সে অভিনেতা মারা গেছেন, তাই নাম বলব না। তিনি বিভিন্ন ছবিতে ছোট ছোট চরিত্রের জন্য হত্যে দিয়ে পড়ে থাকতেন এবং তার মধ্যে কিছু পেয়েও যেতেন। বাড়ির বাইরে লেখা থাকত চলচ্চিত্র ও মঞ্চের অভিনেতা শ্রী অমুকচন্দ্র তমুক। সাতসকালে বারান্দায় বসে নানান অঙ্গভঙ্গি করতেন, ওটা ছিল তাঁর অভিনয় প্র্যাকটিস। কেউ দেখে দাঁড়িয়ে গেলেই বলতেন সাধনার সময় ডিস্টার্ব করবেন না। তো সেই তিনি একদিন মিনিবাসে, আমার সঙ্গে পরিচয় ছিল, আমাকে ইশারায় কাছে ডাকলেন। আমি ভিড় ঠেলে কাছে যেতে বললেন, আমাকে একটু আড়াল করে দাঁড়া তো, লোকজন বড্ড ডিস্টার্ব করছে। এরকম হয়। এক ধরনের গভীর ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স থেকে এক ধরনের ইনসিকিওরিটি জন্ম নেয়। মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেন, নিজের মনের মধ্যেই নিজেকে উত্তমকুমারের জায়গায় বসাতে শুরু করেন। আমাদের রাজ্যের নয়া রাজ্যপাল সম্ভবত সেরকম এক অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। প্রথমত এই কঠিন গরমে গলাবন্ধ কোট আর চোখে কালো চশমা দেখেই সামনের মানুষজনের মনে এই প্রশ্নের উদয় হওয়াটা স্বাভাবিক। তারপরে তাঁর ধারাবাহিক কার্যকলাপ সেই বিশ্বাসকে আরও শক্তপোক্ত করে তুলছে। মুড সুইং? তাও হতেই পারে। তিনি নতুন নির্বাচিত বিধায়কের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান রাজ্যের পরিষদীয় মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে ঠিক করবেন না, ধূপগুড়ির নব নির্বাচিত বিধায়ককেই ফোন করে বলছেন, চলে আসুন শপথ গ্রহণ করাব। এ কি মামদোবাজি? হয় নাকি এরকম? রাজ্যে নির্বাচিত সরকার আছে, সেই সরকারের পরিষদীয় মন্ত্রী আছেন, যিনি এই শপথগ্রহণ ইত্যাদির ব্যবস্থা করেন। তাঁকে বাইপাস করে বিধায়ককে সরাসরি ফোন করে শপথ নিতে ডাকছেন? নিত্যনতুন তাঁর নৌটঙ্কি আমরা দেখেই চলেছি। বিষয় আজকে সেটাই, রাজ্যপাল উত্তমকুমার হতে চাইছেন।
প্রথমে এসেই বললেন, বাংলা শিখব। তো আলালের ঘরের দুলালদের কতকিছুই তো ইচ্ছে হয়, আমরা ভেবেছিলাম সেইরকমই কিছু একটা হবে। গোপালকৃষ্ণ গান্ধী বলেননি, কিন্তু বাংলা শিখেছিলেন। তারও আগে গান্ধীজি তাঁর শেষ দিনগুলোতে নিয়মিত শিক্ষকের কাছেই বাংলা শিখতেন। যেদিন মারা যান সেদিনও তিনি বাংলা শিক্ষার পাঠ নিয়েছিলেন। জানিয়েছিলেন, রবি ঠাকুরের অনুবাদ পড়েছেন, এবার বাংলায় পড়তে চান। আমরা এই রাজ্যপাল বোসের কথা তত সিরিয়াসলি নিইনি, কিন্তু শিখলে ক্ষতি কী, শিখুন, অত বড় রাজপ্রাসাদে বসে কিছু একটা করুন। কিছুদিন আগেই আম্মি এইর শেইষ দেকে চাড়বো, শুনেই বুঝেছি বাংলা শেখা ওঁর হয়নি, হবেও না। কিন্তু ততদিনে উনি বাংলার বিদ্যাসাগর হওয়ার চার্জ নিয়েই নিয়েছেন, শিক্ষা ব্যবস্থা টা উনিই দেখবেন।
আরও পড়ুন: Aajke | বাংলাকে ভাতে মারার চক্রান্ত চালাচ্ছেন মোদিজি
