Placeholder canvas

Placeholder canvas
Homeচতুর্থ স্তম্ভFourth Pillar: নেতাজি কার? 

Fourth Pillar: নেতাজি কার? 

Follow Us :

পিঠে থাকলে সবার খাওয়ার ইচ্ছে হবে, একলা না পেলে ভাগ চাইবে, না পেলে পিঠেকে পচা পিঠে বলবে, এমনকী বাঁদরও পিঠের ভাগ চায়, আমরা তা জানি। আজকের মোহনবাগান স্বদেশি আন্দোলনের ঐতিহ্য দাবি করে, বেঙ্গল কেমিক্যালও। আমার দাদু বিপ্লবীদের চিঠি পৌঁছে দিতেন, ছাতি ছাপ্পান্ন ইঞ্চি। আমাদের স্কুলে পড়তেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, আমাদের ক্লাবে এসেছিলেন বাঘা যতীন। এসব ওই পিঠে ভাগেরই নিরীহ গল্প। কিন্তু এই ভাগাভাগিতে সবচেয়ে এগিয়ে রাজনৈতিক দল আর নেতারা। ঐতিহ্যকে নিজেদের করে তুলতে পারলে এক্সট্রা মাইলেজ। তুলনায় নতুন জন্ম নেওয়া দলের অসুবিধে নেই, ঝোপ বুঝে কোপ মারলেই হল। পরাও বিরসা মুন্ডার গলায় মালা, নেতাজির জন্মদিনে ছুটি দাও, রবিপক্ষ পালন করো, দার্জিলিংয়ে গেলে ভানুভক্ত। তাঁদের অসুবিধে কোথায়? বাংলার সমস্ত মনীষীদের গলায় মালা পরাতে তৃণমূলের অসুবিধে কোথায়? নেতাজি থেকে বিধান রায়, রবি ঠাকুর থেকে নজরুল হয়ে সুকান্তর গলায় মালা পরিয়ে ছোট্ট ভাষণ দেবেন শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু, সমস্যাটা কোথায়? কংগ্রেসেরও তেমন সমস্যা নেই, স্বাধীনতা তো এসেছে ১৯৪৭-এ, কাজেই কংগ্রেসের যাবতীয় নেতা, যাবতীয় ইতিহাসের উত্তরাধিকার তাদের আছে। সুভাষ বসুর সঙ্গে মতান্তর ইত্যাদির পরেও সুভাষ বসু তো আজীবন কংগ্রেসিই থেকে গেছেন। অহিংস কংগ্রেসের দুই নেতার নামে, গান্ধীজি আর জওহরলালের নামে নিজের সৈন্য ব্রিগেডের নাম রেখেছিলেন, আবার ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি, আইএনএ-র বিচার চলাকালীন শামলা গায়ে নেহেরু এসেছিলেন লালকেল্লায় ডিফেন্স কাউন্সিলর হিসেবে। মাথায় রাখুন তখনও দেশ পরাধীন, নেহেরুর সামনে কোনও ভোটের হিসেব নিকেশ ছিল না। 
কিন্তু সমস্যা তৈরি হল দু’ভাবে। স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্য দুই ধারা নিয়ে, প্রথমটা হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্য নিয়ে আরএসএস, হিন্দু মহাসভা, পরে জনসঙ্ঘ, তারও পরে বিজেপির। অন্যটা হল কমিউনিস্টদের, মূলত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির, যাঁরা সমাজ বিপ্লবের পর শ্রমিকরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য মাঠে নেমেছিলেন। কারণ সোশ্যালিস্ট নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ প্রমুখের মূল অবস্থান কংগ্রেসের পক্ষেই ছিল। এই হিন্দুরাষ্ট্রপন্থীরা হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে এবং বিপ্লববাদী শ্রমিকদের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের লক্ষ্য নিয়ে কমিউনিস্টরা কংগ্রেসের বিরোধিতা করেই রাজনীতি করেছে। দুজনের কাছেই আজাদির কোনও মানেই ছিল না, দুই রাজনৈতিক দর্শন দুই মেরুর হলে হবে কী, দুই পক্ষই গান্ধীজির ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেনি। একই কারণে না কমিউনিস্টরা না হিন্দুরাষ্ট্রবাদীরা, কেউই দেশের ত্রিবর্ণ পতাকা তোলেননি এই সেদিন পর্যন্ত। কমিউনিস্টরা নেতাজিকে কুইসিলিং বলেছেন, বিশ্বাসঘাতক বলেছেন, আর হিন্দুরাষ্ট্রবাদীদের তরফে গডসে তাঁর পত্রিকা অগ্রণীতে রাবণের ১০টা মাথার জায়গায় গান্ধী, সুভাষ, নেহেরু, প্যাটেল সমেত কংগ্রেসিদের মুখ বসিয়ে সাভারকারের হাতে ধনুর্বাণ দিয়েছিলেন, পাশে ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ, সে কার্টুন ছাপা হয়েছিল। আপামর বাঙালির গান্ধী বিদ্বেষের মূল কারণ বাংলায় হিন্দু মহাসভা বা জনসঙ্ঘের প্রচার নয়, বরং কমিউনিস্ট পার্টির প্রচার। ঠেলায় পড়ে আরএসএস দফতরেও ত্রিবর্ণ পতাকা তোলা হয়েছে ক’ বছর আগে, কমিউনিস্টদেরও তাই। এক কেরল ছাড়া সারা দেশে কমিউনিস্ট, বলা ভালো ভোটপন্থী কমিউনিস্টদের কোথাও কোনও স্বার্থের সংঘাত নেই। মুখোমুখি বিরোধিতা নেই বলেই তারা বেশ কিছু ক্ষেত্রে হাত মেলাচ্ছে, কিন্তু সেটা কতটা আদর্শগত, কতটা কৌশল তা নিয়ে ভাবার অবকাশ রয়েছে বই কী। অন্যধারে হিন্দুরাষ্ট্রপন্থীরা তাদের লক্ষ্য থেকে একদিনের জন্যও বিচ্যুত হয়নি, গান্ধীহত্যা করেছে, দেশকে কংগ্রেসমুক্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা আজও চালিয়ে যাচ্ছে। 

