রোজ এই চতুর্থ স্তম্ভ নিয়ে হাজির আমি চিৎকার করে বলতে, রাজা তুই উলঙ্গ। হাজির জোর গলায় প্রশ্ন করতে, এইইই রাজা তোর কাপড় কোথায়?
স্বাধীনতা পাবার পর ২৯৯ জন সংবিধান সভার সদস্য মিলে ১৬৫ দিন আলোচনার পর ২৪ জানুয়ারী ভারতবর্ষের প্রথম সংবিধান এর খসড়াটি অনুমোদন করে যা ২৬ জানুয়ারি থেকে কার্যকরী হয়। সেই দিনটাই আমাদের গণতন্ত্র দিবস। যে গণতান্ত্রিক ধারণা ছাড়া স্বাধীনতা অর্থহীন। কদিন আগেই এই ৭২ তম গণতান্ত্রিক দিবসে কুচকাওয়াজ হয়েছে। রাষ্ট্রপতি ভাষণ দিয়েছেন, গণতন্ত্রের কথা বলেছেন, দেশের নাগরিকদের জন্য ভাষণ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তো ভাষণ দিয়েই চলেছেন, অভ্যাগতদের সারি তে নিশ্চিত থাকেন দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ, মন্ত্রীসভার আরও বড়বড় মন্ত্রীরা, দেশের কেউকেটারা। দেশের মানুষদের জন্য সমর্পিত হচ্ছে বিভিন্ন প্রজেক্ট। আর কদিন পরে দেশের মানুষ নির্বাচিত করবে দেশের ৫৪২ জন সাংসদ কে, যাঁড়া আগামী ৫ বছর দেশ চালানোর দায়িত্ব নেবেন। কিন্তূ মোদী সরকার জানেনই না কারা দেশের নাগরিক, জানেন না যাঁরা ভোট দিয়ে তাঁদের সরকারে পাঠিয়েছেন তাঁরা নাগরিক কি না, কি কিউট তাই না।
কারণ এই সংবিধানের মূল ধারণা কে কলা দেখিয়ে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলটি এখন আইন, লোকসভায় প্রায় কোনও আলোচনা ছাড়াই তা এখন আইন। কিন্তু ঐ পর্যন্তই, এখনও তা গাজরের মত লটকে আছে, আজ লাগু হবে কাল লাগু হবে, একই ধানাই পানাই চলছে। শোনা যাচ্ছে তা নাকি নির্বাচন ঘোষণার আগেই লাগু করা হবে। এখন এই পাশা পাশি দেশ থেকে বহু মানুষ ঢুকে পড়ছে দেশে, এমন অভিযোগ বেশ পুরোন। দেশভাগের পর থেকেই এই অভিযোগ উঠে আসছে বহুবার, বিশেষ করে সীমান্তবর্তী রাজ্য থেকে। আসামে আন্দোলন দাঙ্গা কী হয়নি? হাজার হাজার মানুষ মারাও গেছে। সত্যিই তো যদি সীমান্তের ওপার থেকে হু হু করা মানূষ ঢুকতে থাকে তাহলে তো বিপদ, একেই আমাদের বাড়তে থাকা জনসংখ্যা, তার ওপরে যদি অনুপ্রবেশ ঘটতেই থাকে তাহলে তা তো বিপদজনক। তাকে আটকানো হোক তা নিয়ে কারোর কোনও দ্বিমত নেই। সমস্যা হল এই সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে ঘৃণ্য রাজনীতি করা হচ্ছে। প্রথমে আসামে এন আর সি র কথা বলা হল। কোটি কোটি অনুপ্রবেশ হয়েছে, এন আর সি তালিকায় এলেন মাত্র ১৯ লক্ষ মানুষ। তার মধ্যে ১৪ লক্ষ হিন্দু, ১ লক্ষ গোর্খা, ৪/৫ লক্ষ মুসলমান। কোথায় যাবেন এরা? ডিটেনসন ক্যাম্প এ রাখা হয়েছে। রয়েছেন প্রাক্তন সরকারি কর্মচারী, সেনা বাহিনী তে কাজ করা সৈনিক। হিন্দুত্বের ধ্বজা ওড়ানো বিজেপি নেতা দের মাথায় হাত, ১৪ লক্ষ হিন্দু অনুপ্রবেশকারী! এবং এই সাংঘাতিক ১৯ লক্ষ অনুপ্রবেশকারী দের বাছতে খরচ হয়েছে ১৬০০ কোটি টাকা।
দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্বত্র বলে বেড়াচ্ছেন যে সারা দেশ জুড়ে এন আর সি হবে। কেবল আসামেই এন আর সি করতে ১৬০০ কোটি টাকা খরচ হলে সারা দেশ জুড়ে এই খরচ কত দাঁড়াবে বুঝতে পারছেন? সে পয়সা কোথা থেকে আসবে? দেশের জিডিপি ৪.৫ এসে ঠেকেছে, মূল্যবৃদ্ধি আকাশ ছুঁয়েছে, চাকরি নেই, শিল্পে বিনিয়োগ নেই, এই মন্দা কবে কাটবে জানা নেই। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী র এন আর সি চাই, সি এ এ লাগু হবেই।
আমিত শাহ বলছেন ভোটের আগেই সি এ এ হবে। তার মানে কী? গত দশ বছরে জনগণনাই হয়নি, কিসের ভিত্তিতে লাগু হবে এই সি এ এ? কারা খোয়াবেন নাগরিকত্ত্ব? মতুয়াদের বলছেন আপনারা আবেদন করুন, নাগরিকত্ব দিয়ে দেওয়া হবে। কি আশ্চর্য গত ৪০ বছর ধরে যাঁরা প্রতিটি নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন, এখানে ঘর বাড়ি করে বসবাস করছেন, তাঁদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে? কেন?
এন আর সি করে আসামে ১৪ লক্ষ হিন্দু পাওয়া গিয়েছিলো, তাদের কী হয়েছে? তাদের কোথায় পাঠানো হয়েছে? ডিটেনসন ক্যাম্পে রাখা হয়েছে? তালে লাভ কী? এর পরে কী হবে? প্যুস ব্যাক? কোন দেশে পাঠাবেন? বাংলাদেশে নরেন্দ্র মোদী বলেছেন এন আর সি আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়! তাহলে? এদিকে অসম বিজেপি ইতিমধ্যেই যখন বলতে শুরু করেছেন এই এন আর সি তারা মানছেন না। যাকে বলে বৃহৎ কেলো। সেই সময়ে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল আনা হল, পাশ করানো হল। আইনে ঠিক কী কী আছে জানা নেই কারোর। এটা হল বিজেপি স্টাইল অফ ফাংসনিং। ডান হাত কী করবে বাম হাত জানে না, বাম হাত কীকী করবে ডান হাত জানে না। রাজ্যপাল আগের দিন জানেন না যে পরেরদিন রাজ্য ভেঙে দু টুকরো হয়ে যাবে, রাষ্ট্রপতি সন্ধ্যেয় জানেন না যে সকালবেলায় রাষ্ট্রপতি শাসন তুলে নেওয়া হবে, মিডিয়া সকাল ৬ টায় জানতে পারে যে আর আধ ঘন্টা পরে মুখ্যমন্ত্রী শপথ নেবেন। এটা হল জেমস বন্ডের খেলা বা যাদুকর পিসি সরকার। সেই নিয়ম মেনেই আইন এ কী