বিজেপির একটা ব্যাপার কিন্তু ভারি ভালো লাগে, কোনও রাখঢাক নেই, কোনও লজ্জা শরমের বালাই নেই। যেখানে যেরকম দরকার সেখানে সেরকম দাওয়াই তারা প্রয়োগ করে, মিথ্যে, অনৈতিক, কুরুচিকর, অসাংবিধানিক ইত্যাদি শব্দ নিয়ে তাদের এক পয়সাও যায় আসে না। প্রয়োজনে তারা সব করতে পারে। কর্মিসভায় এসে দলের দু’ নম্বর নেতা অমিত শাহ অনায়াসে বলতেই পারেন, মিথ্যে বলার দরকার হলে বলুন, দ্বিধা করবেন না, অনেক সময় মিথ্যে ভালো কাজ করে। হ্যাঁ, এই কথা স্বয়ং অমিত শাহ বলেছেন। এসব নিয়ে ওনাদের কোনও লুকোছাপা নেই। হয় তুই দল ছেড়ে আমাদের দিকে আয়, না হলে ইডি পাঠিয়ে লাইফ হেল করে দেব। দিচ্ছে। তাকিয়ে দেখুন সারা ভারতবর্ষের দিকে, সমস্ত বিরোধী নেতার নামে রোজ ইডির চিঠি আসছে, সমন আসছে, শো-কজের চিঠি আসছে। দেশে ক্ষমতায় কে? বিজেপি। টেন্ডার পাশ থেকে বাজেট বরাদ্দ কাদের হাতে? বিজেপি। দেশের পুলিশের মাথায় কে? দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, বিজেপি। কিন্তু দুর্নীতি করছে কে? প্রত্যেকে বিরোধী দলের নেতা। মানুষ জানেন না? মানুষ দেখছেন না? দেখছেন, জানেন কিন্তু তাতে বিজেপির কিসসু যায় আসে না, অমিত শাহ কো ঘণ্টা ফরক পড়তা হ্যায়। নির্বাচন আসছে। তাঁরা জানেন দক্ষিণে আগের থেকে খারাপ রেজাল্ট হতে চলেছে, তেলঙ্গানাতে আগের আসন তাঁরা পাবেন না, কর্নাটকেও নয়, তামিলনাড়ুতেও নয়, কেরালাতে পেলে বড়জোর একটা। মানে দক্ষিণে কমবে। গুজরাত, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ডে আর বাড়ানো সম্ভব নয়। উত্তরপ্রদেশে এক আধটা কমতে পারে, বিহারে কমবেই, মহারাষ্ট্র এখনও খুব কনফিডেন্ট নয়। তাহলে? বাংলাতে কী হবে? আগের চেয়ে বাড়বে? কোন কারণে? এই গোটা সময়ের মধ্যে পঞ্চায়েত জেলা পরিষদের ক্ষমতা তৃণমূলের হাতে আছে, বামেরা একটুও বেশি ভোট পেলে তা যাবে বিজেপির কাছ থেকেই, বহু আসনেই তা বিজেপিকে খানিক চিন্তাতে রাখবে। তাহলে উপায়? একটাই উপায় আছে ভাঙো তৃণমূলকে। আর সেটাই বিষয় আজকে, আবার কি এক ভাঙনের মুখে দাঁড়িয়ে আছে তৃণমূল?
বিজেপি দলটার দিকে তাকান, এদের বিরাট সমস্যা হল এদের ইতিহাস। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এদের ভূমিকা ছিল বিশ্বাসঘাতকতার, ইংরেজদের কাছে মুচলেকা দেওয়ার। কাজেই কোনও ইতিহাস নেই। সেই দলের এজেন্ডা হিন্দুত্ব কাজেই কিছুদিন আগে পর্যন্ত কোনও মানুষ এই দল করবেন কেন? তা নিয়ে প্রশ্ন ছিল অনেক। কিন্তু ২০১৪-র পর থেকে সেই ছবিটা বদলে দিয়েছেন মোদি-শাহ। দেশের যত দল আছে, প্রত্যেক দল থেকে ক্ষমতালোভী, উচ্চাকাঙ্ক্ষা আছে এমন নেতাদের নিজেদের দিকে নিয়ে গেছেন।
আরও পড়ুন: Aajke | বিজেপিতে যাবেন বলেই কি এত সব?
