দেশের সামনে সমস্যা কী? মূল্যবৃদ্ধি? ১৫ দিনে ১৩ বার পেট্রল ডিজেলের দাম বাড়ানো? বেকারত্ব? অর্থনীতির বেহাল অবস্থা? শিক্ষা ক্ষেত্রে ক্রমশঃ পিছিয়ে পড়া? ন্যুনতম স্বাস্থ্য ব্যবস্থা না থাকা? পানীয় জলের অভাব? না, এগুলো তো কোনও সমস্যাই নয়, এগুলো তো আগেও ছিল, এখনও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে, আপাতত দেশের সামনে সমস্যা হালাল না ঝটকা?
সমস্যা হল দেশের ৯০% মানুষ হালাল কী, তাও জানেন না, ঝটকাও যে সবাই বোঝে তাও নয়। কিন্তু প্রথমে কর্ণাটক, তারপরে উত্তর প্রদেশ, এখন বিহারেও ছড়াচ্ছে এই বিতর্ক, বজরঙ্গ দল, হিন্দু মহা পঞ্চয়েত এবং বিজেপির বিভিন্ন স্তরের নেতা কর্মীরা বাজারে প্রকাশ্যে নোটিশ দিয়েছেন, ফতোয়া জারি করেছেন, হালাল মাংস হিন্দুরা কিনবে না, বয়কট করো সেই সব দোকান, যেখানে হালাল মিট, হলাল ফুড প্রডাক্ট বিক্রি হয়।
এই হনুমান বাহিনীর বক্তব্য হল, হালাল সার্টিফিকেশন চলবে না, যারা হালাল সার্টিফিকেট দেয়, তার জন্য যে টাকা পায়, তা দিয়ে নাকি ইসলামিক টেররিস্টদের ফান্ডিং চলছে। ফুটপাথ, বাজারে বসে থাকা অসংখ্য মাংস বিক্রেতা, বাপ ঠাকুরদার আমল থেকে যারা মাংস বিক্রি করতো, তাদের মাথায় হাত। তাদের বিক্রি বাটটা যা হল তা তো হল, তার ওপরে ছড়াচ্ছে হিন্দু মুসলমান বিদ্বেষ বিষ, সর্বত্র। এবং এটাই এখন দেশের সমস্যা, অন্তত ঐ হনুমান বাহিনী সেটাই মানুষকে বোঝাতে চাইছে, একশ দুশো তিন শো বছর ধরে, তাঁদের ভাষায় যে অন্যায়, যে অবিচার চলে আসছিল, এবার তার অবসান চাই, কাশ্মীর ফাইলস এর পরে এবার নতুন ছবি তৈরি হল বলে, এ ছবিও দারুণ ব্যবসা করবে, কিভাবে আমাদের জাত মারা হচ্ছিল তার অনুপংখ বিবরণ থাকবে সেই ছবিতে, ছবি দেখে মানুষ কাঁদবেন, ছবির শেষে শ্লোগান তুলবেন, দেশ কে গদ্দারোঁ কো…… ইত্যাদি ইত্যাদি।
চলতে থাকুক এই নৌটঙ্কি, তার আগে আসুন এই হালাল বা ঝটকা বিষয়টাকে একটু বুঝে নেওয়া যাক, আখির হলাল কিস চিড়িয়া কা নাম হ্যায়? সেটাও তো জানা দরকার। ইসলাম ধর্ম আর ইহুদি ধর্মে হালাল বলে শব্দটা আছে, কারণ তাঁদের ধর্মে খাওয়া থেকে উপাসনা, জন্ম থেকে মৃত্যু, প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে কী করিতে হইবে, কী কী করিতে হইবে, তার অনুপংখ বিবরণ আছে।
হালাল খাদ্য, মানে কী? উপযুক্ত খাদ্য। প্রথমেই বাদ দেওয়া হয়েছে পর্ক মিট, তাকে হারাম বলা হয়েছে, খাদ্যের জন্য অনুপযুক্ত। এরপর খাবারের ক্ষেত্রে মৃত বা পিটিয়ে মারা হয়েছে এমন পশুও অনুপযুক্ত বলেই বলা আছে, কেবল খাদ্য নয়, যে কোনও জিনিষ যেখানে পশু মাংস, মেদ, রক্ত, হাড় ব্যবহার করা হয়েছে, সেখানেই এই বিধি নিষেধ আছে, ধরুণ লিপস্টিক, বা ফেস ক্রিম ইত্যাদি যেখানে এরকম ব্যবহার আছে, সেখানেও হালালের প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, তাই ইসলামিক দেশে এই সব ক্ষেত্রেই হালাল পশুই ব্যবহৃত হয়, কেবল খাদ্য নয়।
আরও পড়ুন- চতুর্থ স্তম্ভ : রামদেব বাবা কো গুসসা কিঁউ আতা হ্যায়?
