গান্ধী হত্যাকারীরা, মহাত্মা গান্ধীর প্রয়াণদিবসে গান্ধীমূর্তিতে মালা দিলেন, নরেন্দ্র মোদী দিল্লিতে, আদিত্যনাথ যোগী লক্ষ্ণৌতে, জগদীপ ধনখড় ব্যারাকপুরে, কেবল মালা দিলেন? অনেক কথাও বললেন। আমাদের রাজ্যের বিজেপি হেডকোয়ার্টার এখন রাজভবনেই, খুব স্বাভাবিক, কারণ রাজ্য বিজেপি তো লাটে উঠেছে, পিকনিক আর পালটা পিকনিক নিয়েই ব্যস্ত, তাহলে বিজেপির কাজটা করবে কে? অন্তত সাংবাদিকদের সামনে বিবৃতি দেবে কে? আমাদের ট্যাক্সের পয়সায় দিনযাপন করনেওয়ালা, রাজ্যপাল ধনখড় সেই দায়িত্ব নিয়েছেন, বলেছেন বাংলা নাকি সন্ত্রাসের গ্যাস চেম্বার হয়ে যাচ্ছে, হঠাৎ গ্যাস চেম্বার কেন? ওনাদের পূর্বসুরিদের কথা মনে পড়েছে নিশ্চয়ই, হিটলারের জমানাতেই তো এই গ্যাস চেম্বারের আমদানি, গান্ধী মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে তেনার একবারও মনে হয়নি, এই খেটো ধুতি পরা অশক্ত লোকটার বুকে তেনাদেরই ষড়যন্ত্রে, বেরেটো পিস্তলের তিন খানা গুলি পুরে দেওয়া হয়েছিল, না এসব মনে হয়নি, তাই নির্লজ্জের মতই মালা দিয়েছেন, গরুর রচনা বলার মত মুখস্ত বলেছেন কিছু কথা, যা বলার কড়ারে তিনি রাজ্যপাল পদে বসে আছেন।
এই বাচাল, অনর্গল মিথ্যে বলা রাজ্যপালকে নিয়ে, আর কিছু বলার কোনও কারণ দেখছি না, তবে এই প্রসঙ্গেই থাকবো। কারণ ইনি তো নেহাতই বোড়ে, পেয়াদা মাত্র, দিল্লি থেকে দম দেওয়া হচ্ছে, উনি বাংলায় নাচছেন। দেশের রাজনীতির ভরকেন্দ্র এই সময়ে উত্তরপ্রদেশে, সেখানে রোজ নিত্য নতুন খবর তৈরি হচ্ছে, নিত্য নতুন কথা শোনা যাচ্ছে, স্বাভাবিকভাবেই মাঝে মধ্যেই আপনারাও চাইবেন উত্তরপ্রদেশ নিয়ে আলোচনা হোক, আমিও করবো। বিজেপি পাড়ার ক্লাব ইলেকশনও গুরুত্ব দিয়ে লড়ে, উত্তরপ্রদেশ তো তাদের মরণ বাঁচনের সমস্যা, কাজেই ঠিক বাংলার নির্বাচনের আগে যেমন শয়ে শয়ে প্রচারগাড়ি এসেছিল, তার একধারে টিভি লাগানো ২৪ ঘন্টা সেই টিভি স্ক্রিনে মিথ্যে প্রচার চলতো, আমরা দেখেছি, দিল্লির মানুষ দেখেছেন, এখন ইউ পির মানুষ দেখছেন, সে সব গাড়ি ইউ পির রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে। এবং প্রথমে মনে হয়েছিল আদিত্যনাথ যোগীর হাতেই থাকবে, বিজেপির প্রচার ব্যবস্থা, ক্রমশঃ তিনি দেশের দু নম্বর আসনের দিকে