ওরে ভাই এটা একটা রাজ্য, রাজ্যে নির্বাচিত সরকার আছে, সেই সরকারে শিক্ষামন্ত্রীও আছেন। তিনি যে একেবারে অনপড়, তা কেউ বলবে না। কিন্তু না, রাজ্যপাল বোস শিক্ষা ব্যবস্থা চালাবেন, ওঁর ইচ্ছেমতো একে ফেলছেন, তাকে বসাচ্ছেন। নাপিতকে উকিল, উকিলকে ডাক্তার, ডাক্তারকে ছুতোর বানিয়েই চলেছেন। আপাতত সবটাই শুন্ডির পিন্ডি চটকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে আছে। মার খাচ্ছে কে? রাজ্যের উচ্চশিক্ষা। রাজভবন আপাতত বিজেপির এক্সটেন্ডেড সদর দফতর। উনি নিজেও জানেন, ওঁর কোনও ক্ষমতা নেই। উনি চাইলেও দিল্লির মোদি সরকারের অত ভীমরতি হয়নি যে সরকার ফেলে দেবে। উনি জানেন চিমটি কাটা ছাড়া তাঁর কিছুই করার নেই, তাই তিনি মন দিয়ে সেই কাজটাই করে চলেছেন। আজ সাতসকালে খবর, তাঁর ওই রাজভবনে নাকি তিনজন কনস্টেবল তাঁর উপরে নজরদারি চালাচ্ছে। কীভাবে? কনস্টেবলরা রাজ্যপালের অফিসে ঢুকতে পারেন? না। বেডরুম, ডাইনিং রুমে? না। ওঁর সঙ্গে যখন বিরোধী দলনেতা বা বিজেপি নেতাদের বৈঠক হয়, কনস্টেবলরা হাজির থাকতে পারেন? কভি নহি। তাহলে দাঁড়াল কী? ওঁর এই বিশাল রাজভবনে কারা কারা ঢুকছে, কারা বের হচ্ছে, সেদিকে নজর রাখা হচ্ছে? আচ্ছা তার জন্য রাজভবনের ভেতরে থাকতে হবে কেন? রাজভবনের প্রত্যেকটা দরজায় রাজ্যপালের সুরক্ষার জন্য পুলিশ মোতায়েন তো আছেই, এই তথ্যের জোগান তো সেখান থেকেই হতে পারে। এই সহজ সত্য কি আমাদের রাজ্যপাল বোস জানেন না? অবশ্যই জানেন, কিন্তু ওই যে, উত্তমকুমার হওয়ার মনোগত বাসনা, সেই বাসনাজনিত ডিপ্রেশন, আর সেই ডিপ্রেশন থেকেই নিত্যনতুন বায়না। উনি জানিয়েছেন, তিনজন কনস্টেবলকে সরিয়ে নিতে হবে। এরপরে তিনি সম্ভবত তাঁর সুরক্ষার জন্য রাজভবনের দরজার সুরক্ষা কর্মীদেরও সরিয়ে নিতে বলবেন, বলতেই পারেন। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমাদের রাজ্যপাল আনন্দ বোস সাহেব বলেছেন তাঁর উপরে নজরদারি চলছে, একজন সাংবিধানিক পদে থাকা মানুষ রাজ্যের বিরুদ্ধে এইরকম সেনসিটিভ একটা বিষয়ে বিনা প্রমাণে এরকম কথা দুম করে বলে দিতে পারেন?
কোনও নজরদারি ছাড়াই এক অশীতিপর বৃদ্ধ রাজ্যপালের ঘরে যৌনকর্মীদের নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ আর প্রমাণ দুই এসেছিল। মধ্যপ্রদেশের সে ঘটনার পরে আবার আলোড়িত হয়েছিল রাজনৈতিক মহল, মিডিয়া। নতুন করে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছিল যে এই শ্বেতহস্তীসম এক সাংবিধানিক পদের কোনও প্রয়োজন আছে কি না। দেশের প্রতিটা সাংবিধানিক পদে হয় নির্বাচিত মানুষ থাকেন, না হলে নির্দিষ্ট যোগ্যতার একজন বসেন। একমাত্র এই রাজ্যপালের পদের জন্য কোনও যোগ্যতা লাগে না, তিনি অশিক্ষিত হতে পারেন, বদ হতে পারেন, পণ্ডিত হতে পারেন, বিবেচকও হতে পারেন এবং এই একমাত্র পদ যা নির্বাচিতও নয়। এই পদের অবলুপ্তি দরকার, অবিলম্বে সেটাই বলা হোক, সম্মিলিত কণ্ঠে বলা হোক।