এবার হালাল করার পদ্ধতিটা কী? পশুর গলার সামনের দিকটা কাটা হয় এমনভাবে যাতে তার শিরদাঁড়ায় চোট না লাগে, তার মানে কাটা হয় গলা, শ্বাস নলি, জুগুলার ভেইন, এবং কাটার সময়ে অন্তত বলতে হয়, বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার, আল্লাহুম্মা মিনকা ওয়া লাকা। পশুটি রক্তক্ষরণ হয়ে মারা যায়, তারপর তাকে খাদ্য বা অন্যান্য যে কোনও কাজে ব্যবহার করা হয়, এই পদ্ধতিকেই হলাল বলা হয়।
ছাড় আছে মাছে, কারণ খুব স্বাভাবিক, মাছ জল থেকে তোলার পরে এমনিতেই মরে যায়, তাকে হালাল করা সম্ভব নয়। তবে অত্যন্ত ধর্মবিশ্বাসী মানুষজন সেটাও চেষ্টা করেন, এবং তাঁরা অন্যান্য সামুদ্রিক জীব জন্তু খান না, সেটাকে হালাল বলেই মনে করেন। হালাল কিন্তু কেবল মাংস নয়, কথাটা এমনকি বিভিন্ন শাকসব্জির ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা হয়, সেক্ষেত্রে হলাল কথাটার মানে উপযুক্ত, ব্যস।
ইসলামিক দেশগুলোতে হলাল মানুষজন মানেন, ধর্মের অনুষঙ্গ হিসেবেই মানেন, কিন্তু অন্যদেশ থেকে খাবার এলে? আমদানি করা মাংস? মাংসের বিভিন্ন খাবার, ফেস ক্রিম থেকে লিপস্টিক, সবকিছুতেই হালাল সার্টিফিকেট দেখেই কেনেন, দুনিয়ার অন্তত ২৪% মানুষের এই বাজার তো উপেক্ষা করা যায় না, তাই বিভিন্ন দেশে, ভারতবর্ষেও হালাল সার্টিফিকেট দেবার কিছু সংস্থা আছে, তারা সেই সার্টিফিকেট দেয়, তবেই তা রপ্তানি করা যায়।
এবার একটু ঝটকা কথাটা বুঝে নেওয়া যাক, এক কোপে কাটাকে ঝটকা বলা হয়, হিন্দু ধর্মে ঝটকা বা বলি দেওয়া মাংস খাবার নির্দেশ আছে? না নেই। এমন কি খাদ্য নিয়ে তেমন কোনও নির্দেশই নেই, বলা আছে খাদ্য খাবার আগে তা ব্রহ্মাকে নিবেদন করে খান, কতজন করেন? মন্ত্র হল, ব্রহ্মার্পনং ব্রহ্ম হবির্ব্রহ্মাগ্নৌ ব্রহ্মণা হুতম, ব্রহ্মৈব তেন গন্তব্যং ব্রহ্মকর্মসমাধিনা॥ কতজন জানেন?
দক্ষিণে ব্রাহ্মণরা অনায়াসে গোমাংস খান, ভারত জুড়ে বহু ব্রাহ্মণ মাছ মাংস খান, উত্তর ভারতের ব্রাহ্মণরা শাকাহারী, কেউ কেউ পেঁয়াজ রসুন খান, কেউ কেউ তাও খান না, কেউ খাসি খান, কেউ মুরগি খান না, মানে সোজা, হিন্দু ধর্মে মোষ বলিও আছে, ছাগ বলিও আছে, আবার চাল কুমড়ো বলিও আছে, আবার বলি দেওয়াই খেতে হবে এমন কোনও নিয়ম কোথাও নেই, তাহলে এই ঝটকার নিয়ম আছে কোথায়? শিখ ধর্মে আছে, তাদের ধর্মে বলা আছে এই ঝটকার পদ্ধতি, তাঁরা তা মেনে চলেন।
আজ এতদিন পরে সেই হালাল আর ঝটকা নিয়ে যে বিতর্ক, তা কেবল, কেবল মাত্র হিন্দু মুসলমান বিদ্বেষ বিষ চড়ানোর জন্যই, আর কোনও কারণ নেই। কিন্তু কহানী মে টুইস্ট হ্যায়, বাজারের কাছে সব্বাই নতজানু হয়, সেখানে ধর্ম, ধর্মের অছিলা কাজ করে না, আসুন তার কিছু প্রমাণও দেওয়া যাক।
আগেই বলেছি, ইসলামিক দেশের জনসংখ্যা ২৪% এর কিছু বেশি, এবং সেখানে মাংস বা মাংসজাত দ্রব্য বিক্রি করতে গেলে হালাল সার্টিফিকেট লাগে, নাহলে রপ্তানি করা যাবে না, ভারতবর্ষ আপাতত বিশ্বের দ্বিতীয় মাংস রপ্তানিকারক দেশ, ২০১৯ এর হিসেব, আমাদের দেশ কেবল মাংস বিক্রি করে পেয়েছে ১৪.৪ বিলিয়ন ইউ এস ডলার, প্রায় ১৫০০ কোটি টাকা, এটা কেবল মাংসের হিসেব, এবং এই মাংস হালাল সার্টিফায়েড। তাহলে?