আছে, কী ভাবে তা প্রয়োগ হবে তা জানার চেষ্টাও করা যাবে না। যে টুকু ওনারা নিজেরাই বলেছেন তা থেকে বোঝা যাচ্ছে যে এই আইনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ, পাকিস্থান, আফগানিস্তান থেকে আসা হিন্দু, জৈন, বৌদ্ধ, শিখ, পারসি, খ্রিস্টান দের মধ্যে যারা ২০১৪ র মধ্যে এদেশ এ এসে গেছেন তাদের নাগরিকত্ব পেতে কোনও অসুবিধে হবে না। মানে হল আসামে ঐ ১৪ লক্ষ হিন্দুরা এদেশের নাগরিকত্ব চাইবেন, তাদের দিয়ে দেওয়া হবে, মুসলমান হলে রেহাই নেই। FINAL SOLUTION এর কথা মনে পড়ছে? প্রথমে ইহুদি দের চিহ্নিত করা হয়েছিল তারপর তাদের গ্যাস চেম্বারে ঢোকানো হয়েছিল ।
এবারে আমাদের সংবিধানের দিকে একবার চেয়ে দেখুন, যে সংবিধান কে মেনেই আমাদের দেশ চালানোর কথা। যে সংবিধান আমাদের স্বাধীনতার ভিত্তি, আমাদের অধিকার এর রক্ষাকবচ। সেই সংবিধানের ১৪ নম্বর আর্টিকল এ পরিস্কার বলা হচ্ছে, “ THE STATE SHALL NOT DENY TO ANY PERSON EQUALITY BEFORE THE LAW OR THE EQUAL PROTECTION OF THE LAWS WITHIN THE TERITORY OF INDIA.’
মানে খুব পরিস্কার আইনের চোখে সবাই সমান, আইন সব্বাই কে একভাবেই বিচার করবে।
আমাদের সংবিধানে র আর্টিকল ১৫ তে কী বলা আছে একবার দেখে নেওয়া যাক।
THE STATE SHALL NOT DISCRIMINATE AGAINST ANY CITIZEN ON GROUNDS ONLY OF RACE, RELIGION, CAST, SEX AND PLACE OF BIRTH.”
বলা হচ্ছে যে রাষ্ট্র জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ বা জন্মস্থানের ভিত্তিতে কাউকে আলাদা করতে পারবেনা।
অথচ পাশ হয়ে যাওয়া আইন বলছে নির্দিষ্ট কিছু ধর্মের মানুষকে নাগরিকত্ত্ব দেওয়া হবে। তাতেও অনেক ঘাপলা আছে তা নিয়ে আলোচনা পরে করছি।
এর মানে দাঁড়াল কেবল মাত্র ধর্মের ভিত্তিতে আমাদের দেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। যা সংবিধান বিরোধী। এটা কি উনি জানেন না? প্রধানমন্ত্রী জানেন না? বিজেপির দিগগজ নেতারা জানেন না? সব্বাই সব জানেন। কিন্তু এই আইন পাশ করিয়ে দেশের হিন্দু নাগরিকদের কাছে ইঙ্গিত দেওয়া হবে যে এই সরকার হিন্দুদের সরকার। এই রাষ্ট্র কে এক হিন্দু রাষ্ট্র বানানোর আর এস এস এর যে এজেন্ডা, সেটাকেই তুলে ধরে হচ্ছে।
আচ্ছা তাহলে আসামে এন আর সি করার দরকার কী ছিল? ১৯ লক্ষ র মধ্যে ১৪ লক্ষ হিন্দু, এরপর তারা আবেদন করবেন এবং নাগরিকত্ব পাবেন। পড়ে রইল ৫ লক্ষ মুসলমান। তা ৫ লক্ষ মুসলমান খুঁজতে ১৬০০ কোটি টাকা খরচ হল?