আরও পড়ুন: Fourth Pillar: সারভাইভাল অফ দ্য রিচেস্ট 

ঠিক সেই অবস্থায় নেতাজি আজ সেই পুলির পিঠে যার ভাগ চায় দুই দল। ফরোয়ার্ড ব্লককে বামফ্রন্টে রেখে কমিউনিস্টরা একটু এগিয়ে, কারণ সত্যি তো নেতাজি বামপন্থী দর্শনের কথা বলেছেন। ওদিকে এমনকী হিন্দুরাষ্ট্রবাদী আরএসএস-বিজেপিও নেতাজিকে তাদের বলেই দাবি জানাতে দ্বিধা বোধ করছে না। এখন কমিউনিস্টরা বামপন্থী তো বটেই, কিন্তু সব বামপন্থীরা তো কমিউনিস্ট নয়, সেখানেই গোলযোগ আর সুভাষচন্দ্র বসু তো বামপন্থী পরে হননি। কাজেই ১৯৩৯-এ যিনি কুইসিলিং তিনি এখন বামপন্থী কীভাবে হয়ে উঠলেন? তবে হ্যাঁ, কমিউনিস্ট পার্টি, সিপিএম, সিপিআই বলতেই পারে যে তারা স্বীকার করেছে, সেদিন তাদের মূল্যায়ন ভুল ছিল। কিন্তু নতুন মূল্যায়নটা কী? সেটাই বা কোথায়? জ্যোতি বসু এই আত্মসমালোচনা করতে গিয়ে বলেছিলেন, নেতাজি সম্পর্কে আমাদের মূল্যায়ন ভূল ছিল, তিনি একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক ছিলেন। হ্যাঁ এটাই মূল্যায়ন, তিনি দেশপ্রেমিক ছিলেন, কিন্তু তিনি বামপন্থী ছিলেন, তা নিয়ে মূল্যায়ন কোথায়? কোন দলিলে? কোন কংগ্রেসে? তবু মন্দের ভালো যে নেতাজির এই বামপন্থার কথা উঠে এসেছে, তাঁর অসাম্প্রদায়িক সেকুলার রাজনীতির কথা উঠে এসেছে, তাঁর দেশপ্রেমের কথা উঠে এসেছে। এমনকী গান্ধী সম্পর্কেও আজকের কমিউনিস্টদের মতামত অনেক আলাদা, অনেক বদলেছে। গান্ধী জনবিচ্ছিন্ন, তাই পার্টি লাইন মেনেই সুকান্ত বলছেন মানুষের হাত ধরো গান্ধীজি, আজকের কমিউনিস্টরা গান্ধীর হাত ধরছেন, কারণ সামনে আরও বড় বিপদ আরএসএস–বিজেপি। তাঁদের এই মত পরিবর্তন কতটা আদর্শের রদবদল, কতটা কৌশল তা আগামী দিনে বোঝা যাবে। কিন্তু আরএসএস-বিজেপি? আরএসএস সরসঙ্ঘচালক কলকাতায় শহিদ মিনারে ২৩ জানুয়ারি ভাষণ দিচ্ছেন, নেতাজি সুভাষের জন্মদিন। যে আরএসএস বাংলার শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে তাদের আদর্শের পীঠপুরুষ হিসেবেই দেখে, সেই শ্যামাপ্রসাদের মুখের ওপর নেতাজি বলেছিলেন, প্রয়োজনে গায়ের জোরে হলেও আপনাদের রুখব। তারপরেই হিন্দু মহাসভার মিটিংয়ে ইট পড়েছিল, শ্যামাপ্রসাদ আহত হয়েছিলেন। কলকাতা মিউনিসিপাল কর্পোরেশনের নির্বাচনী সভায় নেতাজি ঘনিষ্ঠ মহিলা নেত্রীরা গিয়ে সভা বানচাল করে দিয়েছিলেন। সেই নেতাজি এখন দুধপুলি, বাঁদরের দল সেই পিঠের ভাগ চাইছে। এই যে ভাগ নেওয়ার চেষ্টা তার মূল কারণই হল ক্যারিশ্ম্যাটিক নেতার অভাব। এমন একজন কারও ছবি চাই যা টাঙালেই বুকের রক্ত ছলাৎ করে ওঠে। সিপিআইএম এখন চে গ্যেভারাকে আত্মস্থ করার চেষ্টা করছে, যে চে গ্যেভারার মতাদর্শ, তাঁর বিপ্লব সম্পর্কিত ধারণা সিপিএম-এর চিন্তাভাবনার বিপরীত বললেও কম বলা হবে। সেই কারণেই ১৯৫৯-এর ১ জানুয়ারি কিউবা দখল করা