ছেলের রেজাল্ট বের হয়েছে, ঘরে ঢুকতেই বাবার হাঁক, কী রে? কেমন হল? ছেলে একগাল হেঁসে বলল, নান্টুর চেয়ে ৮ নম্বর বেশি পেয়েছি। মা এসে ভজার, মানে ছেলের ঘাম মুছিয়ে দিলেন, বাবা গেলেন খাসির মাংস আনতে। রাস্তায় দেখেন, নান্টুর বাবা বেদম ঠ্যাঙাচ্ছে তাঁর ছেলেকে, এবারেও ফেল? ১০০ তে ১৮? এটা একটা নম্বর? টেনেটুনে ৩০ ও পেলি না। ভজার বাপ হিসেব করে দেখল, এই হিসেব মত ভজা পেয়েছে ২৬, মানে এবারেও ফেল, একটা কঞ্চি কিনে বাড়ির দিকে রওনা দিল।
আমাদের দেশের জিডিপির হিসেব বের হল, গতবারে ছিল মাইনাস ২৪%, এবারে প্লাস ২০%। অত হিসেবের মধ্যে না গিয়েও বলা যায়, আমাদের জিডিপি এবারেও তার আগের তুলনায় মাইনাস ৪% এই আছে। ওদিকে ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই কাড়া নাকাড়া বেজে উঠেছে, পুষ্পবৃষ্টি হচ্ছে, ওয়াহ, ওয়াহ টুইট হচ্ছে, মোদিজীর নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে চলেছে বলা হচ্ছে, উৎসব শুরু হল বলে। এই ফাঁকে ভজার বাপেরা, মানে আম জনতার জন্য হিসেবটা একটু সহজ করে বুঝিয়ে বলার দায় আমার আছে, তাই আসুন, জিডিপির যে ফিরিস্তি দেওয়া হল, তা থেকে আমাদের অর্থনীতির ছবিটা নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। জিডিপি কী? খায় না মাথায় দেয়? আসুন সেটা জেনে নেওয়া যাক। দেশের মোট সম্পদ, মানে ধরুন শিল্প উৎপাদন, বা সার্ভিস সেক্টরে যে আয় হল, আমদানি রফতানি থেকে যে আয় হল, শিল্পের আয়, কৃষিক্ষেত্র থেকে আয়, এই সব মিলিয়ে যে হিসেবটা দাঁড়ায়, তাকে গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট বলা হয়। এই মোট আয় বলে দেয় দেশের সমৃদ্ধির কথা। এটা ঠিক যে, প্যান্ডেমিকের সময়ে কেবল আমাদের নয়, সারা পৃথিবীর জিডিপি কমেছে, কারোর কম কারোর বেশী, কিন্তু আমাদের দেশের জিডিপি তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে, কত তলানিতে? যে তলানির থেকে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপালও ওপরে ছিল। কেন এমন হল? অনেক সময়েই আমাদের কিছু অসুখ হয়, যা প্রাণঘাতী নয়, মানে সেই অসুখ হলেই মরে যাব না, কিন্তু সেই অসুখের ফলে আমাদের ইমিউনিটি পাওয়ার এতটাই খারাপ হয়ে যায় যে, অন্য সামান্য ইনফেকশনের ফলে মৃত্যু অনিবার্য হয়ে যায়। দেশের অর্থনীতিও আমাদের শরীরের মতন, দারুণ চেহারা, দারুণ ইমিউনিটি, ইনফেকশন হল, শরীর খারাপ হল, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সামলে নিল। ঠিক তেমনই দারুণ অর্থনীতি, জিডিপি ক্রমাগত বাড়ছে, আমদানির চেয়ে রফতানি বেশি, শিল্পে আয় বাড়ছে, রোজগার বাড়ছে, কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়ছে। এরকম অবস্থায় প্যান্ডেমিকের ফলে তারা কিছুটা পিছোলেও, কিছুদিনের মধ্যেই সামলে নিয়েছে। যেমন চীন, প্যান্ডেমিকের ধাক্কা সামলিয়ে আবার তাদের অর্থনীতি নিয়ে তরতর করে এগিয়ে চলেছে। চীনের কথা বাদ দিন, ইউরোপীয় দেশের কথাই দেখুন, ফ্রান্স, জার্মানি এমন কি ইটালি, ইউকেও তাদের অর্থনীতি সামলে নিয়েছে। তাহলে আমাদের এরকম অবস্থা কেন? আসলে আমাদের অর্থনীতি, প্যান্ডেমিকের বহু আগে থেকেই নীচে নামতে শুরু করেছিল। অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়েছে, এমন এক সময় প্যান্ডেমিক এসে তাকে তলানিতে নিয়ে চলে গেছে।