পদ্ধতি প্রায় সবক্ষেত্রেই একই, প্রথমে ইডিকে পাঠাও, তারপর সমঝোতা সূত্রটা বুঝিয়ে দাও, তারপর সে হয় জেলে না হয় বিজেপিতে। ৫২ সাল থেকে দেশে ভোট হচ্ছে, হাজার একটা রাজনৈতিক দল আছে, তারা ভোটে লড়েছে, একটা দলও দেখাতে পারবেন যে দলের যোগদান কমিটি আছে? কারা যোগ দেবে? ইউনিভার্সিটির ছাত্র? কারখানার শ্রমিক? গ্রামের কৃষক? না ওই যোগদান কমিটির কাজ হল অন্যদল থেকে নেতা-কর্মীদের বিজেপিতে শামিল করা। ২০২১-এর কথা ভাবুন, হঠাৎ এমনটাও মনে হচ্ছিল যে তৃণমূল দলটা থাকবে তো? এদিকে শুভেন্দু, ওদিকে রাজীব ব্যানার্জি, সেদিকে প্রবীর ঘোষাল, অন্যদিকে রুদ্রনীল ঘোষ সমেত টলিউডের ঝিঙ্কু মামণিরা, পার্নো, অঞ্জনা, কাঞ্চনা, রিমঝিম আরও অনেকে। সব মিলিয়ে যাঁদের দেখা যেত মমতার আশেপাশে, যাঁদের অনেকে মমতাকে মা বলতেন, তাঁরা হঠাৎই মমতার মধ্যে এক ডাইনিকে দেখে ফেললেন এবং চার্টার্ড প্লেনে করে দিল্লি। এক কাগুজে জালি মার্কসিস্ট অভিনেতাকেও দেখেছিলাম সেই সুযোগে ওদিকে ভিড়ে যেতে। তারপর? ওই এক শুভেন্দু ছাড়া কেউ টেকেনি। তাও টিকেছে কারণ নির্বাচনে জিতেছিল, না জিতলে এতদিনে আবার পায়ে ধরে তৃণমূলেই ফিরতেন। এবার আবার সেটাই শুরু হয়েছে। তবে এবারে বিজেপির প্রস্তুতি বোধহয় আগের মতো নেই আর গতবারে তৃণমূল ছেড়ে যাওয়ার ফল হাতেনাতে অনেকেই দেখেছেন, কাজেই আবার হাত ও মুখ পোড়াতে রাজি নন অনেকেই। কিন্তু তবুও অন্তত তিন চারজন অতৃপ্ত আত্মা তো রয়েছে, যাদের এক আধজনের আবার ইডি-সিবিআইয়ের ডাকও পেয়েছেন। কাজেই নির্বাচনের আগে ওই সাকুল্যে তিন চারজনকে ভাঙিয়ে নিয়ে যেতে পারবে বিজেপি। যদিও তাতে খুব বিরাট লাভ হবে না। নির্বাচন এখনও অনেক দূরে, কিন্তু এখন থেকেই আবার সেই হয় তৃণমূল না হয় বিজেপি, এই বাইনারিটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। সেখানে বিজেপি বিরোধী ভোট তৃণমূল পাবে আর তৃণমূল বিরোধী ভোট বিজেপি পাবে, কিন্তু তার ছোট হলেও এক অংশ কংগ্রেস বা বামেদের কাছে যাবে। না, এই নির্বাচনেই দল ভেঙে ছারখার হয়ে যাবে এমনটা হচ্ছে না। আমরা আমাদের দর্শকদের কাছে প্রশ্ন করেছিলাম যে তাপস রায় দল ছাড়লেন, আরও কয়েকজন নেতার মুখে অন্য সুর শোনা যাচ্ছে। নির্বাচনের আগে কি তৃণমূল দলে বড় ভাঙন আসতে চলেছে? শুনুন কী বলেছেন মানুষজন।
না, এখনই তৃণমূল ভেঙে যাওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। কিন্তু এখন নেই বলে কি কখনও নেই? আছে। বিজেপি যদি সারা দেশে আবার এক বিরাট মেজরিটি নিয়ে ক্ষমতায় আসে, তাহলে কোনও বিরোধী দলই সুরক্ষিত নয়, দেশের সব বিরোধী দলকে ভেঙে চুরমার করে দেবে বিজেপি। দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো নিয়েই প্রশ্ন উঠবে। দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। সেই দুর্যোগ কী করে সামলাবে দেশের বিরোধী দলগুলো? তার উপায় আজকেই খুঁজে বার করতে হবে।