গেরিলাদের নেতা কলকাতায় এসেছিলেন তা জানতেও পারেনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা বা জানতে পারলে এক বন্দুকবাজ গেরিলার সঙ্গে নিজেদেরকে মানিয়ে নিতে পারেনি। ঠিক সেই রকম আজ নেতাজিকে আত্মস্থ করতে চায় বিজেপি, তাদের নেতা কই? শ্যামাপ্রসাদ? বাংলার মানুষ তার চেয়ে ঢের বেশি রামপ্রসাদকে চেনে, ভারতের মানুষের কথা ছেড়েই দিন। আর ভারতের দক্ষিণে? কেউ নামও শোনেনি। তাহলে? 
মোক্ষম টার্গেট নেতাজি। কারণ নেতাজি–কংগ্রেস বিবাদ, এবার তার ওপর ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যে ঢেলে নেহেরু গান্ধীকে ভিলেন বানাও। ইতিহাসের ছেঁড়া পাতার সঙ্গে মিথ্যে মিশিয়ে ধাঁধা তৈরি করো, নাম দাও কনোনড্রাম, তাতে নতুন নতুন ছায়া মানুষের আবির্ভাব হোক। নেতাজিকে দেশে ফিরতে দেননি নেহেরু, নেতাজি ছিলেন শৈলমারীর সাধু, নেতাজি ছিলেন গুমনামি বাবা, নেতাজি ছিলেন মহাকাল আজও বেঁচে আছেন, যখন দরকার হবে তখন নেমে আসবেন। এবং এসব গালগল্প লোকেও খায়, সত্যি ঘটনার নামে এইসব মনোহর কহানিয়া দিয়েও সিনেমাও হল, বই ছাপা হল। টিভিতে আলোচনা, বটম লাইন নেহেরু গান্ধীর জন্যই নেতাজি দেশে ফিরতে পারেননি, বা ফিরলেও মানুষের সামনে আসতে পারেনি। এক অদম্য সাহসী, শক্ত মেরুদণ্ডের মানুষকে ন্যালাখ্যাপা বানিয়ে মানুষের সামনে রাখা হল। আগে গান্ধী নেহেরুকে শেষ করো, তাহলেই তো নেতাজি আমাদের, সরসঙ্ঘ চালক সেই খেলাই খেলছেন, বাঁদরেরা পুলিপিঠের ভাগ চাইছে। নেতাজি কন্যা অনিতা পাফ জানিয়েছেন, নেতাজি বামপন্থী ছিলেন, তাঁর আদর্শের অনেক কিছু কংগ্রেসের সঙ্গে মেলে, কিন্তু আরএসএস–বিজেপির মতো সাম্প্রদায়িক দলের সঙ্গে নেতাজির দৃষ্টিভঙ্গি, তাঁর মতামতের কোনও মিল তো নেই, বরং তা একে অন্যের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে। মজা হল এই কুৎসা রটনাকারীরা প্রশ্ন তুলেছেন অনিতা পাফ কে? তিনিও নাকি জওহরলালের ষড়যন্ত্রের অঙ্গ, নেতাজি মানে ওই গুমনামি মানে মহাকাল বিয়েই করেননি, কাজেই তার সন্তানের প্রশ্নই ওঠে না। কেন একথা বললেন? মহিলা, বিবাহ নিয়ে তাঁদের অসম্ভব নোংরা ধারণা আছে, তাঁরা নিজেদের বিয়েকেই অস্বীকার করেন, নেতাজি তো দূরস্থান। আজ ২৩ জানুয়ারি, কেবল এই কথাটাই মাথায় রাখলে চলবে, নেতাজি ছিলেন দেশপ্রেমিক, আজীবন অসাম্প্রদায়িক এক সংগ্রামী মানুষ, যিনি দেশকে স্বাধীন দেখতে চেয়েছিলেন, যে কোনও মূল্যে স্বাধীনতা চেয়েছিলেন। হ্যাঁ, বহু রাজনৈতিক দলের কাছে এই আসমুদ্রহিমাচল মানুষের আইকন নেতাজি এক বহু মূল্যবান পুলিপিঠে, কিন্তু কোনও বাঁদরকেই আমরা এই পুলিপিঠের ভাগ দেব না। নেতাজি দেশের মানুষের, নেতাজি হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টান শিখ সব্বার, জয়তু নেতাজি।   

 

RELATED ARTICLES

Most Popular