান্ত ব্যর্থতা।“
মাত্র ২০১৪ তে বিশ্বব্যাংক যাকে, “stellar example of rural development” গ্রামীণ উন্নয়নের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বলছে, ২০১৫ তে নরেন্দ্র মোদি জনসভার ভাষণে নয়, সংসদে দাঁড়িয়ে সেই প্রকল্পকে বলছেন, কংগ্রেসের, বিরোধী দলের ভুল ভ্রান্তির এক জলজ্যান্ত স্মারক, বলছেন তিনি, হাসছেন বেঙ্কাইয়া নাইডু, আজকের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ, রবিশঙ্কর প্রসাদের মত বিজেপি নেতারা, হাততালি দিচ্ছেন।
মাত্র এক বছর পরে ২০১৬ -১৭ র বাজেটে এই মনরেগা খাতে সরকারের বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো হল, ৩৮০০ কোটি টাকা বাড়িয়ে মোট বরাদ্দ করা হল ৩৮৫০০ কোটি টাকা, ২০১৭ – ১৮ তে ৪৮ হাজার কোটি টাকা, ২০১৮ – ১৯ এ ৬১ হাজার ৮৪ কোটি টাকা, ২০১৯ – ২০ তে ৭১ হাজার কোটি টাকা, ২০২০ – ২১ তে ৯৮ হাজার কোটি টাকা, যদিও আসলে খরচ হয়েছিল ১ লক্ষ ১১ হাজার ১৭০ কোটি টাকা, ২০২২ এ মনরেগার বাজেট কমেছে, বরাদ্দ হয়েছে ৭৩ হাজার কোটি টাকা, কারণ সরকারকে করোনা কালে আরও অন্য সহায়তা, ফ্রি র্যা শন ইত্যাদি দিতে হয়েছে। মানে কি দাঁড়ালো?
আমাদের প্রধান সেবক যাকে “বিফলতায়োঁ কা জিতা জাগতা স্মারক” বলেছিলেন, ২০১৫ তে, সেই প্রকল্পতে, তেনারই সরকার ক্রমশ কিছুটা হলেও বরাদ্দ বাড়িয়েছে, এখনতো জনসভায় মোদিজি এই প্রকল্পে কত খরচ করেছেন, কত মানুষ এই প্রকল্পের সুবিধে পাচ্ছে, এই প্রকল্পের ফলে কত সম্পদ তৈরি হচ্ছে, সেটা জোর গলায় বলছেন, এটাও নাকি তাঁর কৃতিত্ব, হ্যাঁ বলছেন, জনসভায় বলছেন হমনে ইস করোনা কাল মে মনরেগা কে তহত ৭৩ হাজার করোড় রুপিয়া খর্চ কিয়ে, একবারও বলছেন না যে এই প্রকল্প কংগ্রেস সরকার থাকাকালীন শুরু হয়েছিল, যা নিয়ে তিনি সংসদে খিল্লি করেছিলেন, সুযোগ মত মোদিজি সব ভুলে যান, এটাও ভুলে গেছেন, কিন্তু আমরা ভুলি নি।
কথা হচ্ছিল মনরেগা নিয়ে, কারণ আমরা এই প্রকল্পকে আরও ব্যাপক দেখতে চাই, আরও বেশি মানুষ, আরও বেশি বরাদ্দ হোক সেটা চাই,কারণ শিল্প, ভারি শিল্প, ছোট মাঝারি শিল্পের যত ঢাকই পেটানো হোক, এখনও ভারতবর্ষ এক কৃষিপ্রধান দেশ, ভারতবর্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এখনও গ্রামেই বসবাস করেন, গ্রামীণ গরীব মানুষদের উন্নয়নই, দেশের সার্বিক উন্নয়নের প্রথম সোপান, এটাই গান্ধিজী বুঝেছিলেন, বলেছিলেন।
সেইজন্যই কংগ্রসের রাজত্বকালে হাজার দুর্নীতি, হাজার ভুল ভ্রান্তির পরেও এক সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার স্টেটে, গ্রামীণ মানুষদের আয় বৃদ্ধির কথা ভাবা হয়েছিল, কংগ্রেসের মধ্যেকার বাম, বা অন্যান্য বামপন্থী দলগুলোর সাহায্যে এসেছিল এই মনরেগা প্রকল্প, ঠিক এইখানেই কংগ্রেসের প্রাসঙ্গিকতা আজও থেকে গেছে, তাদের সাংগঠনিক চেহারা নিয়ে হাজার প্রশ্ন আছে, একটা দল ক্রমশ সংসদীয় রাজনীতিতে হেরেই চলেছে, একের পর এক রাজ্য তাদের হাতছাড়া হয়েছে, কংগ্রেসের থেকে ভেঙে বেরিয়ে এসে তৈরি হয়েছে আঞ্চলিক দল, কংগ্রেসের নেতৃত্বের চূড়ান্ত ব্যর্থতাকে কাজে লাগিয়েই বিজেপির এই বাড় বাড়ন্ত, কিন্তু তারপরেও কংগ্রেসের মূল দর্শন এখনও প্রাসঙ্গিক, এখনও জরুরি।
সেই পরিসরকে বাদ দিয়ে, বিজেপি বিরোধী রাজনীতি করা যাবে না, কারণ উল্টোদিকে একটা দল নয়, আর এস এস – বিজেপি এক দর্শনকে নিয়ে এসেছে, তাদের সেই সুনির্দিষ্ট দর্শনের ভিত্তিতেই তারা চলেছে, ভোটের জন্য তারা মনরেগাকে কাজে লাগাচ্ছে বটে, কিন্তু তারা এই দর্শনের বিরোধী, তাদের নির্দিষ্ট দর্শনের বিরুদ্ধে কেবল একটা রাজনৈতিক দল বা কিছু রাজনৈতিক দলের জোটই যথেষ্ট নয়, দরকার এক উল্টোদিকের, এক বিকল্প দর্শন। তার ভিত্তি কী?
আলোচনা শুরু করেছিলাম মনরেগা দিয়ে, যা ছিল সেই বিকল্প দর্শনেরই প্রতিচ্ছবি। সেই বিকল্প দর্শনের ভিত্তি হল সেকুলারিজম, ধর্মনিরপেক্ষতা। ধর্ম এক ব্যক্তিগত বিশ্বাস, রাষ্ট্র সে ব্যাপারে নাক গলাবে না।
দু নম্বর ভিত্তি হল এক যুক্তরাষ্ট্র কাঠামো, দেশে নানান রাজ্য, নানান ভাষা, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক, সংস্কৃতি, উৎসব আছে, তার সবকটাকেই প্রাধান্য দিয়ে এক কেন্দ্রীয় সরকার নয়, এক ফেডারেল গভর্নমেন্ট দেশের সার্বিক উন্নয়নের অন্যতম শর্ত, রাজ্যপাল দিয়ে, বিভিন্ন ফতোয়া আর নিয়ম জারি করে রাজ্যের ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে, এক ঠুটোঁ জগন্নাথ রাজ্য কাঠামো, আমাদের দেশের উন্নয়নের বিপ্রতীপ ধারণা, এটা বুঝতেই হবে।