এগোচ্ছেন, মোদী – শাহের ক্ষমতাকেন্দ্রের বাইরে তৈরি হচ্ছিল আরেকটা ভরকেন্দ্র, ইউ পিতো ছেড়েই দিন, দিল্লিবাসীরা কদিন আগেই দেখেছেন, এমন কি দিল্লিও ঢাকা পড়েছিল আদিত্যনাথের পোস্টারে, না সেই পোস্টারে ছোট বা বড় মোটা ভাইয়ের ছবি বা নামও ছিল না, দেশের সেই প্রান্ত যেখানে বিজেপির কোনও ক্ষমতাই নেই, সেই কেরালাতেও বক্তৃতা দিতে ডাকা হচ্ছিল আদিত্য নাথ যোগীকে, ফাঁকা ময়দানই সই, এ বাংলাতেও যোগিজীকে আমরা ভাষণ দিতে দেখেছি, নির্বাচনের সময়ে।
তাই আমাদেরও মনে হয়েছিল অমিত শাহ চ্যালেঞ্জের মুখে, যোগী উঠে আসছে। এই সময়ে মোদিজীর বিশ্বস্ত শর্মাজীকেও পাঠানো হয়েছিল হাল ধরতে, তো তাকেও সাইডলাইনে বসিয়ে কার্যত চ্যালেঞ্জ করেছিল কনফোড় যোগী আদিত্যনাথ, গোরখপুরের পিঠাধীশ। কিন্তু ঠিক ভোটের আগেই আর এস এস – বিজেপির করা এক সমীক্ষায় দেখা যায় অবস্থা গুরুতর, যোগী হারতে চলেছে, আবার যোগী হারলে ২০২৪ এ মোদীজীও হারবেন, এই সত্যকে মাথায় রেখে যোগিজী গুটিয়ে গেছেন, তাঁর মথুরা বা অযোধ্যায় লড়াই ইচ্ছেকেও পাত্তা দেওয়া হয় নি, পাঠানো হয়েছে গোরখপুরে, দায়িত্ব হাতে নিয়েছেন ছোটা এবং বড়া মোটাভাই।
আরও পড়ুন: চতুর্থ স্তম্ভ : ইউ পি মে কা বা?
এক্কেবারে ভবানীপুরের দৃশ্যের রেপ্লিকা, রাস্তায়, ঘরে ঘরে লিফলেট বিতরণ করছেন অমিত শাহ, বিজেপির মধ্যে এখনও অবশিষ্ট জাঠ নেতাদের ডেকেছেন, পাগড়ি পরেছেন আর বলেছেন বিজেপি আর জাঠ নেতাদের সম্পর্ক নাকি ৬০০ বছরেরও পুরোন, ভাবা যায়? ওনার জানাই নেই দেশভাগের সময়ে বিরাট উত্তর প্রদেশ জুড়ে মুসলমান জনসংখ্যার বিরাট অংশ, কেবল জাঠ নেতাদের আশ্বাসে থেকে গিয়েছিলেন এই দেশে, তাঁরা সেদিন দেশের মুসলমানদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, এই মুসলমান কৃষকরা সেদিন জাঠ কৃষকদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, দেশের অন্ন সংস্থানের কাজ করছিলেন, এসব ইতিহাস অমিত শাহের জানা নেই, জানা থাকার কথাও নয়, এরপর এক সভায় গিয়ে তিনি চৌধুরি চরণ সিংহের নাতি জয়ন্ত চৌধুরি সম্পর্কে বললেন, জয়ন্ত চৌধুরি নাকি নির্বাচনের পরে তাঁদের সঙ্গেই আসবেন, সঙ্গে সঙ্গেই কড়া জবাব, আমি চৌওন্নি নই, চার আনা নই, যে সময় দেখে পালটে যাবো, বললেন জয়ন্ত চৌধুরি.
