শুভাশিস মৈত্র: আজ ২৭ এপ্রিল আন্তনিও গ্রামসির মৃত্যুদিন। ১৯৩৭ সালে এই দিনে মাত্র ৪৬ বছর বয়সে মারা যান দার্শনিক এবং ইতালির কমিউনিস্ট পার্টির এই নেতা। মুসোলিনির নেতৃত্বে যখন ইতালিতে ফ্যাসিবাদ কায়েম হল, সেই সময় দীর্ঘ কারাবাসে পাঠানো হয়েছিল গ্রামসিকে। জেলে বসে তিনি লিখেছিলেন ৩০ খণ্ডে প্রিজন নোটবুক। যে লেখা নিয়ে এখনও সারা পৃথিবীজুড়ে চর্চা চলে। কলকাতায়ও গ্রামসি চর্চা কম-বেশি হয়েছে। এর শুরুটা হয়েছিল আজ থেকে ৪০-৪৫ বছর আগে। শুরুটা করেছিলেন ‘বিদ্যাসাগর অ্যান্ড দ্য ইলিউসিভ মাইলস্টোন-এর লেখক ঐতিহাসিক অশোক সেন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং লেখক পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং কলকাতায় সাবঅলটার্ন ভাবধারার প্রবর্তক ঐতিহাসিক রণজিৎ গুহ এবং আরও বেশ কয়েকজন বামপন্থী চিন্তাবিদ।
গ্রামসির ‘ব্রিফ নোটস অন ম্যাকিয়াভেলি’, ‘ম্যাকিয়াভেলি অ্যান্ড মার্কস’ ‘দ্য মডারেটস অ্যান্ড দ্য ইন্টেলেকচুয়ালস’ এমন সব নিবন্ধ আজও গভীর মন দিয়ে পড়তে হয় সমাজের গতিপ্রকৃতি বোঝার জন্য। প্রায় সাড়ে চার দশকের জীবনে আন্তনিও গ্রামসি এত কাজ করে গিয়েছেন যে মৃত্যুর ৮৬ বছর পরেও তিনি প্রতিদিন আরও বেশি করে প্রাসঙ্গিক হচ্ছেন পৃথিবী জুড়ে।
১৯৭১ সালে গ্রামসির রচনাবলি ইংরেজিতে প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে ইউরোপের বাইরেও গ্রামসি সম্পর্কে কৌতূহল বাড়তে থাকে। গ্রামসির মৃত্যুর দশ বছর পরে ১৯৪৮ থেকে ১৯৫১, এই তিন বছর ধরে ইতালীয় ভাষায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ছয় খণ্ডে গ্রামসির ‘প্রিজন নোটবুক’। এর পর প্রকাশিত হয় তাঁর পত্রাবলি। প্রায় পাঁচশো চিঠির সংকলন। প্রিজন নোটবুক যেহেতু গ্রামসি জেলে বসে লিখেছিলেন রাষ্ট্রের কড়া নজরদারিতে, ফলে তিনি অনেক কৌশল ব্যবহার করেছিলেন ভাষা প্রয়োগের ক্ষেত্রে। এমন সব পরিভাষা তিনি ব্যবহার করেছেন যা অনুবাদ করা যেমন কঠিন কাজ, তেমনই ওই ভাষা না বুঝলে গ্রামসিকে বোঝাও বেশ কঠিন।
জেল থেকে ১৯৩০ সালের ১৯ মে গ্রামসি একটি চিঠিতে লিখছেন, ‘প্রিয়তমা (তাতিয়ানা শুখুখট, স্ত্রী), তোমার পোস্টকার্ড পেয়েছি। কারাগারে আমার পরিস্থিতি বিষয়ে তোমার উদ্ভট ধারণার পরিচয় পেয়ে আবার আমার হাসি পেল। তুমি হেগেল-এর রচনা পড়েছ কি না জানি না। তিনি বলেছিলেন, ‘অপরাধীর শাস্তিতে তার অধিকার বর্তায়। তুমি মোটামুটি ধরেই নিয়েছ যে আমি যেন জেদ করে কষ্ট স্বীকারের অধিকার দাবি করছি, শহীদ হওয়ার অধিকার দাবি করছি, যাতে আমার দণ্ডভোগের একটা মুহূর্ত বা কণামাত্র থেকে আমি বঞ্চিত না হই। আমি যেন এক নতুন গান্ধী, যিনি স্বর্গ-নরকের দেবকুলের সম্মুখে ভারতীয় জনগণের ক্লেশের মূর্ত সাক্ষ্য উপস্থাপনে আগ্রহী…
১৯২১ সাল থেকে ১৯২৬ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত মুখ্য সম্ভাবনা বলতে কারাবাসের কথা ভাবিনি আমি, ভেবেছিলাম প্রাণহানির কথা। যা আমার ধর্তব্যের মধ্যে ছিল না তা হল এই অন্য কারাবিধি, যা যুক্ত হয়ে যায় প্রথমটির সঙ্গে, যার যন্ত্রণা শুধু সমাজজীবন থেকে ছিন্ন হয়ে পড়ায় নয়, বরং পরিবার জীবন ইত্যাদি ইত্যাদি থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায়। আমি আমার যেসব প্রতিপক্ষের সঙ্গে দ্বৈরথে লিপ্ত ছিলাম, তাদের আঘাতের শক্তি আমি আগেই আঁচ করতে পেরেছিলাম। কিন্তু যেখান থেকে আঘাত আসতে পারে কল্পনাও করিনি কোনও দিন… কাল রাত্রে প্রবল সমুদ্রঝড় উঠেছিল, তাই আজ বোধহয় আর ফেরি আসবে না। যে বিছানা আর বালিশে আমার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল, এখানকার বিছানা আর বালিশ তার থেকে অনেক বেশি নরম, আমার ঘুম আসে না। প্রত্যেকটা ফাঁকফোকরের মধ্যে দিয়ে বারান্দা দরজা পেরিয়ে বাতাসের শব্দ আমাকে ক্রমাগত বিব্রত করে। জিউলিয়াকে জানিয়ে দিও আমি খুব ভালো আছি। আমার সব পুরোনো ব্যথা-বেদনা সেরে যাচ্ছে। আমার সত্যি হয়তো দরকার ছিল একটা লম্বা বিশ্রামের।’