CITIZENSHIP AMMENDMENT ACT এই আইনে নাগরিক কে হবেন বিজেপির সেই নিয়ে চিন্তা, মোদী অমিত শাহ র সেই নিয়ে মাথা ব্যাথা। আইন বলছে যাঁরা এই আইনের আওতায় নাগরিকত্ত্বের আবেদন করবেন তাঁদের কে জানাতে হবে কোন ধরণের ধর্মীয় অত্যাচারের সামনে পড়ে তাঁরা এদেশে চলে এসেছিলেন। আচ্ছা আমার বাবা বা মা সেই কবে ৪৭/৪৮/৪৯ বা ৭০/৭১ এ বাংলাদেশ ছেড়ে এদেশে এসেছিলেন, কেন এসেছিলেন, কী ধরণের অত্যাচার হয়েছিল, তার প্রমাণ কিভাবে জোগাড় করা হবে? এবং যতদিন আপনাকে হ্যাঁ ধরেই নিলাম আপনি হিন্দু, শিখ, জৈন বা বৌদ্ধ, মুসলমান নন, আপনি নাগরিকত্ত্বের আবেদন করেছেন, যতদিন না আপনি সেই নাগরিকত্ব ফিরে পাচ্ছেন, ততদিন আপনি কী? বিদেশী? হ্যাঁ ঠিক তাই কারণ আপনি তো ভারতের নাগরিকত্বের আবেদন করেছেন। তাহলে ততদিন আপনার চাকরির কী হবে? আপনার সম্পত্তির কী হবে? আপনার ব্যাঙ্ক আকাউন্টের কী হবে? এসবের জবার আছে? আর বাকিদের? এদিকে সেই নাগরিক কৃষকের কী হবে, যিনি পেঁয়াজের দাম না পেয়ে আত্মহত্যা করেছেন বা করবেন? সেই আদিবাসী নাগরিকের কী হবে, যার জমিন জঙ্গল কেড়ে নেওয়া হয়েছে, যে এখন ভূখা নাংগা? তাদের কী হবে? নয়ডার গাড়িকারখানার শ্রমিকদের কী হবে? যারা হরতাল করছেন? বা রাষ্ট্রায়ত্ব কোম্পানির সেই চাকুরে যার চাকরি চলে গ্যালো? পেটে ভাত নেই, পরনে কাপড় নেই, মাথার ওপর ছাদ নেই সেই লক্ষ লক্ষ নিরন্ন হাঘরে কৃষক শ্রমিক দের কী হবে? এই বিল তাদের পেটে ভাত দেবে, পরনে কাপড়? মাথার ওপরে ছাদ?
সমস্যা পেটের, খাদ্যের, বস্ত্রের, বাসস্থানের আর সেটাকে মোদিজী অমিত শাহ নিয়ে চলে যাচ্ছেন রামমন্দিরে, হিন্দু আর মুসলমানে। ধর্ম কে ধারণ করা এক ব্যক্তিগত ধারণা, তাকে দেশ অর্থনীতি রাজনীতির সঙ্গে জুড়ে যে আগুন জ্বালানোর চেষ্টা হচ্ছে তা ভয়ঙ্কর। অথচ দেখুন ঘন্টা খানেক ধরে নেশন ওয়ান্টস টু নো বলে এই আগুন কেই ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
আসুন আমরা আর একবার সংবিধানের শপথ নিই, গান্ধি, নেতাজি, জহরলাল, ভগৎ সিং, চন্দ্রশেখর, ক্ষুদিরামের নামে শপথ নিই আমাদের সংবিধান কে আমরা অক্ষুন্ন রাখবো। ধর্ম জাত বর্ণ ভাষা বা জন্ম স্থানের ভিত্তিতে মানুষ কে ভাগ করতে দেবনা।
চিৎকার করে আবার বলুন সব্বাই, রাজা তুই উলঙ্গ। এতদিন ধরে যারা দেশে থাকল ঘর বাঁধল বড় হল বেড়ে উঠল এই স্বদেশ থেকে তাদের তাড়িয়ে দিলে রাজার কিছু যাবে আসবে না, কিন্তু আমার আপনার খেলার সাথী, বন্ধু, সহ নাগরিকদের ওপর এই অত্যাচার নামিয়ে আনতে দেওয়া যায় না।