কৃষক আন্দোলনের ফলে জাঠ কৃষক সমাজের বিরাট ভোট যে এবার বিজেপি পাবে না, সে কথা বুঝেছেন অমিত শাহ, তাই জাঠেদের ম্যানেজ করার চেষ্টা করছেন, হিসেব বলছে ২০১৭ সালে ৭০% জাঠ ভোট পড়েছিল বিজেপির দিকে, ২০১৯ সালে ৯০% জাঠ ভোট পড়েছে বিজেপির দিকে, এবার? এবার জাঠভোটের ২০% ও তারা পাবে না, পাবে না জেনেই পা কাঁপছে বিজেপির, উল্টোপাল্টা বকছেন ছোটা মোটা ভাই।
পশ্চিম উত্তর প্রদেশের, যে ৫৮ টা আসনে ভোট হতে চলেছে ১০ ফেব্রুয়ারি, তার ৫৩ টা আসনে জিতেছিল বিজেপি ২০১৭ তে, বিজয়রথের ঘোড়া ছুটেছিল, এবার? এবার এই ৫৮ টা আসনে ১৫ টা আসন ধরে রাখাও সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছে না, তাই আর বিকাশের কথা নয়, উন্নয়ন বিকাশ, সব কা সাথ সবকা বিকাশ এসব উবে গেছে, এখন তীব্র সাম্প্রদায়িক প্রচারে নেমেছে বিজেপির অমিত শাহ, যোগী, মোদী।
আরও পড়ুন: চতুর্থ স্তম্ভ : মিনি সাধারণ নির্বাচন
প্রায় রাস্তার গুন্ডা বদমাস, হিন্দি সিনেমার ভিলেনের গলার সুর তাদের গলায়, অমিত শাহ বলছেন সমাজবাদী দল জিতলে হিন্দুরা আবার আক্রান্ত হবে, আবার মুজফফরনগরের দাঙ্গা হবে, মুসলমানদের হাতে ক্ষমতা আসবে, কেন বলছেন? কারণ ঐ জাঠ হিন্দু সামাজিক ঐক্যকে ভাঙার জন্য অত্যন্ত পরিকল্পনা করে দাঙ্গা লাগানো হয়েছিল, ২০১৩র ঐ দাঙ্গার ফসল তুলেছিল বিজেপি, প্রথমে ২০১৪তে, তারপর ২০১৭, শেষে ২০১৯। আসুন দেখে নিই জাঠ ভোটের অবস্থা টা কেমন? আর তার সঙ্গে মুসলমান ভোটের হালই বা কী?
উত্তরপ্রদেশকে অবধ, মানে মধ্য ইউপি, বুন্দেলখন্ড মানে উত্তর ইউ পি, পশ্চিমাঞ্চল মানে উত্তর প্রদেশের পশ্চিম দিক আর পূর্বাঞ্চল মানে পূর্ব উত্তরপ্রদেশ, এভাবেই ভাগ করে নিলে সুবিধে হবে, জাঠেরা মূলত ঐ পশ্চিমাঞ্চল জুড়েই আছে, সেখান থেকেই হরিয়ানা, আর রাজস্থান, এই বিরাট জায়গা জুড়ে জাঠেদের ডেমোগ্রাফিক অবস্থান, এঁরা মূলত কৃষক আর এঁদের প্রত্যেক ঘর থেকেই, ভারতীয় সেনাবাহিনীতে বিরাট যোগদানের ইতিহাস আজ নয়, সেই ব্রিটিশ আমল থেকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লড়েছেন, প্রাণ দিয়েছেন, এক কথায় যে জয় জওয়ান জয় কিসান শ্লোগান, তা ঠিকঠাকভাবে প্রযোজ্য এই জাঠেদের জন্য। তারা গর্বিত কৃষক, তারা গর্বিত জাতীয়তাবাদ নিয়ে। এই জাঠেরা সামাজিকভাবে কিন্তু ভয়ঙ্কর প্রাচীনপন্থী, সরকার নয়, ইলেকটেড পঞ্চায়েত নয়, এমন কি এম এল এ বা এম পিও নয়, এদের সামাজিক পরিচালন কেন্দ্র হল জাঠ গোষ্ঠির বিভিন্ন খাপ, বালিয়াঁন, তোমর, পানওয়ার, শেরাওত, বেনিয়াল, পুনিয়া, নহরওয়াল এরকম অজস্র খাপ আছে, আর তাদের সমাজে এই খাপ নেতাদের কথাই শেষ কথা, নারীদের অধিকার অস্বীকৃত, ভিন্ন ধর্মে বা জাতে তো দুরের কথা, ভিন্ন গোত্রে বিয়ে চলবে না, খাপ রায় দিলে সে বিয়ে অসিদ্ধ, লিঙ্গ বৈষম্য, কন্যা ভ্রুণ হত্যা, অনার কিলিং এই খাপেদের প্রত্যক্ষ সহায়তায় হয়, আবার কথার দাম, শরণাগতকে রক্ষা করা, অন্যায় মেনে না নেওয়া এসব দিক থেকেও জাঠেরা অনন্য। ইদানিং বিভিন্ন খাপে, নতুন নেতারা আসছেন, আধুনিক মতামতও আসছে, সে এক অন্য আলোচনা। পশ্চিমাঞ্চলে জাঠেদের ভোট কমবেশি ২৭%, কমবেশি ১১৫/১২০ টা আসনে তারা ফ্যাক্টর, তাদের ভোট কোনদিকে যাবে তার হিসেব রাখতেই হয়।