আসুন সেই হিসেবটা আরও একবার দেখে নেওয়া যাক। মোদিজি ক্ষমতায় এলেন ২০১৪ সালের মে মাসে, কোয়ার্টার টু, মানে এপ্রিল মে জুন, গ্রোথ দারুণ। অর্থনীতি বাড়ছে, তার মানে তিনি যখন এলেন, তখন অর্থনীতি বাড়ছে, কত? ৮.৭%। দারুণ। কোয়ার্টার থ্রি গ্রোথ কমল, ৫.৯%। কোয়ার্টার ফোর আবার বৃদ্ধি, ৭.১%। এরপর ১৫-১৬, কোয়ার্টার ওয়ান ৭.৬%, ফোর্থ কোয়ার্টারে ৯.১%। দারুণ বৃদ্ধি, এই সময় থেকে বলা শুরু হল, ভারত বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত অর্থনৈতিক বৃদ্ধি হচ্ছে এমন দেশের মধ্যে অন্যতম। দেশ আর কিছুদিনের মধ্যে ফাইভ ট্রিলিয়ন ইকোনমিতে পৌঁছবে, ভারত চীনকে ছাপিয়ে যাবে, বিকাশ চতুর্দিকে। হতে পারত, মানে ওই হারে বৃদ্ধি হলে দেশ ২০২৫ এ ফাইভ ট্রিলিয়ন ইকোনমি না হলেও তার কাছাকাছি তো যেতেই পারতো। কিন্তু দেশে কালিদাস আছে, যে ডালে বসেন, সেই ডালই কাটেন। মোদিজির মনে হল, এই সুবর্ণ সুযোগে দেশের কালো টাকার সমান্তরাল অর্থনীতিকে শেষ করে দেওয়া যাক, তারজন্য কী করতে হবে? তিনি ডিমনিটাইজেশন আনলেন। পরের ছবি কী? ১৬-১৭ ফার্স্ট কোয়ার্টার ৮.৭%, কিছুটা নামল। সেকেন্ড কোয়ার্টার ৯.৭% বার শিখরে, এল ডিমনিটাইজেশন, পরের কোয়ার্টারে ৮.৬%, থার্ড কোয়ার্টারেও ৮.৬%, এরপর ৬.৩%, ডিমনিটাইজেশন এফেক্ট, ১৭-১৮ অর্থনৈতিক বছর কোয়ার্টার ওয়ান ৬.১%, কোয়ার্টার টু ৫.৩%, কোয়ার্টার থ্রি ৬.৭%, কোয়ার্টার ফোর ৮.৯%, আবার কিছুটা বৃদ্ধি, এবার আবার কালিদাসের খেলা, এবার জিএসটি এফেক্ট, ১৮-১৯ ফার্স্ট কোয়ার্টার ৭.৬%, সেকেন্ড কোয়ার্টার ৬.৫%, থার্ড কোয়ার্টার ৬.৩%, আর ফোর্থ কোয়ার্টারে ৫.৮% এ এসে দাঁড়ালো। এবারে ১৯-২০ অর্থনৈতিক বছর, তখনও প্যান্ডেমিক আসেনি, ফার্স্ট কোয়ার্টার ৫.৪%, সেকেন্ড কোয়ার্টার ৪.৬%, থার্ড কোয়ার্টার ৩.৩ আর ফোর্থ কোয়ার্টার এ ৩% এ এসে দাঁড়াল। ২০০৮ এ বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার সময়েও এই তলানিতে নামেনি আমাদের দেশের অর্থনীতি।
0এরপর ২০-২১, প্যান্ডেমিক এল, অর্থনীতির অবস্থা খারাপ ছিল, এবার গোদের ওপর বিষফোঁড়া, প্রথম কোয়ার্টারেই মাইনাস ২৪.৪%, সেকেন্ড কোয়ার্টার মাইনাস ৭.৪%, থার্ড কোয়ার্টার ০.১%, তারপর ১.৪% এবং অবশেষে এবার ২০.১% গ্রোথ। কিন্তু আগের অবস্থাতেও ফিরে যাওয়া যায়নি, কেন? যা হয়েছে, তা তো পরিস্কার, অর্থনীতি ধুঁকছিল, অতিমারী এসে তাকে তলানিতে নিয়ে গেলো। কিন্তু তারপরেও তাকে সামলানো যাচ্ছে না কেন? একমাত্র কৃষিক্ষেত্রে পজিটিভ গ্রোথ, মাথায় রাখুন কৃষি আইন পাস হয়েছে বটে, কিন্তু সারা দেশজুড়ে কৃষকদের আন্দোলনের চাপে তাকে লাগু করা যায়নি, লাগু হয়ে গেলে যে আবার কালিদাসের খেলা শুরু হয়ে যাবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মোদি জমানার সবথেকে উপেক্ষিত