আরও পড়ুন- চতুর্থ স্তম্ভ: এ বাংলার বাম – বিজেপি
ভারতবর্ষ আপাতত বিশ্বের দ্বিতীয় মাংস রপ্তানিকারক দেশ, ২০১৯ এর হিসেব, আমাদের দেশ কেবল মাংস বিক্রি করে পেয়েছে ১৪.৪ বিলিয়ন ইউ এস ডলার, প্রায় ১৫০০ কোটি টাকা, এটা কেবল মাংসের হিসেব, এবং এই মাংস হালাল সার্টিফায়েড। সরকারের কথা বাদ দিন, আসুন বাবা রামদেবের কথা বলা যাক, তিনিও হালাল সার্টিফিকেট নিয়েছেন, কেন? কারণ ঐ ২৪% মানুষের বাজার যেখানে ওনার ক্রিম থেকে ফেস ওয়াস, লিপস্টিক বিক্রি হয়, কেবল রামদেব নাকি? আদানি আছে, টাটা আছে, মাদার ডেয়ারি আছে, কৃষ্ণা ইন্ডাস্ট্রিজ আছে, আই টি সি আছে, লিসিয়াস আছে, এরা কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করেন, এঁরাও যথারীতি হালাল সার্টিফিকেশন সংস্থার থকেই সার্টিফিকেট নিয়েছেন, তার জন্য টাকাও দিয়েছেন।
তার মানে কি এঁদের টাকাও, রামদেব, আদানি, টাটা, লিসিয়াসের টাকা ইসলামিক উগ্রপন্থীরা পাচ্ছে? আর এস এস – বিজেপি, হিন্দু জাগরণ, বজরঙ্গ দল, হনুমান বাহিনীর সাহস আছে, এদের বিরুদ্ধে ফতোয়া দেবার? দেবে তারা? দেবে না,
এই মাংস রপ্তানি, কারা করেন? সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিক মুসলমান নয়, হিন্দু ব্যবসায়ীরা, দেশের বড় বড় চিকেন ফুড প্রডাক্টসের মালিক কারা? প্রত্যেকটি হিন্দু মালিকানায়, প্রত্যেকটির হালাল সার্টিফিকেশন আছে, সেসব বন্ধ হলে লক্ষ লক্ষ মানুষের চাকরি যাবে, কোটি কোটি টাকার রপ্তানি বন্ধ হবে, এসব হনুমান বাহিনীর লোকজন খবর রাখেন?
বিলক্ষণ রাখেন, রাখেন বলেই এদের দিকে আঙুল না তুলে, ফতোয়া জারি করছেন, রাস্তার মোড়ের মুসলিম দোকানদারদের ব্যবসা বন্ধ করে, ধর্মীয় উত্তেজনা ছড়ানোর চেষ্টা চলছে, এবং যথারীতি আমাদের প্রধান সেবক চুপ করে বসে আছেন, তিনি জানেন এসব চলতে থাকলে তেনার সুবিধে, ধর্মীয় মেরুকরণ হবে, তিনি আবার জিতবেন, আদানি, রামদেব বাবা, আম্বানি কর্পোরেটদের ঢালাও লুটপাট চলতে থাকবে, গরীব আরও গরীব হবে, তাদেরকে ৫ কিলো চাল গম দিলেই ভোট, আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে।
অন্যদিকে এই হিন্দু জাগরণ সমিতি, এই বজরঙ্গ দল চোখের সামনে খোদ রাজধানীতে, হিন্দু মহাপঞ্চায়েতের ডাক দিল, সেখানে ৩ এপ্রিল, দিল্লির বুরাড়ি মাঠে সবার সামনে য়তি নরসিংহানন্দ হিন্দুদের হাতিয়ার ধরার কথা বললো, বলল আর একজন মুসলিম প্রধানমন্ত্রী হলে, দেশের অর্ধেক হিন্দু মানুষদের কাটা হবে, বাকিদের বিদেশে পালিয়ে যেতে হবে, কাজেই হিন্দু মর্দরা হাতিয়ার ধরো,
গতবছর এরকম এক ধর্ম সভায় এই কথা বলার জন্য তাদেরকে ধরা হয়েছিল, জামিনে বেরিয়ে এসে সেই একই কথা তারা আবার বলল, সংবিধান বিরোধী কথা, বেআইনী কথা, কিন্তু শুনবে কে? কোথায় পুলিস? কোথায় বিচার? ঘরে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো পাওয়া গিয়েছে, দাস ক্যাপিটাল আছে বলে জেলে ঢোকানো হচ্ছে, আর যে হনুমানের দল ল্যাজে আগুন লাগিয়ে দেশ জ্বালাতে চাইছে, তারা লাগামছাড়া, অবিরাম বিষ ছড়াচ্ছে।