একসময় জাঠরা কংগ্রেসকে ভোট দিত, খুব তাড়াতাড়িই সে ভোট কৃষক পার্টি, কৃষক নেতাদের হাতে যায়, চরণ সিং অবিসংবাদী নেতা ছিলেন, ২০১৪ থেকেই মূলত এই জাঠেরা বিজেপির দিকে ঝোঁকে। এবার মুসলিম জনসংখ্যা, পশ্চিমাঞ্চলে ৭/৮% মুসলিম ভোটার আছে, তারা একটা বড় সময় কংগ্রেসের সংগে ছিল, বাবরি মসজিদের ঘটনা চলাকালীন তারা সমাজবাদী দলের দিকে ঝোঁকে, একসময় তো মুল্লায়ম সিং কে মোল্লা মুল্লায়মও বলা হত, কিছু ক্ষেত্রে এদের ভোট গেছে বি এস পি র দিকে।
আরও পড়ুন: চতুর্থ স্তম্ভ : গণতন্ত্র
পরবর্তীতে, মানে ২০১৪ থেকে মুসলমান ভোট স্ট্রাটেজিক্যালি পড়েছে, বিজেপি কে যে প্রার্থী হারাতে পারে বলে তারা মনে করেছে, সেদিকেই তাদের ভোট পড়েছে। ২০১৩ তে, মুজফফরপুরে যে দাঙ্গা হয়, তারপর থেকে জাঠ – মুসলমান সম্পর্ক তলানিতে নামে। মুসলমান বিরোধী হিসেবে জাঠ ভোট বিজেপিতে পড়তে থাকে, ২০১৯ এর হিসেব, জাঠ ভোটের ৯০% পড়েছিল বিজেপিতে। বহু আগে মধ্য ৭০/ ৮০ / ৯০ তে জাঠ কৃষকদের সবচেয়ে বড় সংগঠনের নেতা ছিলেন, আজকের রাকেশ টিকায়েতের বাবা, মহেন্দ্র টিকায়েতের সময়ে একটা শ্লোগান খুব জনপ্রিয় ছিল, মহেন্দ্র টিকায়েত মঞ্চ থেকে বলতেন হর হর মহাদেব, উপস্থিত কৃষকরা বলতেন আল্লা হু আকবর, টিকায়েত বলতেন আল্লা হু আকবর, কৃষকরা বলতেন হর হর মহাদেব, হ্যাঁ এতটাই অসাম্প্রদায়িক ছিলেন জাঠেরা, কিন্তু ঐ মুজফফরনগর দাঙ্গার পরে সেটা বদলে যায়।
কিন্তু এই কৃষক আন্দোলন আবার জাঠ মুসলিমদের কাছে আনে, আবার সেই শ্লোগান ওঠে, রাকেশ টিকায়েতের অনশন ভঙ্গ করার জল নিয়ে যান মুসলমান রমণীরা, সব মিলিয়ে তারা তাদের ভুল বুঝেছে, তারা ঐক্যবদ্ধ, তারা কৃষি আইন নিয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছে, আর এইখানেই ক্যাচাল, এইখানেই অমিত শাহ – মোদী – যোগীর যাবতীয় ছক ভেঙে গেছে, সকাল সন্ধে এখন অমিত শাহ পশ্চিমাঞ্চলে, কিভাবে জাঠেদের সামলানো হবে তাই ভাবছেন, জাঠ মুসলিম ঐক্য তাঁদের হিসেব গুলিয়ে দিয়েছে, ঠিক এইখানেই একটা কথা, জয়ন্ত চৌধুরি পরে বলেছেন, পশ্চিমাঞ্চলের জাঠেরা বলছেন, সেই জাঠেরা চৌওন্নি, যারা বিজেপির দিকে আছে, তারা পালটি খাবে, পালটি খায়। এদিকে জানা গ্যালো, আমাদের পয়সায় রাজভবন দখল করে বিজেপির দায়িত্ব যাঁর কাঁধে, সেই ধনখড়, তিনিও জাঠ, তিনিও চৌওন্নি, চারা আনার সিকি, গড়িয়ে দিলেই উলটে যায়, পালটে যায়। এবং তিনি দবি চৌওন্নি, খোটা চৌওন্নি, অচল চার আনার সিকি, এটা আমাদের মতামত।