সেক্টর এই কৃষি, সেই কৃষিক্ষত্রেই উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি হয়েছে। এছাড়া কিছুটা বৃদ্ধি বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে হয়েছে, এবং এই দুটো সেক্টর বাদ দিলে প্রত্যেকটা সেক্টর, ট্যুরিজম, ট্রান্সপোর্ট, রিয়েল এস্টেট, হসপিটালিটি ইন্ডাস্ট্রি সব সেক্টরে মাইনাস গ্রোথ। আর খরচ, যা বাড়লে অর্থনীতিতে জোয়ার আসে, সে ব্যক্তিগত খরচ, প্রাইভেট সেক্টরের খরচ বা সরকারি খরচ, যাই হোক না কেন, অর্থনীতিতে তার প্রভাব পড়ে, বৃদ্ধি হয়। সেখানে ব্যক্তিগত, মানে কনজিউমার কনজামশন কমেছে, মানে মানুষজন খরচ করছে না, করলেও বুঝেশুনে করছে, কেন? কারণ সোজা, তাঁরা হাতে পয়সা রাখতে চাইছে, মধ্যবিত্ত মানুষ পয়সা খরচ করছে না, মাসে চারবার রেস্তোরাঁয় খাবার বদলে একদিন খাচ্ছে। জামা ৩ টের বদলে একটা কিনছে। কারণ মাথায় আছে চাকরি চলে যাবার ভয়, মাইনে কমে যাবার ভয়। আর যে নিম্নবিত্ত গরীব মানুষ, পয়সা পেলেই তা খরচ করেন, কারণ তাঁদের জমানোর মত পয়সা থাকে না, তাঁদের কাছে পয়সা নেই। অমর্ত্য সেন থেকে রঘুরাম রাজন, প্রত্যেক অর্থনীতিবিদ বলছেন, গরীব মানুষদের হাতে পয়সা দিতে হবে, মোদিজি সেকথা কানে তুলছেন না।
এ তো গেল ব্যক্তিগত খরচের কথা, বাজারে চাহিদা তৈরি হচ্ছে না বলে প্রাইভেট সেক্টরে ইনভেস্টমেন্ট নেই, এমন কি সরকারি প্রকল্পেও খরচ কমেছে, ফলে চাকরি কমেছে। ওদিকে খাদ্য শস্য থেকে ভোজ্য তেল গুদামে জমা হচ্ছে, দাম বাড়ছে, এদিকে মোদিজি ডিজেল, পেট্রোল গ্যাসের দাম বাড়িয়েই চলেছেন, সব মিলিয়ে অর্থনীতি এক ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে। আরও বিপর্যয় অনিবার্য, যদি কালিদাসের খেলা চলতেই থাকে। ১৪৬ কোটি মানুষের মধ্যে ১৪ কোটি মানুষ দুটো ভ্যাক্সিন পেয়েছেন, তারমধ্যেও সেই অংশের সংখ্যা বেশী, যারা নিজের গ্যাঁটের টাকা খরচ করে ভ্যাক্সিন নিয়েছেন। কাজেই সংক্রমণের ভয় যাচ্ছে না। তারমধ্যে ডেল্টা সংক্রমণের খবর আসছে, তৃতীয় ওয়েভের খবর আসছে, সেই ভয়ে অর্থনীতি আরও সঙ্কোচনের মুখে, সেই সময়ে হেডলাইন কী? না দেশের জিডিপি ২০% বৃদ্ধি হয়েছে, ভজার অঙ্কে মজেছে ভক্তের দল, দিল্লিতে উৎসব শুরু হয়েছে, আবার সেই ফাইভ ট্রিলিয়ন ইকনমির কথা, আসল সত্যকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা, উটপাখির মত বালুর ঝড়ের সময় মাথাটা বালুতে গুঁজে ঝড় না দেখার চেষ্টা, আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে কে জানে! তবে একটা কথা তো পরিস্কার এই দেশ বেচনেবালারা যতদিন ক্ষমতায় আছে, ততদিন দেশের লোকের সুদিন ফিরবে না, দেশকে উচ্ছন্নে নিয়ে যাবার জন্য এক মোদি-শাহই যথেষ্ট। ঠিক যেখান থেকে মোদিজি দেশের হাল ধরেছিলেন, সেই ২০১৪-১৫ অর্থনৈতিক বছরের দ্বিতীয় কোয়ার্টারে জিডিপি গ্রোথ ছিল ৮.৭%, অচ্ছে দিন আনার ফলে আজ সেটা সত্যি করে ৩% এও দাঁড়িয়ে নেই, এই সহজ সত্যটা আমাদের মানুষের কাছে নিয়ে যেতেই হবে, অচ্ছে দিন যে একটা নিটোল ধোঁকা, সেটা বলতে হবে প্রতিটা মানুষকে, আমরা বলছি, আপনারাও বলুন।